ছোটো প্রবন্ধ: বিবেকবান মানুষ চাই – অনিরুদ্ধ সুব্রত ( বনগাঁ)

বিবেকবান মানুষ চাই
অনিরুদ্ধ সুব্রত

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শিক্ষা’ নামক গ্রন্থটির ‘ছাত্রশাসনতন্ত্র’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ” সমস্যাটা আমাদের পক্ষে শক্ত হইয়াছে এই কারণেই—- আমাদের স্বদেশীয় বিজ্ঞেরাও ছাত্রদিগকে পরামর্শ দিয়া থাকেন যে, ‘বাপু, তোমরা কোনোমতে এগজামিন পাস করিয়াই সন্তুষ্ট থাকো,মানুষ হইবার দুরাশা মনে রাখিও না।” ব্রিটিশ প্রবর্তিত তৎকালীন ভারতে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার অন্তঃসারের প্রতি এই রবীন্দ্র কটাক্ষ আজকের একুশ শতকেও ভেবে দেখার যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে । প্রতিদিন শিশু কিশোর ছাত্রছাত্রীদের আমরা যে প্রচলিত অভ্যাস এবং প্রতিযোগিতার দেয়াল তোলা টানেলের মাঝখান দিয়ে দৌড় করিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, তাতে বিদ্যা-শিক্ষার রুটিনটাই সব— ব্যক্তিসত্তার বিকাশ বা বিবেক গঠনের কোনও গুরুত্ব নেই !
অভিব্যক্তিবাদের প্রবক্তা বিজ্ঞানী ডারউইনের মতে,প্রাণী জগত অভিব্যক্তির স্তরে যত উন্নত হয়েছে, তার জীবন-পরিবেশ তত জটিল হতে শুরু করেছে । সেই জটিল জীবন-পরিবেশে অভিযোজনের জন্য বুদ্ধির প্রয়োজন হয়েছে । — ডারউইনের এই মতবাদ থেকেই শিক্ষাবিদগণ মনে করেছেন, যেহেতু বুদ্ধির অধিকারী মানুষের জীবনে বহু জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, সেহেতু এই জটিলতায় তাকে সহায়তা করার জন্যই শিক্ষার প্রয়োজন । কেননা শিক্ষার উদ্দেশ্যই হলো ব্যক্তিকে জটিল পরিস্থিতির অভিযোজনে ( Adjustment) সহায়তা করা। আবার সমান্তরাল অর্থে শিক্ষা হলো— শিক্ষার্থীর সামাজিক বিকাশের প্রক্রিয়া (Education is the process on social development) ।
কলকাতার একটি নামী স্কুলে দশম শ্রেণীর কৃতী ছাত্রী স্কুলেরই শৌচাগারে আত্মহত্যা করে । এমনকি তার নিজেকে শেষ করে দেবার কৌশলটি বেশ খানিকটা নতুন ও নৃশংস — হাতের শিরা কেটে ক্ষান্ত নয়, উপরন্তু নিজের মুখে প্লাস্টিক জড়িয়ে শ্বাসরোধ নিশ্চিত করে। ব্যাপারটা এখন আদালতে । কিন্তু সমকালের একজন কিশোরী ছাত্রী কী চরম মানসিক জটিলতায় ভুগলে এই ধরণের সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে— নিশ্চয়ই মনস্তাত্ত্বিকরা তা নিয়ে ভেবেছেন । কথা উঠেছে অভিভাবক এবং স্কুল কর্তৃপক্ষের শিক্ষা সংক্রান্ত লাগাতার চাপ ও তার থেকে তৈরি হওয়া অবসাদের প্রসঙ্গ ।
অনতি অতীতে কলকাতারই আর একটি স্কুলে একজন একাদশ শ্রেণীর ছাত্র শুধুমাত্র স্কুল একদিন ছুটি হবে এই প্রার্থিত আনন্দে একটি অপেক্ষাকৃত নীচের ক্লাসের ছাত্রকে বাথরুমের মধ্যে হত্যা করেছিল । তখনও আমরা চরম আশ্চর্য হয়েছি,আলোচনা করেছি আবার ভুলে যেতেও চেয়েছি। যেন এক একটি ঘটনা আমাদের অবাক করলেও প্রচলিত শিক্ষা ও সন্তানদের জীবন পরিচালনা নিয়ে আমরা ঘাড় ফিরিয়ে ভাবব না, কেবল এগিয়ে যাব কতগুলি দৃঢ় প্রত্যয়ের লক্ষ্যে।
আধুনিক সিভিলাইজড সোসাইটির শিক্ষা সংক্রান্ত পরিকল্পনার তিনটিই প্রধান উপাদান— নামী স্কুল, মেধাবী শিক্ষার্থী এবং সচ্ছল অভিভাবক । কিন্তু মাত্র এই তিন মুখ্য উপাদানে শিক্ষা সম্পূর্ণ ? আর শিক্ষার একটাই লক্ষ্য যে সম্মাননীয় একটা অর্থ উপার্জনের পদে প্রতিষ্ঠা ? ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, প্রশাসক,গবেষক যা-ই হওয়ার লক্ষ্য থাক না কেন—- একজন বিবেচক হওয়ার কথা আমরা বলছি কখন ? কোন সিলেবাস ধরে আমরা কিশোর কিশোরীদের বলছি যে ,তোমাদের বিবেকের শিক্ষা অপূর্ণ রয়েছে ? শুধু গোটা গোটা নম্বরের একটা জ্বল জ্বলে মার্কশিট পেলেই শিক্ষক অভিভাবক পরিপূর্ণ খুশি ? সমাজে,পরিবারে,ক্লাসরুমে তারা আদৌ সহনশীলতা, সহমর্মিতা, ত্যাগ, তিতিক্ষা শিখছে কি না আমরা সে খোঁজ রাখব না । আমাদের অভাব, দুঃখ,লড়াই, যন্ত্রণার কথা তাদের সঙ্গে শেয়ার করব না। বাবা মা ছেলে মেয়ে এক সঙ্গে মনের আদান প্রদান করব না। বয়ঃসন্ধির যে কোনও সমস্যা তারা ভয় অথবা দূরত্বে অভিভাবকদের কাছে প্রকাশ করবে না। তারা শুধু একটা খসখসে সিলেবাস চিবোনো মূক প্রাণী হয়ে থাকবে ।
বরং চাওয়া মাত্র আধুনিক বিজ্ঞানের সমস্ত যন্ত্র, ডিভাইস পারলে তাদের হাতে তুলে দেব। তারা আপন মনে গান গাইবে না, ছবি আঁকবে না—- কেবল কম্পিটিশনে কালচারাল কৃতিত্ব দেখাবে ।আর যে কোনও কিছুতে ফলাফল মনোমতো না হলেই যারপরনাই বকাঝকা চলতে থাকবে। সন্তানদের শুধু জিতে চলা, শুধু এগিয়ে থাকা, শুধু সামনের সারিতে জায়গা পেলেই আমরা সুখী ? দেশ, কাল ,পরিস্থিতি — এগুলো ওদের জানা বোঝার দরকার নেই । দাবড়িয়ে বলবো, নিজেকে নিয়ে ভাবো,নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবো । ভুল করেও বলবো না, বিবেক, বৈরাগ্য, জ্ঞান, ধৈর্য, প্রেম, ভ্রাতৃত্ব, দান, সৌজন্য — এগুলো পড়াশোনার সমান্তরাল, এগুলো না শিখলে বিদ্যা অসম্পূর্ণ !
অথচ পরিসংখ্যান কেবল ঘটনার সংখ্যা মনে রাখে, আমাদের পরিবর্তিত করে না। পরিকাঠামো বাড়ানোর কথা আলোচিত হয়, দায়বদ্ধতা, নিরাপত্তা, নজরদারির কথা বার বার উঠে আসে বক্তৃতায়। অথচ শিক্ষা যে ক্রমশ তীব্র আলোর গলিপথে একটা প্রবল গতিশীল স্রোত হিসাবে বিবেচনাহীন ত্বরনে ত্বরিত হয়ে চলছে। যেখানে আদর্শের, নৈতিক মূল্যবোধের, জীবন-অভিজ্ঞতার বা ইচ্ছে ,স্বপ্নের কোনও বিরতি নেই ।
ছেলেটা বা মেয়েটা যতটা ভালো রেজাল্ট করছে ততটা কি অনুভূতির মানুষ হয়ে উঠছে— পরখ করা চাই। দেখা চাই তার সরল বাৎসল্য, হাসি অথবা অভিমানের প্রকাশ আছে কি নেই । সহোদর, সহপাঠী, পথচারী, স্বজনের প্রতি তার বিশ্বাস, ধারণা, ভালবাসা, অভিযোগ কতটুকু—- খোঁজ দরকার সে খবরেরও। শরীর মনের পরিবর্তন, সমস্যা ,নতুন অভিজ্ঞতা কোনও প্রকার অসুখ বা বিব্রত করছে কি না সে খেয়াল আমাদের, অভিভাবক, নিকটজনদের।
শিক্ষকদের সব দায় সিলেবাসে শেষ হয়ে যায় না । গণ্ডায় গণ্ডায় সুপার ডিভিশন রেজাল্টে যে শ্লাঘা শিক্ষক সমাজের, একটা দুর্ঘটনায় ততটাই অস্বস্তি—– কিন্তু পরিপূর্ণ শিক্ষার ত্রুটি কি অস্বীকার করা যায় ! প্রয়োজনীয় অর্থ , পরিকাঠামো, নিরাপত্তা নিশ্চয়ই প্রাসঙ্গিক কিন্তু এর ফাঁকে হারিয়ে যাচ্ছে মননশীলতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনটির কথা। দেরিতে হলেও এখনই উদ্যোগী হওয়া দরকার, গুমোট অন্ধকার থেকে নতুন প্রজন্মকে সতেজ বাতাসে লালনের জন্য । তা না হলে এই অকাল মৃত্যু মিছিল, এই অপরাধ প্রবণতা, এই অসহিষ্ণুতা এবং রহস্যময়তার মেঘে ক্রমশ সমস্ত আকাশ ছেয়ে যাবে।

One thought on “ছোটো প্রবন্ধ: বিবেকবান মানুষ চাই – অনিরুদ্ধ সুব্রত ( বনগাঁ)

  1. সহমত পোষণ করি । একদম ঠিক বলেছেন । ভালো লাগলো ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *