ভ্রমণঃ কাশ্মীর ভ্রমণ – সাবিত্রী কাহালি (কলকাতা)

কাশ্মীর ভ্রমণ
সাবিত্রী কাহালি

১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি আমরা স্বামী, স্ত্রী, মেয়ে ও আমার ছোট বোন, ভগ্নীপতি ও তার ৪ বছরের ছেলে সহ “জম্মু-তাওয়াই” ট্রেনে যাত্রা শুরু করি গোমো জ্ংশন থেকে।
আমার স্বামী ভারতীয় রেলের স্পেশাল ট্রেনের গার্ড ছিলেন। ভগ্নীপতি ফারাক্কা বাঁধের এক্সিকিউটিভ ইন্জিনিয়ার ছিলেন। তাঁর ইচ্ছে এবং তত্ত্বাবধানে বেড়াবার প্রোগ্রাম হয়।
কিভাবে যাবো, কোথায় থাকবো, সঙ্গে কেমন পরিধান নেবো আর অবশ্যই লাগেজ যত কম নেওয়া যায়! এই সব কিছু ওর নখে দর্পনে! প্রচন্ড ভ্রমন বিলাসী! আমার একটি মাত্র সন্তান। তার ইচ্ছে ছিল আগে কাশ্মীর ভ্রমন করতে হবে। তার ইচ্ছে পূরণ করতে ভগ্নীপতি কে গাইড করে বেড়িয়ে পরলাম। মলয় ট্যুর প্রোগ্রাম তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত। ওর সঙ্গে অনেক জায়গায় আমরা বেড়িয়েছি। রেলওয়েতে চাকরি করার সুবাদে বরাবরই শীততাপ কামরা সংরক্ষিত করা হতো। তাই গাড়ির ধকল খুব একটা বুঝিনি। তবে দু’রাত,তিন দিন কাটানো একটু কষ্টকর বটে! সঙ্গে ছোট একটা বাচ্চা ছেলে। কিন্তু সে বড় শান্ত ও প্রানবন্ত। ওর আধো আধো কথা,ওর গান শুনে আনন্দে সময় কেটেছে। সবচেয়ে বড় কথা আমরা তো ভূস্বর্গ দর্শনে যাচ্ছি! যথা সময়ে আমরা জম্মু স্টেশনে নেমে শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম লাক্সারি বাসে করে। ১২ ঘন্টা লেগেছিল গন্তব্যে পৌঁছাতে। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন যান বাহনের এতো সুবিধা ছিলনা। আজ প্রায় ৪০বছর আগের কথা!!
আমাদের কষ্ট হয়নি শুধু মাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে যাবার জন্য!

ছবি- সংগৃহীত


কি অপূর্ব মনোরম দৃশ্য!! রাস্তার ধারে হরেক রকমের ফুলের সমারোহ। যেন আমাদের হাতছানি দিয়ে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। এসো দেখো এখানে কত কিছুর সম্ভার!! পাইন গাছের সারি! গাছে গাছে আপেল ঝুলছে! প্রকৃতি যেন অতি যত্নে সাজিয়ে রেখেছে!
ন্যাসপাতি গাছের নীচে থরে থরে পড়ে আছে। এখানকার একটা ফল ওদের খুব প্রিয়। বাবা গোসা বা বাবুগোসা। আমরা তার স্বাদ নিয়েছি।

ছবি- সংগৃহীত


আমাদের বাস জার্নি শেষ। এবার থাকার কথা আমরা ঠিক করেই এসেছিলাম যে এখানে হাউস বোটে থাকবো। অন্য সব জায়গায় তো হোটেল এ থাকি।
হাউস বোটের মালিক আমাদের নমস্কার জানিয়ে বলেন আপনাদের লাগেজ গুলো দিন আর আমার শিকারায় বসুন। অতি যত্নে সব গুছিয়ে শিকারা একদম হাউস বোটের সামনে রেখে একটা পাটাতন লাগিয়ে ঘরে গিয়ে বসতে বলে।

ছবি- সংগৃহীত


ঘরে ঢুকে মনটা অসীম প্রশান্তি পেলো। সুন্দর করে সাজানো বসার ঘর। মরশুমি ফুল দিয়ে চমৎকার সাজানো আখরোট কাঠের তৈরি ফুলদানি! আগাগোড়া কার্পেট দিয়ে মোড়া মেঝে। অনির্বচনীয় আনন্দ অনুভব করলাম! নিমেষে ক্লান্তি উধাও! আমাদের সবার ফরমায়েশ জেনে নিয়ে সরবৎ নিয়ে এলো। শুকনো ফলের কুচি দিয়ে দারুন! তারপর স্নান সেরে তর তাজা হয়ে হালকা কিছু খেয়ে বিশ্রাম। দুপুর আর রাতের আহার সেরে পরের দিনের কোথায় কি দর্শন করবো তা নিয়ে আলোচনা শুরু হলো। হ্যা আমরা হাউস বোটে ই খাবারের ব্যবস্থা রেখেছিলাম।
আমাদের সব দর্শনীয় স্থান দেখাবার জন্য ইকবাল দায়িত্ব নিয়ে ছিল।
সকালেই বেড়িয়ে পরলাম। শিকারা থেকে নেমে চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ আমরা! সর্বাগ্রে চোখে পড়ে তুষার শুভ্র রজতে মোড়া পর্বত শৃঙ্গ! গাড়ি বুক করে লোকাল সাইট-সিয়িংএ। আগে ঐতিহাসিক শঙ্করাচার্যের মন্দিরে।

ছবি- সংগৃহীত


ডাল লেকের কাছে নেহরু পার্কের শেষ মাথায় পাহাড় কেটে রাস্তা উঠে গেছে ওপরের দিকে। শুনেছি সম্রাট অশোকের ছেলে ঝালুকা ৩০০মিটার উঁচুতে এই শিব মূর্তি গড়েন। তপস্বী শঙ্করাচার্য ভারত ভ্রমনের সময় এই পাহাড়ে তপস্যা করেন তাই তাঁর নামে ঐ পাহাড়ের নাম করণ! আমার ২৪০টি সিঁড়ি বেয়ে উঠে চমৎকার দৃশ্য দেখে আপ্লুত! ওপর থেকে নীচের সৌন্দর্য উপভোগ্য! একদিকে ঝিলম লেক,অপর দিকে ডাল লেক শ্রীনগরের শ্রীবৃদ্ধি করেছে!
এখানে পাহাড়ের নীচের দিকে মোগলদের হাতে তৈরী ছোট বাগানের নাম চশমেশাহি! এখানকার ঝর্নার জল খেলে রোগ ব্যাধি দূর হয় এমন বিশ্বাস এদের। আর ও কয়েকটি বাগান আছে।নিশাত বাগ, কিছুটা দূরে শালিমার বাগ। এখানকার আশে পাশে লুকোনো আছে সম্রাট জাহাঙ্গীর ও নূরজাহানের প্রেম কাহিনি! জাহাঙ্গীর কাশ্মীর কে প্রথম তুলনা করেছিলেন স্বর্গের সাথে! তিনি ফার্সী ভাষায় বলেছিলেন”আগর ফেরদৌস বর রুইজমিনসতো,হামিনসত ও হামিনসত,ও হামিনসত” বাংলায় তরজমা করলে এর অর্থ হলো “পৃথিবীতে যদি স্বর্গ থেকে থাকে, তবে সে এখানে, এখানে, এখানে! এবার একে একে মোগল গার্ডেন,হজরত বাল মসজিদ ও নাগিন লেক, সারাদিন শ্রীনগরের দর্শনীয় স্থান দেখেছি। ভাল লেকের ভাসমান শহর দেখে চমৎকৃত হয়েছি! এরপর আমরা সবুজ ঘাসে ঢাকা বিস্তৃত গুল মার্গ যাই।যা বছর ভর বরফেই ঢাকা থাকে।আমরা রে সময় গিয়েছিলাম বরফ দেখতে পাইনি। গল্ফ ক্লাব, সেন্ট মেরি চার্চ এবং আকর্ষনীয় রোপ-ওয়ে!! এতে চেপে ওপর থেকে পুরো শহর দেখা যায়! মনোরম দৃশ্য!গুল মার্গ পাহাড়ে ঘেরা শহর!যখন বরফ থাকে তখন এখানকার জনপ্রিয় খেলা”স্কি”র জন্য উপযুক্ত জায়গা! গুল মার্গ ও খিলান মার্গের অবস্থান প্রায় ৮৫০০ফিট ওপরে পীর পাঞ্জাল পর্বত শ্রেনীর পাদদেশে। এখানে আকাশ ছোঁয়া পাইন গাছের সারি দেখে মোহিত হয়ে যাচ্ছিলাম।কী সুন্দর! এবার পহেল গাঁও!যেতে যেতে রাস্তার দুই ধারে শুধু আপেল বাগান!লিডার নদী বয়ে চলেছে। দেখলাম বেতাব ভ্যালী, চান্দের ওয়ারি,আরু ভ্যালী,কানি মার্গ,আর কাশ্মীর ভ্যালী পয়েন্ট।ঘোড়ায় বসে পেহেল গাঁও ভিউ পয়েন্ট দেখে আনন্দ পেয়েছি! পরের দিন সোন মার্গ দর্শন লাভ করে জীবন ধন্য হলো।এক কথায় অনবদ্য! অপূর্ব?যেন রূপোর পাহাড়!প্রধানত খাজিওয়াস হিমবাহ! পাহাড়ের চূড়ায় সূর্যের ছটা লেগে ঝকঝক করছে। অবর্ণনীয় অনুভূতি! এখানে পায়ে হেঁটে চলতে কষ্ট হয়।তাই ঘোড়ার পিঠে চড়ে একদম সামনে গিয়ে এই দৃশ্য দেখেছি! সিন্ধু নদী, ঝর্নার জলের শব্দ শুনতে শুনতে হাউস বোটে সেদিন কার মতো বেড়াবার পালা সমাপ্ত হয়।

ছবি- সংগৃহীত


আমরা ১১ দিন কাশ্মীরে ছিলাম। একদিন ও ঘরে বসে থাকিনি।রোজ হাউস বোট থেকে শিকারায় পাড়ে উঠে কিছু কিছু কেনাকাটা করেছি।হাউস বোটের মালিক আমাদের নিয়ে সবকিছু দেখিয়েছে। কোথায় শাল তৈরি হয়, কোথায় আখরোট কাঠের নানান ধরনের শো-পিশ হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।

ছবি- সংগৃহীত


ইকবাল ওর আপেল বাগান দেখাতে নিয়ে গিয়ে বল”নিন আপেল পেড়ে খান। সঙ্গে নিয়ে যান”।কত আন্তরিকতা! খুব অমায়িক। মনেই হয়নি ওরা আপন নয়। ইকবালের বৌ, ছেলে মেয়ে সব সময় আমাদের ঘরে এসে খোঁজ খবর করতো। আমাদের কিছু দরকার আছে কি-না। এখন পারমিশন ছাড়া নাকি আপেল বাগানে ঢোকা যায়না।আমরা যখন গিয়েছিলাম এতো বাধা নিষেধের বেড়াজাল ছিল না। ওদের আন্তরিকতা অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছি। সারা জীবন মনে রাখার মতো! আমরা কাশ্মীর থেকে জাফরান ও কিছু রান্নার মশলা এনেছিলাম।ওরা প্রচন্ড ঝাল দেয় রান্নায়।যাতে আমাদের অত ঝাল না দেয় বলে দিয়ে ছিলাম। তেমনি ভাবে ই আমাদের করে দিতো।

ছবি- সংগৃহীত


একটা কথা বলিনি।”পশমিনা’ যা শিশু ভেড়ার নরম লোম দিয়ে তৈরী করা হয়। দেখতে সুন্দর আর গায়ে জড়ালে ভাড়ি আরামদায়ী! এবার তো ঘরে ফেরার পালা!! কিছু না কিনলে বেড়ানো সার্থক হয়না। তাই ওখানকার স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ মা বয়ে আনা সম্ভব এনেছিলাম।ছোট ছোট শিকারা, হাউস বোট, আখরোট কাঠের,টী-ট্রৈ মা এখনো আমার ঘরে আছে। একবার গেলে কাশ্মীরে সব দেখা যায়না।২/৩ বার গেলে খুব ভালো করে তা সম্ভব! কিন্তু তা কি হয়, জীবনে প্রথম বার কাশ্মীর ভ্রমন করে যত টুকু আনন্দ উপভোগ করে এসেছি বাকি জীবন ভর ভূ- স্বর্গ দর্শনের রেশ থেকে যাবে।

4 thoughts on “ভ্রমণঃ কাশ্মীর ভ্রমণ – সাবিত্রী কাহালি (কলকাতা)

  1. সব ছবির মতো চোখের সামনে যেন দেখতে পাচ্ছি। সুন্দর লেখনী।

    1. সত্যিই ভূ স্বর্গ। সুন্দর বর্ণনা। আরও লিখুন। সঙ্গে নিজেদের তোলা ছবি , পুরনো হলেও রাখার চেষ্টা করুন। ধন্যবাদ‌।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *