ভ্রমনঃ বুদ্ধের সন্ধানে – সৌমিত্র ঘোষ ( কলকাতা)

বুদ্ধের সন্ধানে, প্রথম পর্ব
সৌমিত্র ঘোষ ( কলকাতা)

২০২০ সালের শেষ প্রান্তে কোভিড প্রতিরোধে যখন রণক্লান্ত ও বিপর্যস্ত, তখন বাইরে বেরোনোর জন্য আমরা ভিতর থেকে ছটপট করছি। সুব্রত অধিকারী যিনি এক সময়ের প্রথম ডিভিসনের ফুটবল খেলোয়াড় হিসাবে নাম করেছিলেন, পাহাড়ে ট্রেকিং করার বিস্তর অভিজ্ঞতা তাঁর । তাই তাঁর সঙ্গে আমরা কয়েকজন আলোচনা করে স্থির করলাম, শ্বেত শুভ্র বরফ ছুঁতে কোথাও যেতে হবে । সুব্রতদার প্রস্তাব অনুসারে অতঃপর স্থির হলো ১৯শে জানুয়ারী ২০২১, আমরা সান্দাকফু যাবো। যথারীতি টিকিট কাটার তোরজোড় শুরু হয়ে গেলো, আমি, সুব্রতদা, তাপস দা, শ্যাম দা, সুরজিত, নবারুন ও রাণা টিকিট কেটে নিলাম, সহজেই টিকিট পেয়ে গেলাম কারন, কোভিড আতঙ্কে বেশিরভাগ মানুষ তখনও তটস্থ ।
১৯ শে জানুয়ারী শিয়ালদহ থেকে দার্জিলিং মেলে চেপে বসলাম। আমরা সবাই যার যা সম্ভব রাতের খাবার নিয়ে এসেছিলাম, ট্রেনে ওঠার আগেই সুপার হিট ডিনার করে নিউ জলপাইগুড়ির দিকে ছুটে চললাম। উত্তেজনায় রাত্রে বারে বারে ঘুম ভেঙেছে, সকালের মিঠে রোদের ঝলকানিতে মন আরও চঞ্চল হয়ে উঠলো, যেন প্রেমিকার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারের শুভক্ষন।
২০শে জানুয়ারী এনজেপিতে নেমে কফি খেয়ে গাড়ির সন্ধানে চলে গেলেন সুব্রত দা, এনজেপি থেকে মানেভঞ্জং এর দূরত্ব প্রায় ৮৬ কিমি এন এইচ ১১০ দিয়ে কম বেশি ঘন্টা তিনেক লাগে। দর করে গাড়ি নিতে হবে। আমরা সাড়ে তিন হাজার টাকায় গাড়ি পেলাম। মাঝখানে মোমো কফি খেয়ে সাড়ে বারোটা নাগাদ পৌঁছলাম। ভারতে নেমে নেপালের একটি হোম স্টে তে উঠলাম। এক পাশে ভারত অন্য পাশে নেপাল। বেশ মজার কিন্তু । হোম স্টে তে বলাই ছিল, যদিও ঘরটি মনের মতো হয় নি, কিন্তু আতিথেয়তায় মুগ্ধতা রয়ে গেল । শেষে সব বিবরন সবিস্তারে দিয়ে দেবো। মানেভঞ্জং এ যদিও সেরকম ঘোরার কিছু নেই, তবুও কাছাকাছি বুদ্ধমন্দির, স্টেডিয়াম আর দোকানপাট ঘুরলাম। বিকেলটা আড্ডা দিয়ে ক্লান্ত শরীরটা বিছিয়ে দিলাম। পরের দিন টুমলিং যাবো তাই কিছু জিনিস রেখে গেলাম ক্লকরুমে। তাড়াতাড়ি দেশী মুরগী সহযোগে ডিনার সেরে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালাম।
২১ তারিখ কাকভোরে শীতে কাঁপতে কাঁপতে ব্রাশ করতে করতে সে আর এক রোমাঞ্চ! চারিদিক কুয়াশাচ্ছন্ন কিন্তু এক অসাধারণ দৃশ্য মন ভরিয়ে দিলো। যাই হোক দুটো গাড়ি ভাড়া করলাম। হোমস্টের কাছেই গাড়ির মেলা। গাড়ি একেবারে টুমলিং, সান্দাকফু হয়ে টুলুং পর্যন্ত দরদাম করে নিলাম। ৮,৫০০টাকা গাড়ি প্রতি ভাড়া রাত্রে অপেক্ষার জন্য ১০০০ টাকায় ঠিক হলো। ল্যান্ডরোভারে যাওয়া একটা আলাদা অনুভূতি। মানেভঞ্জং থেকে প্রত্যেকের অনুমতি গ্রহন করে আমরা রওনা দিলাম। পাহাড়িপথ ক্রমশঃ এঁকেবেঁকে উঠছে এক পাশে ঘন সবুজ বনানী পেরিয়ে চিত্রেতে কিছুক্ষণ কাটালাম।
চিত্রে একটা ছোটোে পাহাড়ি গ্রাম। এখানকার প্রধান আকর্ষন প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার ও কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষারশুভ্র শিখরগুলোর অপরূপ সৌন্দর্য, কিন্তু আবহাওয়ার কারনে আমরা বৌদ্ধ বিহার দেখেই সন্তুষ্ট থাকলাম। দুই ফট দুরে থাকা মানুষকেও বরখা রানী মেঘে লুকিয়ে ফেলছে। মেঘবৃষ্টির খেলা জানুয়ারি মাসেও যে হবে তা ধারনার বাইরে ছিল। শেষ পর্যন্ত সান্দাকফুতে কি দেখবো সেই আশঙ্কা নিয়ে টুমলিং এর দিকে রওনা দিলাম । প্রায় ২ ঘন্টায় ৫৪ কিমি পথ অতিক্রম করে টুমলিং পৌঁছালাম। রাস্তার একদিকে বিস্তীর্ণ পাহাড়ি শোভা অপর প্রান্তে প্রতিবেশী দেশ নেপাল। সেখানেই হোমস্টেগুলো। এখানে অনেক লজ বা হোমস্টে আছে, শিখর লজ, দাওয়া লজ, সিদ্ধার্থ লজ,প্রভৃতি সব দরদাম করে আমরা সতকার লজের দুটো ঘর নিলাম একটি ঘরে ৪ জন অপর ঘরে বাকি তিনজন থাকবো ঠিক হলো। প্রচন্ড ঠান্ডায় গরম কফি আর অসাধারণ আচার সহযোগে পরম আতিথেয়তার সঙ্গে গরম গরম লুচি আলুর তরকারি ডিম সহযোগে তৃপ্তি সহকারে ব্রেকফাস্ট করে ক্যামেরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।


এক কথায় অসাধারণ কম হবে যা অপরূপ দৃশ্য মন ও ক্যামেরা বন্দি করলাম। হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা ওপরে উঠতে থাকলাম। একটি মন্দির চোখে পড়লো, সেখান থেকে পাহাড় ঘেরা টুমলিং কে যেন প্রকৃতি সৌন্দর্য উজার করে দিয়েছে! টুমলিং নেপালের ইলম জেলার জোগমাই ভিডিসির একটি ছোট্ট গ্রাম। পূর্ব হিমালয়ের ২৯70০ মিটার উচ্চতায় পর্যটকদের আকর্ষণ, এর জনসংখ্যা বেশিরভাগ গুরুং পরিবার নিয়ে গঠিত, যেখানে মোট জনসংখ্যা সংখ্যা মাত্র ১৫ জন। মেঘমা থেকে দার্জিলিংয়ের কাছাকাছি থেকে প্রায় 35 মিনিটের পথ। উচ্চতা ৯৬০০ ফুট হবে । ছোটো পাহাড়ের গায়ে গাছগুলোর পাতায় রাত্রের শিশিরগুলো বরফের ফুল হয়ে শোভিত। যেন কেউ যত্ন করে বরফগুলো শৈল্পিক চেতনা দিয়ে গাছগুলোতে স্থাপন করেছে পর্যটকদের জন্য । প্রথম বরফ থেকে মন যেন বয়সটাকে আচমকা কমিয়ে নিয়ে গেলো পঁচিশে। অসাধারণ রূপ ভোলার নয়।
দুপুরে হোমস্টেতে অমৃতসমান লাঞ্চ সেরে সুন্দরী টুমলিংকে মন প্রান সঁপে হোম স্টে তে ফিরলাম। শীত ক্রমশঃ বাড়ছে। রাত আটটায় তাপমাত্রা নেমে ১.৫° সেলসিয়াস। দেরি না করে চিকেন কারী সহযোগে ডিনার সেরে লেপের মধ্যে মুখ লুকোলাম।
সকালে পর পর দুকাপ কফি খেয়ে তল্পি তল্পা গুটিয়ে এবার সান্দাকফুর দিকে ছুটলাম, যাওয়ার পথে কালপোখরিতে কিছুটা সময় কাটালাম, মেঘলা কালপোখরির মেঘের চাদরে ঢেকে গেলাম বটে কিন্তু প্রাকৃতিক দৃশ্য অবগুণ্ঠিত । আমাদের সঙ্গি কয়েকজন ট্রেক করে সান্দাকফুর দিকে রওনা দিল, বাকি বয়স্করা গাড়িতে চেপেই ঘুমন্ত বুদ্ধের শরনাপন্ন হলাম।
সান্দাকফু পৌঁছেই থাকার বন্দোবস্ত করলাম, অনেক থাকার জায়গা আছে যেমন Sherpa Chalet, Sandakphu +919547280998, 9933488159

2) Sunrise Hotel , +97727691269 (Nepal num)
আমরা হোটেল এস্টন ব্লুতে একটা ডরমেটরি ঠিক করে বেড়িয়ে পড়লাম কাছাকাছি প্রাকৃতিক দৃশ্যকে ক্যামেরা বন্দি করে নিতে।
সান্দাকফু বা সান্দাকপুর (৩,৬৬৫ মি; ১১,৯৩০ ফুট) নেপালের ইলাম জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ। এটি পশ্চিমবঙ্গ- নেপাল সীমান্তের দার্জিলিং জেলার সিঙ্গালিলা পর্বতের সর্বোচ্চ শিখর। শিখরটি সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যানের কিনারায় অবস্থিত এবং শীর্ষে কয়েকটি হোটেল সহ সামিটের একটি ছোট্ট গ্রাম রয়েছে। বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি পর্বতের চারটি এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, লোৎসে এবং মাকালুকে এর শীর্ষ থেকে দেখা যায়। এটি পুরো কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতের একটি প্রাথমিক দৃষ্টিভঙ্গি সরবরাহ করে।


আমরা মেঘলা সান্দাকফু দেখে বিফল মনোরথ হলেও ধীরে ধীরে মেঘ কেটে ধীরে ধীরে শৃঙ্গগুলো উন্মোচিত হওয়া সাথে সাথেই মাইনাস টেম্পারেচারেও রক্ত সংবহন দ্রুত হতে শুরু হতে লাগলো।
এ কি দেখছি! রাজকীয় ভঙ্গিতে বুদ্ধদেব যেন শুয়ে আছেন, পাশে শৃঙ্গগুলো যেন একমনে পাহারাদারের মতো পাহারা দিচ্ছে। গাছগুলো বরফের ফুলে আচ্ছাদিত। মেঘের গালিচা যেন পথ তৈরি করে দিয়েছে কাঞ্চনজঙ্গা, এভারেস্ট, মাকালু, লোৎসের কাছে পৌঁছানোর জন্য । নিচে হোটেল, বিভিন্ন রঙে শোভিত হোমস্টে, হোটেলগুলো নিয়ে মেঘ ও পর্বত শৃঙ্গের সমন্বয় দৃশ্যপটকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে । তবে, একটু হাঁটলেই শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আমাদের একজন তাপসদা তো প্রবল ঠান্ডা ও শ্বাসকষ্টের কষ্টে ঘরে চলে গেল যুবক সঙ্গীরা ততক্ষনে ট্রেকিংএর অসামান্য অভিজ্ঞতা নিয়ে বিকেল চারটে নাগাদ সান্দাকফু পৌঁছে গেছে। তখনও লাঞ্চ হয়নি, থুকপা আর কফি খেয়ে প্রাকৃতিক শোভা নিরীক্ষণ করতে করতে আঁধারে ডুবে গেল প্রকৃতি । আমরা ডরমেটরিতে ফিরলাম। পরবর্তী দিনের পরিকল্পনা, গল্পগুজব করতে করতেই চিকেন রুটি সহযোগে ডিনার সেরে ক্লান্ত শরীরটা ঘুমের দেশে আশ্রয় নিলো।
সূর্যোদয়ের প্রতিফলন দেখবো বলে প্রবল ঠান্ডা উপেক্ষা করে আমরা তৈরি হয়েই বাইরে এলাম। তখনও অন্ধকার জাপটে রেখেছে প্রকৃতিকে। হোটেলের কৃত্রিম আলোর সাহায্যে সূর্যালোকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য আমাদের সাথে আরও অনেক পর্যটকরা জড়ো হচ্ছেন । ঠান্ডায় হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল ঠান্ডার কামড়ে যন্ত্রণায় টনটন করছে। সে যন্ত্রণা লিখে বোঝানো যাবে না। লাগোয়া রেস্টুরেন্টে তি চার কাপ কফি খেয়েও গা গরম হচ্ছে না। বাইরে মিটারে তখনও -৭° সেলসিয়াস তাপমাত্রা দেখাচ্ছে ।
ক্রমশঃ তুষারাবৃত শৃঙ্গগুলো দৃশ্যমান হতে লাগলো। সূর্যের আলো এভারেস্ট সহ কাঞ্চনজঙ্ঘাকে এক অপরূপ সৌন্দর্যের চাদরে ঢেকে দিলো। মুগ্ধতা যেন এক মুহুর্তে সারা শরীরে উষ্ণতা ছড়িয়ে দিলো। মানুষ স্বরগ খুঁজে মরে, আমরা সেই স্বর্গে দন্ডায়মান হয়ে যেন জীবনের যাবতীয় দুঃখ কষ্ট বিসর্জন দিয়ে প্রকৃত মুক্তির স্বাদ আহরন করছি । সময় হয়ে এলো, শুকনো খাবার দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে এবার টুলুং এর দিকে রওনা দিলাম । টুলুং হয়ে হেঁটে যাবো ধোত্রে তারপর আরও কোথাও । আরও অনেক গল্প পরের বার বলা যাবে। সবাই সুস্থ থাকুন ।

3 thoughts on “ভ্রমনঃ বুদ্ধের সন্ধানে – সৌমিত্র ঘোষ ( কলকাতা)

  1. অসাধারণ। ভ্রমন কাহিনী পড়ে চোখের সামনে ভেসে উঠলো।

  2. সুন্দর বর্ণনা।।ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *