‘পরিবর্তিত সমাজ এবং মানসে আজকের নারী’
সৌমী চক্রবর্ত্তী
‘বন্দিতাঙ্ঘ্রিযুগে দেবী সর্ব্বসৌভাগ্যদায়িনি।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।।’
নারী, সৃষ্টির আদিসত্তা।ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বীজ বহনকারী। পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির সূচনার পর যখন লিঙ্গভেদের অর্থ জানল মানুষ তারও আগে নর-নারীর যৌথ জীবন প্রবাহের ধারা একই সমান্তরালে চলছিল। জীবন যাপনে, কার্যকলাপে ভেদজ্ঞান করা হয়নি। ধীরে ধীরে বসতি স্থাপন, সামাজিক জীবনে প্রবেশের পর থেকেই সমাজ জীবনের গতিপথে নারীর ভূমিকাতে সংশয়ের কৃত্রিম অবকাশ সৃষ্টি করা হয়েছে। সমাজ ব্যবস্থার রদবদলের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে নারীর অবস্থান।অনার্য সমাজ জীবনে যে নারী সৃষ্টির মূল উৎস রূপে পূজিত হয়েছেন, সমাজের উচ্চস্তরে অবস্থান করেছেন, নিজেদের মতামতকে প্রাধান্য দিতে পেরেছেন, সেখানে আর্য সমাজে অন্তর্ভূক্তির পর তাঁর অবস্থান নিম্নে এসে পড়েছে। নারী হয়েছেন উপেক্ষিতা।পুরুষপ্রধান সমাজে নারী ক্রমশ দলিত সম্প্রদায়ের ন্যায় অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। নারীর গতিবিধি, চালচলনে যুক্ত হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। বাইরের জগৎ থেকে ধীরে ধীরে অপসৃত হয়ে অন্দরমহলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়েছে তাঁর যাতায়াত। শতাব্দীপ্রাচীন নিয়মের শেকল পরানোর প্রথা তৈরি করা হয়েছে নারীকে আটকে রাখার জন্য। সুচতুর ভাবে তাঁকে সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্যে। আশাপূর্ণা দেবীর ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, রাসীসুন্দরী দাসীর ‘আমার জীবন’ প্রভৃতি গ্রন্থগুলি এক একটা দলিল হয়ে রয়েছে নারী জীবনের ত্রুটি-বিচ্যুতি-বন্দীত্ব-মাহাত্ম্য বর্ণনায়। যদিও প্রাচীন জংধরা নীতির বেড়া ভেঙে যুগে যুগে বেরিয়ে এসেছেন গার্গী,মৈত্রেয়ীরা।স্বমহিমায় বিরাজ করেছেন জ্ঞানের সিংহাসনে। কিন্তু সেই সংখ্যা সার্বজনীন নয়।অত্যন্ত মেধাবী, জ্ঞানের আলোকে পরিপূর্ণ গুটিকয়েক সাহসী সত্ত্বারা সমাজের উচ্চস্তরে অবস্থান করতে পেরেছেন প্রবল প্রচেষ্টায়।জন্ম থেকে শুরু করে প্রবল ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে পেঁয়াজের খোলস ছাড়ানোর মতো জীবনের গলিপথ ছেড়ে রাজপথে উত্তরণ সহজ নয় মোটেই। কতিপয় মানুষ সেই ছাপ ছেড়ে যেতে পারেন।আর পুরুষ ও নারীর ভেদ করলে সেই সংখ্যা কমতে কমতে ক্ষুদ্র নক্ষত্র হয়ে দাঁড়ায়।এই গুটিকয়েক সংখ্যার উজ্জ্বলতার পিছনে হাজার হাজার গুটি বসন্তের দাগের মতো লড়তে লড়তে অন্ধকারে হারিয়ে যায় বহু মানুষ তথা বহু নারী।যাঁদের অস্তিত্ত্ব আমরা জানতেই পারি না কোনদিন।
নারী জন্মের সূচনা লগ্নেই মানুষের মনে ত্রাসের সৃষ্টি দেখতে পাই ভ্রূণ হত্যার মধ্যে দিয়ে।আজ পর্যন্ত কোন পুত্র ভ্রূণ হত্যার কথা শোনা যায় না, কিন্তু কন্যা ভ্রূণ হত্যা মামুলি ব্যাপার। একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও অনেক পরিবারে কন্যাসন্তান ও পুত্রসন্তানের মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণ দেখা যায়,যা অস্বীকার করার উপায় নেই।আমরা এগিয়ে যাওয়ার তুলনায় পিছিয়ে যাচ্ছি বেশি, কিন্তু মানতে চাইছি না।জন্মের পর কৈশোর ও বাল্য অতিক্রম করার সময় থেকেই নারী ও পুরুষের লিঙ্গ ভেদের পার্থক্য আমরা নিঃসাড়ে ঢুকিয়ে দিতে থাকি শিশুমনে। শারীরিক গঠন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানসিকভাবে বিধিনিষেধের বেড়াজাল তৈরি করে নারীকে ঘেরাটোপে বন্দী করাই আমাদের উদ্দেশ্য।আমরা মেয়েদের কিভাবে চলা উচিত,কোন পোশাক পরা উচিত, কোথায় যাওয়া উচিত নয় সেগুলোই পারিবারিক আবহাওয়ায় শিক্ষা দিতে থাকি। কিন্তু পুরুষদের মানসিক সংযম, দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা, স্বাভাবিকভাবে সবকিছুর সমান বিচারের মানসিকতা তৈরি করি না। আমাদের দেশীয় আবহাওয়ায় সেই শিক্ষা দেওয়ার মানসিকতার প্রচন্ড অভাববোধ পরবর্তীকালে মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সেখানে আমাদেরই মানসিক ভন্ডামি আছে,তাই সেখানেও আমরা চোখে আঙুল দিয়ে নারীরই অসাবধানতাকে দেখাই।’সোনার আংটি ব্যাঁকা হলেও তবু সোনার’ বলে লিঙ্গভেদের পার্থক্যকে আরও বড় করে তুলি। একদিকে প্রশ্রয় আর একদিকে দমিয়ে রাখা এই দুটো জিনিসের প্রভাবে সমাজ তার সাম্যতা হারায়। হয়রানির স্বীকার হয় স্ত্রী লিঙ্গ।নারী যে কেবলই সন্তান উৎপাদন আর যৌন চাহিদা মেটানোর জন্যে মাংসপিণ্ড মাত্র এই ধারণার বশবর্তী হয়ে থাকেন বেশিরভাগ পুরুষ। শারীরিক ও মানসিক সমস্যাকে আলাদা করে নিষ্পেষিত করার পরেও সামাজিক জীবনে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে নারীর প্রতি আলাদা দৃষ্টিকোণের ছুৎমার্গ প্রবাহিত হয়। বিবাহিত জীবনে প্রবেশের পর শারীরিকভাবে কুক্ষিগত করার অধিকার ফলানো পুরুষটি নারীমনের প্রকৃত ভাবনা চিন্তার সহযাত্রী হতে ব্যর্থ হন। গুমরে গুমরে ক্ষতবিক্ষত হয় কত অবচেতন মন, আমরা কেউ কেউ তার প্রত্যক্ষদর্শী, কেউ বা এই সমস্যার শিকার।ট্রামে-বাসে-ট্রেনে অযাচিত স্পর্শ কেবলমাত্র নারীদেহেই পাওয়া যায়।কোন পুরুষের দেহে এই স্পর্শ পড়তে দেখা যায়না। এছাড়াও কর্মক্ষেত্রে শারীরিক নিগ্রহ, অন্ধকার নির্জনে নারীদেহ ধর্ষণের খবর সংবাদপত্রের আনাচে কানাচে চোখ মেললেই দেখা যায়।
তবে কী সমাজের রদবদল হয়নি?সবটাই কী সেই প্রাচীনপন্থী দিদিমা-ঠাকুমাদের আমলে পড়ে আছে? এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে।সেটা দেখতে হলে আমাদের সামনে রাখতে হবে সেকাল ও একালের ভাবনা-চিন্তা, জীবনধারার বৈচিত্র্যকে।আজ থেকে কয়েক দশক আগে যে নারীর ঠিকানা ছিল কেবল অন্দরমহল, বাইরের জগতে প্রবেশের অগ্রাধিকার ছিল না, বাইরের মানুষের সামনে মুখ দেখানোর প্রথা ছিল না— সেই অচলায়তন বর্তমানে বেশ কিছুটা ভেঙেছে।এখন মান্ধাতা আমলের সেই ঘরের কোনে দিন কাটাবার সময় পেরিয়েছে। বর্তমানে নারী কিছু স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।তারই ফলে শুধুমাত্র অন্দরমহলে নয় নারীকে দেখা যাচ্ছে স্কুল-কলেজ,অফিস-আদালত,ব্যাবসা-বাণিজ্য সহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে চলতে। ঘরের কোনে আধমুখ ঘোমটা টেনে বসে থাকা বাচ্চা মেয়েটা এখন সুশিক্ষা অর্জনের সুযোগ পেয়ে কলেজমুখী। আমাদের দেশের মহৎপ্রাণ মনীষীদের প্রচেষ্টাকে সার্থক করতে উদ্যোগী এখন বহু নারী।শিক্ষার সাথে ক্রীড়াঙ্গন, বিজ্ঞান, মহাকাশ গবেষণা সব ক্ষেত্রে নারীর অস্তিত্ত্ব লক্ষ্যনীয়।গত শতকের আগে যখন অ্যাথলেটিকস্, ক্রিকেট টিম,হকি প্রভৃতিতে মহিলাদের প্রাধান্যের বিষয়টি কল্পনা ছাড়া আর কিছু ছিল না, বর্তমানে দাঁড়িয়ে তার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে।তাইতো একটা মীরাবাই চানু আজ আমাদের গর্ব আর অহংকারের আর এক নাম। শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর সার্বিক উন্নতি চোখে পড়ার মতো, উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম স্থানাধিকারীনি এক নারী। সমাজের ভাবধারা বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে কিছুটা মুক্তিলাভ করেছে।তাই পাশে বসা শিক্ষার্থী বা অফিস কলিগ নারী হলে তা আর অবাক করে না আমাদের। সহজাতভাবে সম অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে নারীর সাথে কন্ঠ মেলান বহু পুরুষ।শিল্পে-সাহিত্যে নারী আর কেবল ঘরের কোনে থাকা লাজে রাঙা কনে বউটি নয়,সে এখন মফঃস্বল থেকে শহরে আসা কোন সরকারী অফিসের কর্মচারী। অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে থাকা থেকে একটু একটু করে সময়ের সাথে সাথে শিক্ষার আলোয় এসে পৌঁছান,নিজস্ব মতামতকে গুরুত্ব দিতে শেখা এসব একদিনে সম্ভবপর হয়নি। বহুদিনের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও নিজের পুরানো অবয়বকে ভেঙে নতুন রূপে মেলে ধরার প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে এই অসাধ্য সাধন হয়েছে। যদিও নিজের মর্জিমত জীবন চালানোর ইচ্ছে সব নারীর আয়ত্তের মধ্যে আসেনি। তবুও এক পা এক পা করে সমাজের পূর্ব প্রাচীন প্রথা ভেঙে এগিয়ে চলার এই সূচনা ধীরে ধীরে ক্রমবর্ধমান হয়ে ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত দিগন্তকে উন্মুক্ত করবে এই আশা আমরা করতে পারি। সময়ের সাথে সাথে নারীর অস্তিত্ত্বের বহমানতা তরান্বিত হবে আরও স্বাধীনভাবে, তাঁর ইচ্ছানুযায়ী।তবে কেবল নারীমুক্তি বা নারী স্বাধীনতার জন্যে সোচ্চার হওয়া নয় বরং লিঙ্গের পার্থক্য মিটিয়ে সমাজে আদর্শ মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা সবাইকে সমান ভাবে বিতরণ করতে পারলে এবং এই ভাবধারায় স্বশিক্ষিত হতে পারলেই একবিংশ শতাব্দীর আধুনীকিকরণ সম্ভব হবে।নারী-পুরুষের লিঙ্গভেদে জীবনের পৃথক সমীকরণ এবং সামাজিক যাবতীয় সমস্যা থেকে চিরমুক্তি পাওয়া সম্ভবপর হবে।
অনবদ্য লেখা …..খুব ভালো লাগলো । অনেক শুভেচ্ছা রইলো ।
ভাল লেখা। শব্দের প্রবাহ লেখাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
বেশ ভাল হয়েছে। বাস্তব ছবিটা উঠে এসেছে। অভিনন্দন।