লক ডাউন, ব্যাঙ্ক এবং ভারতীয় অর্থনীতি
কৌটিল্য রায়
2020 । নতুন বছরের প্রথম দিক। সারা বিশ্ব জুড়ে চারদিকে প্রতিবাদ মিছিলে রাস্তায় নেমেছেন
হাজার হাজার মানুষ। ফ্রান্স সহ ইউরোপের অন্যান্য দেশ, লাতিন আমেরিকা জুড়ে গড়ে উঠছে আন্দোলন।
কারণ আর কিছুই নয়। বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা নেমে আসছে। পেনসন এবং সামাজিক সুরক্ষা
অনিশ্চিত। ভয় পাচ্ছে মানুষ। নোবেল বিজয়ী প্রফেসর রিচার্ড থালের নাজ থিওরি নিয়ে কচকচানি শুরু
হয়েছে। আন্দোলন নাকি মন্দাকে আরও ত্বরান্বিত করবে। এদিকে আরেক ধরনের ভয় থেকে
আমাদের দেশে জন্ম নিয়েছে আন্দোলন এবং অস্থিরতা । CAB এবং NRC ইস্যুতে উত্তাল আমাদের দেশ।
ওদিকে অর্থনৈতিক মন্দার ভ্রূকুটি আমাদের দেশেও। ২০১৪ র পরে সর্বোচ্চ হয়েছে খাদ্য শস্যের
দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির হার। ৭.৪ শতাংশ। অটো এবং নির্মাণ শিল্পে ধ্বস নেমেছে। এই দুটি শিল্প প্রচুর
মানুষের রোজগারের বন্দোবস্ত করে।ফলে জি ডি পি নামছে, আরও নামছে। পরিসংখ্যান নিয়ে ছেলেখেলা
চলছে। সরকারি বা বেসরকারি খাতে নতুন বিনিয়োগ নেই। ব্যাঙ্কে ঋণ নিতে আসছে না কেউ। ব্যাঙ্কগুলি
প্রস্তুত হচ্ছে আরেকটি বছরের জন্য। যে বছরে অনুৎপাদক সম্পদ বাড়বে। বাড়বে প্রভিশনিং। লাল হবে
বেশির ভাগ ব্যাঙ্কের নেট প্রফিটের ঘর। এতসব ঘটনার খোঁজ রাখেন নি ভারতবর্ষের সাধারন মানুষ।
ভারতবাসী কোনদিনই দেশের অর্থনীতি নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় নি। বরং তাদের কাছে অনেক বেশি
গুরুত্বপূর্ণ রাম মন্দির, পুলওয়ামা বিস্ফোরণ, বালাকোট এয়ার স্ট্রাইক বা এন আর সি। কেউ ভাবতেই
পারেন নি, অলক্ষ্যে ঘনিয়ে আসছে এক বিরাট বিপদ। যা আগামী কয়েকমাস ছেলেখেলা করবে বিশ্ব
অর্থনীতিকে নিয়ে।
ভারতে প্রথম করোনা পজিটিভ মানুষ পাওয়া যায় কেরালায় ৩০শে জানুয়ারি,২০২০। তারপরে আরও
তিনজনকে পাওয়া যায় ৩রা ফেব্রুয়ারিতে। এঁরা সবাই ছিলেন ছাত্র। চীনের ইউ হান প্রদেশে পড়তে
গিয়েছিলেন। শুরু হয় নতুন অধ্যায়। যার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কেউ। বিপদের কালো মেঘ সবচেয়ে আগে
আন্দাজ করতে পারেন আর্থিক সংস্থাগুলি। পুরো ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় অধ্যায় জুড়ে চলে অর্থনীতি
ভাঙ্গতে থাকার প্রক্রিয়া। মার্চের গোড়ায় এসে তা ভয়াবহ রূপ নেয়। ২রা মার্চ ৯৩৯ পয়েন্ট, ৯ম মার্চ
১৯৪২ পয়েন্ট, ১২ই মার্চ ২৯১৯ পয়েন্ট- মাত্র ৩ দিনে মুম্বাই সেন্সেক্সের পতন ঘটে মোট ৫৮০০
পয়েন্টের। এক দিকে বাড়তে থাকে করোনা রোগীর সংখ্যা। অন্যদিকে তার চেয়ে দ্রুত তালে ভাঙ্গতে থাকে
ভগ্নপ্রায় ভারতীয় অর্থনীতি। চার দিকে কেবল ঝাঁপ ফেলবার আওয়াজ। রেল, বিমান, খনি, কলকারখানা,
বাজার,ধর্মস্থল, ফিল্ম ফেস্টিভাল, বিনোদন স্থল, বিদ্যাস্থান, জি এস এল ভি প্রক্ষেপন, পদ্ম
অ্যাওয়ার্ড- একে একে বন্ধ হতে থাকল সব। কেবল খোলা থাকল হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, পুলিশ,
বিদ্যুৎ সরবরাহ,দমকল, টেলিফোন পরিসেবা এবং ব্যাঙ্ক।
ব্যাঙ্ক। এবং তার কর্মীরা। যারা বারবার প্রমানিত করেছেন, তাদের সহযোগিতা ছাড়া কোন সরকারি
প্রচেষ্টা সফল হওয়া বা আপাতকালিন স্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। জন ধন যোজনা, অটল
পেনসন যোজনা, নোট বন্দী- বারবার সেই এক চিত্র। করোনা আবহাওয়াতেও তার ব্যাতিক্রম ঘটল না।
২৪শে মার্চ জাতির উদ্যেশ্যে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বললেন, “ জান হ্যায় তো জাহান হ্যায়।” ব্যাঙ্ক
কর্মীরা জান বাজি লাগালেন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে রূপায়িত করতে। জান তো শুধু ওষুধে বাঁচে না। বেঁচে
থাকতে গেলে নানা কারনে প্রয়োজন পড়ে অর্থেরও। জাতীয় অর্থনীতিতে সেই অর্থ রূপী অক্সিজেন এর
জোগান যাতে অব্যাহত থাকে, ব্যাঙ্ক কর্মীরা জীবন বিপন্ন করে খোলা রাখলেন ব্যাঙ্কের দরজা। পুরো
লক ডাউন সময়কালে যখন পরিবহন ব্যাবস্থা সম্পূর্ণ স্তব্ধ, সেই দুর্বিষহ সময়কালে বহু বাধা বিপত্তি
অগ্রাহ্য করে জারি থাকল ব্যাঙ্কের পরিষেবা। কি ধরনের ছিল সেই বাধা বিপত্তি? আসছি সেই কথায়।
এক- ঘরে গাড়ি আছে, কিন্তু নিজে চালাতে জানেন না। ড্রাইভার লক ডাউনে দেশের বাড়িতে আটকে গেছেন।
ছোটবেলায় সাইকেল শিখেছিলেন। কিন্তু দোকান বন্ধ। কিনতে পারছেন না। অগত্যা ষোল কিমি পায়ে হেঁটে
ম্যানেজার বাবুকে প্রতিদিন ব্যাঙ্ক খুলতে যেতে হয়েছে। আবার ষোল কিমি পায়ে হেঁটে ফিরতে হয়েছে।
ম্যানেজার বাবু ক্যান্সার রুগী।
দুই- এবার আসি সাধারন কর্মীদের কথায়। প্রতিদিন যাতায়াতে ২০০ কিমি স্কুটার বা বাইক চালিয়ে বহু
কর্মীই ব্যাঙ্কে এসেছেন। তাদের কেউ কেউ এই দীর্ঘ সময় বাইক চালানোর কারনে দুর্ঘটনায় পড়ে
হাসপাতাল পৌঁছেছেন। পিঠ বা কোমরের ব্যাথা শুরু হওয়ার কথা না হয় বাদ দেওয়াই ভাল। প্রতিদিন ৪০
কিমি সাইকেল চালিয়েছেন, এমন কর্মী সঙ্খ্যাও নেহাত কম নয়।
তিন- করোনার মধ্যে আম্ফান বিধ্বস্ত সুন্দরবন এলাকায় টানা ৭-১২ দিন বিদ্যুৎ বা নেট পরিষেবা
ছাড়াই ব্যাঙ্ক কর্মীরা গ্রাহকের দাপট আর হুমকির মোকাবিলা করে পরিষেবা দিয়েছেন। কিভাবে দিয়েছেন?
জেনে আসুন হিঙ্গলগঞ্জ, গোসাবা, সাগর বা বাসন্তীর মানুষদের কাছ থেকে।
চার- টানা ছয় মাস বাড়ি ফিরতে পারেন নি বহু ব্যাঙ্ক কর্মী। কোথায় তারা থেকেছেন, কি খেতে পেয়েছেন –
তা একমাত্র তাঁরাই জানেন। শুধু মুড়ি খেয়ে থেকেছেন সাত দিন, মশারি ছাড়া সারা রাত জেগেছেন মশার কামড়
খেয়ে আবার সকালে ব্যাঙ্কের দরজা খুলেছেন। যারা ভোট নিতে গিয়েছেন কখনও, তারা কি মনে করতে
পারেন ভোটকেন্দ্রে পৌঁছনোর পরে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা? তার চেয়েও খারাপ অবস্থায় টানা দুমাস
কাটিয়েছেন বহু ব্যাঙ্ক কর্মী।
পাঁচ- বাড়ি মেদিনীপুর। পোস্টিং লাল গোলায়। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা মা আর স্ত্রী পুত্র সবাই করোনা
আক্রান্ত। পরিবারটি থেকে সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু গ্রাহকদের কাছ থেকে মুখ ফেরাতে পারেন
নি সেই ব্যাঙ্ক অফিসারটি। পরিষেবা দিয়ে গিয়েছেন গ্রাহকদের।
ছয়- যে কাউনটারে বসে সহকর্মী করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন, সেই কাউনটারে অপর আরেকজন
ব্যাঙ্ক কর্মী গিয়ে বসেছেন পরিষেবা দিতে। জেলা প্রশাসন জানিয়ে দিয়েছেন, কোন অবস্থাতেই ব্যাঙ্ক
বন্ধ রাখা যাবে না।
সাত- সবচেয়ে বড় ধাক্কা দিয়ে গেছে প্রশাসনিক খয়রাতি। ৫০০/১০০০ টাকা বিলি করতে গিয়ে সারা দেশে
অসংখ্য কর্মী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। সংখ্যাটা আনুমানিক বলে আর উল্ল্যেখ করলাম না। কারন
সংখ্যাটা শুনলে আপনি চমকে উঠতে পারেন।
আট- অসংখ্য কুচো রাজনৈতিক নেতা ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছিলেন। রাজনৈতিক প্রতিপত্তি
বিস্তারের হাতিয়ার করেছিলেন ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে দল বেঁধে গোলমাল পাকিয়ে। তাদের চোখ রাঙ্গানি হুমকি
চমকি সামলে পরিষেবা দেওয়া দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল। পুলিশি সাহায্য মেলে না, এসব ক্ষেত্রে। জানেন
নিশ্চয়ই আপনারা।
নয়- সুগার ৪০০। তাতে কি? তুমি যে ব্যাঙ্ক কর্মী।
করোনা হয়েছে? ব্যাঙ্ক থেকে ৩০০ কিমি দূরে বাড়িতে আটকে পড়েছ? কি, দুবার হার্ট এট্যাক? ও কিছু
না। যাও, পুলিশের গাড়িতে করে গিয়ে ব্যাঙ্কের চাবিটা দিয়ে এসো। অন্য কেউ ব্যাঙ্ক খুলবে।
দশ- একবার মহিলা বা শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যাঙ্ক কর্মীদের কথা ভাববেন না? যারা এই স্তব্ধ পরিবহণ
ব্যাবস্থার মধ্যে ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে পৌঁছেছেন। অথচ উচ্চপদস্থরা বাড়িতে বসে ওয়ার্ক ফ্রম হোম
করেছেন। আর সমানে চোটপাট দেখিয়ে গিয়েছেন সাধারন কর্মীদের ওপর যারা প্রানের তোয়াক্কা না করে
কাউনটারে কাউনটারে অসংখ্য গ্রাহকের সংস্পর্শে এসেছেন। সেলুকাস, তুমি সবই দেখেছ। বুঝেছ নিশ্চয়ই
কেন বিচিত্র এই দেশ।
ব্যাঙ্ক কর্মীদের এই প্রচেষ্টা বেশির ভাগ গ্রাহকের নজরে এসেছে। তাঁরা মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার
করেছেন তা। তবে সমাজে এক শ্রেণীর মানুষের উপস্থিতি রয়েছে আবহমান কাল থেকে যাদের চোখে কোন
ভাল জিনিস ধরা পড়ে না। যাদের নিজের কর্মস্থলে কোন দায়িত্ব নেই, তাদের চোখে এসব ধরা না পড়বারই
কথা। কিন্তু সমাজের বেশির ভাগ মানুষ দ্বিধাহীন ভাবে মেনে নিয়েছেন, মানুষের সামান্য যেটুকু ক্রয়
ক্ষমতা এখনও বজায় আছে তার মূলে ব্যাঙ্ক কর্মীরা।
আরেকটা ব্যাপারের উল্ল্যেখ না করে পারছি না। সামান্য কিছু মানুষ আছে, যাদের বেশির ভাগের
রাজনৈতিক পরিচয় আছে, তাদের রাগ-তেজ-ক্ষমতা জাহির করবার জায়গা গুলো সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে
করোনা কালে। কারন সব বন্ধ। একমাত্র খোলা ব্যাঙ্ক। তারা কিন্তু এই দুঃসহ সময়েও ব্যাঙ্কে এসে
নিয়মিত ব্যাঙ্ক কর্মীদের গাল মন্দ করে গেছে। তবে ঐ যে বললাম, এরা সংখ্যায় নগণ্য।
এবার একটু অন্য আলোচনায় আসা যাক। বাঁশি ছেড়ে এবার বাঁশিবাদকের কথায় আসা যাক। এই মুহূর্তে
কেমন অবস্থায় আছে ভারতীয় অর্থনীতি? বাজার অর্থনীতির মূল ভিত্তি হোল টাকার গতিবেগ। অর্থাৎ
একটি নির্দিষ্ট সময়ে টাকা হাতবদল হোল কতবার? যতবার টাকা হাত বদল হবে, ধরে নেওয়া হয়, ততবার
ঐ পরিমাণ টাকা বাজারে সৃষ্টি হোল। টাকা তো আসলে ক্রয়ক্ষমতা। টাকার হাতবদল হওয়া মানেই নতুন
ক্রয় ক্ষমতার সৃষ্টি হওয়া। বিক্রেতার হাতে টাকা পৌঁছল মানে সে এবারে ক্রেতা হওয়ার যোগ্যতা অর্জন
করল। করোনা কালে টাকার এই গতিবেগ অবিশ্বাস্য ভাবে কমে গিয়েছে। বাজার সঙ্কুচিত এবং নিয়ন্ত্রিত
হওয়ার ফলে ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়েই বাজার থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে অর্থনীতিতে
টাকার জোগান কমেছে অত্যন্ত দ্রুত হারে। বিশেষজ্ঞ মহলে এখন জোর আলোচনা চলছে যে ভারতীয়
অর্থনীতিতে টাকার জোগান এই মুহূর্তে এতটাই কমেছে যে তার মূল্যায়নে সরকার একেবারেই আগ্রহী নয়।
অর্থনীতির অবস্থা এতটাই ভয়াবহ। এতটাই কুৎসিত যে আয়নার সামনে দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছে।
এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর উপায়? একটা জনপ্রিয় উপায় হোল বাজারে নতুন নোট ছাপিয়ে জোগান
দেওয়া। এতে কৃত্তিম ভাবে ক্রয় ক্ষমতা তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু তার সাথে তাল মিলিয়ে সম্পদ সৃষ্টি না
করতে পারলে যে কোন সময়ে অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়তে পারে। অর্থ তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে পারে।
কারন অর্থ মানে অন্তর্নিহিত সম্পদ। সেই সম্পদের অভাব দেখা দিলে অর্থ বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে
বাধ্য। ডিপ্রেশন ভয়াবহ আকার ধারন করতে পারে। দ্বিতীয় যে উপায়টি ভাবা হয়, তা হোল সরকারি ব্যায়ের
বৃদ্ধি। যতই আমরা বেসরকারিকরন নিয়ে মাতামাতি করি না কেন, ভারতবর্ষের জিডিপি এখনও ষাট শতাংশ
নির্ভর করে সরকারি ব্যায়ের ওপর। কিন্তু তাহলে তো সরকারি আয় বাড়াতে হয়। আয় বাড়বে কিভাবে?
জিএসটি বা আয়কর কমাতে হবেই। শিল্পগুলোকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য। ঘাটতি বাজেট? নতুন কর বসানোর
সুযোগ কোথায়? তাই, উপায় এখন একটাই। সম্পদ বিক্রি কর। ঘটি বাটি বেচ। সরকারি ক্ষেত্রের
কোম্পানিগুলোকে বেচে আয় বাড়াও। এবং এই একই রাস্তায় হাঁটছে বেসরকারি ক্ষেত্রও। বেঁচে থাকবার
জন্য অঙ্গচ্ছেদ কর।
একটা খুব ভাল ধারনা উঠে এসেছে এই মুহূর্তে। খুঁজলে দেখা যাবে, প্রতিটি সংস্থার কিছু না কিছু ঘুমিয়ে
থাকা সম্পদ রয়েছে। সরকারি হোক বা বেসরকারি হোক। একটা খুব ছোট উদাহরণ দেই। বুঝতে সুবিধা হবে।
ধান কেটে নেওয়ার পরে কৃষক যদি ক্ষেতের আলগুলো দেখেন, কিছু ইঁদুরের গর্ত খুঁজে পাবেন। সেই গর্ত খুঁড়ে যদি দেখেন, অন্তত কেজি পাঁচেক ধান তিনি খুঁজে পাবেন। এই পাঁচ কেজি ধান হোল তাঁর ঘুমিয়ে থাকা বা
লুকিয়ে থাকা সম্পদ যার খোঁজ তিনি কখনও করেন নি। এই ঘুমিয়ে থাকা বা লুকিয়ে থাকা সম্পদগুলোকে
খুঁজে বের করে তাকে বাজারে হাজির করতে হবে। বাজারে তার অর্থনৈতিক মুল্য সৃষ্টি করতে হবে। এবং আয়
বাড়াতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই লুকোনো সম্পদের গুরুত্ত্ব অপরিসীম। এবং সম্ভাবনাময় বিকল্প।
কেন্দ্রীয় সরকার প্রাক্তন আইসিআইসি ব্যাঙ্কের কর্তা শ্রী এম ভি কামাথের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের
এক কমিটি তৈরি করেছেন। যারা ভারতবর্ষের জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রধান ছাব্বিশটি সেক্টরের জন্য নীতি
নির্ধারণ করবেন। আরেকটি কমিটি করা হয়েছে যারা দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নেওয়া অ্যাকাউন্ট
গুলি রিস্ট্রাকচার কিভাবে করা সম্ভব সেটা খতিয়ে দেখবেন। ঠিক এভাবেই ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প এবং
অতি ক্ষুদ্র সংস্থা গুলোর জন্য কি করা যায়, সেটা সরকারকে ভাবতে হবে। অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ ভারতীয়
যারা দরিদ্র তাদের কাছে অর্থনৈতিক সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা দরকার। এই মুহূর্তে
অসঙ্ঘঠিত ক্ষেত্রের জন্য সরকার অন্তত ছয়টি সামাজিক সুরক্ষা স্কিমের রূপরেখা তৈরিতে ব্যাস্ত যার
মধ্যে রয়েছে সামাজিক পেনসন এবং বিমা। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এমন আরও অনেক সামাজিক সুরক্ষা
স্কিমের কথা ভাবা উচিত যা দেশের দুর্বলতর শ্রেণীর মাথার ওপর ছাতার মত সুরক্ষা প্রদানে সক্ষম। এর
জন্য প্রয়োজনে সরকার বাজার থেকে আরও ঋণ গ্রহণ করুক। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ঋণ নিতেও
দ্বিধা করা উচিত নয়। কারন এই মুহূর্তে বাজারে টাকার জোগান বাড়ানোর খুব প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক
সংস্থা গুলো ইতিমধ্যে সাড়ে ছয় বিলিয়ন আমেরিকান ডলারের ঋণ প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছেন। বাজারে
টাকার জোগান বাড়লে স্বাভাবিক ভাবেই ক্রয়ক্ষমতা এবং চাহিদা বাড়বে। যা হয়ত আগামী দিনে
ভারতবর্ষকে এই করোনা জনিত ভয়াবহ ডিপ্রেশনের হাত থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে এই ডিপ্রেশন স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী কালের সবচেয়ে ভয়াবহ ডিপ্রেশন। লক
ডাউনে ভারতবর্ষের প্রায় ১৪ কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। ৪৫ শতাংশ পরিবারের উপার্জন গত বছরের
তুলনায় কমে গেছে। প্রথম সম্পূর্ণ লক ডাউনের ২১ দিনের প্রতিদিন ভারতবর্ষের অর্থনীতি প্রতিদিন
হারিয়েছে ৩২০০০ কোটি টাকা। এই পরিসংখ্যান গুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায়, ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া
কতটা কঠিন। তবু চেষ্টা শুরু হয়েছে। আস্তে আস্তে ছন্দে ফেরবার চেষ্টা করছে দেশীয় অর্থনীতি। সরকার
এবং ব্যাঙ্কগুলির যৌথ প্রচেষ্টায় অর্থনীতিতে অর্থের জোগান বাড়ানোর কাজ শুরু হয়েছে। বেরোজগারির
হার পৌঁছে গিয়েছিল ২৪ শতাংশে। সেখান থেকে বর্তমানে সেই হার কমে এসেছে ৮-৯ শতাংশে। বাজারে আবার
চাহিদা ফিরে আসছে। উল্ল্যেখযোগ্য না হলেও ক্রয়ক্ষমতার উন্নতি হচ্ছে। তবে যে আঘাত নেমে এসেছে
ভারতীয় অর্থনীতির ওপর, তার প্রভাব হয়ত চলবে আগামী দশক অবধি। বাজারের রূপরেখা হয়ত বদলে
যাবে পুরোটাই। বদলাবে সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি। বদলাতে পারে সামাজিক জীবনের মানসিকতা। তাই এই মুহূর্তে
আগামী সময়ের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর অন্য কোন উপায় নেই।
লেখাটি দীর্ঘ হলেও মূল্যবান । ধন্যবাদ।