ডঃ কাননবিহারী গোস্বামী চলে গেলেন অমৃতলোকে।
রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী
আগেই বলে নেয়া ভালো যে শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ডঃ কাননবিহারী গোস্বামীর সঙ্গে আমার কোনো রক্তের বা অন্য কোনো আত্মীয়সূত্রে বা শিক্ষক-ছাত্র বা গুরু-শিষ্য কোনো রকমের সম্পর্কের লেশমাত্র ছিল না। সম্পর্ক ছিল অহৈতুকী শ্রদ্ধার আর প্রীতির।
কাননদার মৃত্যুতে তাঁর প্রায় আশিজন এম ফিল, পি এইচ ডি ও অজস্র ছাত্র ছাত্রীদের মত বর্তমান লেখকও যারপরনাই শোকস্তব্ধ বিমর্ষ এবং অপরিসীমভাবে মাথার উপরের ছাতাহীনের অবস্থায় থেকে যাওয়ার মত।
কাননদার সঙ্গে আমার আলাপ গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাহিত্য সম্মেলনে। তিনি বেশিরভাগ সভায় সভাপতিত্ব করতেন বা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতেন। ২০০৬ – এর পর থেকেই একাধিক অনুষ্ঠানে বর্তমান লেখক সাধারণ বক্তা রূপে হাজির থাকার সৌভাগ্য লাভ করতাম।
একাধিকবার, শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীতে, বিশেষ করে গত ৩রা জুলাই ২০১১ তে ‘ নিউজ টাইম ‘ চ্যানেলে রথযাত্রার দিন আরো কয়েক জন আলোচকের সঙ্গে কাননদাকে মধ্যমণি রেখে প্রায় সারাদিন আলোচনার আসরে উপস্থিত ছিলাম। একদিকে নীলাচলের জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা এবং আয়ুধ নিয়ে রথ এগিয়ে চলছে বা মাহেশের প্রাচীন রথ বা কলকাতার রথ চলছিল আর পাশাপাশি আমাদের আলোচনা বা ব্যাখ্যা চলছিল। মাঝে মাঝেই কিছু সময় বিরতি থাকতো, অর্থাৎ ক্যামেরা ঐ সময়টায় আমাদের ফোকাস করবে না। চা বা কফি পান করা বা দুচারটে কথা নিজেদের মধ্যে বলা চলতো। এরকম একটা বিরতির সময় কাননদা বলেছিলেন – তুমি এখন কী লিখছ?”
আমি উত্তর দিয়েছিলাম – গদাধর পণ্ডিত নিয়ে লিখছি।”
” বাঃ। ” কাননদার মন্তব্য – আজকাল তো কেউ গদাধর নিয়ে লেখে না, আলোচনাও শুনিনা। ধন্যবাদ তোমাকে।”
বিরামের সময় শেষ হলে আবার আলোচনা শুরু হল। শেষ হলে গাড়িতে উঠতে উঠতে কাননদা বলেছিলেন – তোমাকে আমার একটা লেখা পড়াবো। “
সত্যিই কাননদার লেখা একটি প্রবন্ধ ” গৌরলীলামৃত ” প্রথম বাংলা ভাষায় লিখিত চরিতকাব্য, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার ১০৮ বর্ষ ১-৪ সংখ্যা ১৪০৮ । পৃষ্ঠাসংখ্যা ৯৭খ। তিনি জেরক্স করিয়ে, পরে আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন যে, এতে শ্রীগৌরাঙ্গ সঙ্গী শ্রীগদাধর পণ্ডিতের কথা অনেক খানি লেখা আছে। পুরো গ্রন্থটি পাওয়া যায় নি। অনুসন্ধান চলছে। শ্রীচৈতন্য চরিত কাব্যগুলির অর্থাৎ বৃন্দাবনদাস বা কৃষ্ণদাস কবিরাজের অনেক আগে বংশীবদন চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন। তিনি আবার শ্রীচৈতন্যদেব সন্ন্যাসী হবার পর তাঁর মা শচীদেবী আর তাঁর স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ভার বহন করেছিলেন। সেই গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিই :-
” বিজয় গৌরগদাধর হিন্দোলিকা মনোহর কন্দর্পরথের শোভা ধ্বনি।
তাহে করি আরোহণ আরম্ভিলা প্রেমরণ আশে পাশে ভক্তের সাজনি।।”
ভাবা যায়, যিনি অসংখ্য ছাত্র ছাত্রী দের গাইড তিনি কতটা দরদী ছিলেন এই সামান্য লেখকের প্রতি!
শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক কাননবিহারী গোস্বামী জন্মেছিলেন বর্ধমান জেলার শ্রীপাট বাঘনাপাড়া গ্রামে ১৯৩৯ ইং সালের ১২ ই নভেম্বর। তিনি শ্রীচৈতন্যদেবের পার্ষদ বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়ের অধস্তন দ্বাদশ পুরুষ। আবার প্রভু নিত্যানন্দের দ্বিতীয়া পত্নী জাহ্নবার পালিত পুত্র (পূর্বোক্ত বংশীবদনের পৌত্র) – এর দশম উত্তর পুরুষ। অসাধারণ মেধাবী কাননদা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ , পি এইচডি এবং এল এল বি করে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানিত অধ্যাপকের পদে ছিলেন। বিশেষ করে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রীডার প্রফেসর এবং হেড অব দি ডিপার্টমেন্ট ছিলেন প্রায় চব্বিশ বছর। এরপর বর্ধমান, বিদ্যাসাগর, আলিয়া, প্রেসিডেন্সি, বিবেকানন্দ(বেলুড়) বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন। তাঁর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আরও অধ্যাপনা ছাড়াও গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন প্রায় আশীজন ছাত্র ছাত্রীদের।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কাননদার পাণ্ডিত্যের পরিমাপ করা সাধ্যাতীত।
কাননদার নিজে গান গাইতে পারতেনই না, অনেক আসরে তিনি সঙ্গে নিয়ে যেতেন অধ্যাপক শংকর ঘোষ মহাশয়কে। ইনি অধ্যাপনা ছাড়াও সঙ্গীত সাধনা এমনকি “বাদশা” চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন।
আমার সঙ্গে আমার স্ত্রী ভূমিকা ( যাঁকে তিনি ভগ্নী বলে মনে করতেন) থাকলে কাননদা প্রায়ই ঘোষণা করতেন – ভূমিকার কন্ঠে
অধরং মধুরং গানটা দিয়ে আজকের অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হবে।
শ্রীগদাধর পণ্ডিতের শিষ্য বল্লভাচার্যের লেখা গান ভূমিকা গাইতেন:-
” অধরং মধুরং বদনং মধুরং নয়নং মধুরং হসিতং মধুরম্।….”
শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক কাননবিহারী গোস্বামী নিত্য আনন্দময় অমৃতলোকে আমাদের সকলের মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন। তাঁর পরিবারকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা জানা নেই।
কাননদার অমর আত্মা পরম শান্তি লাভ করুন।
(ছবিতে শ্রীনিত্যানন্দ জয়ন্তীতে বক্তব্য রাখছেন সাহিত্যিক শ্রীরাধাকৃষ্ণ গোস্বামী। সভাপতি ডঃ শ্রীকাননবিহারী গোস্বামী।)
আপনাকে ধন্যবাদ। একজন অসাধারণ মানুষের পরিচয় এমন সরস ভাষায় তুলে ধরার জন্য।
ধন্যবাদ ভাই। সুযোগ পেলে সাক্ষাৎ করতে ইচ্ছে আছে।