জন্মদিন
মলয় চৌধুরী
অশোকদের বাড়ি থেকে বেরোতে সন্ধে সাতটা হয়ে গেল। বর্ষার আকাশে জলভরা মেঘের সমাবেশ। কখনো ঝিরঝির, কখনো ঝমঝম বৃষ্টি।
অফিস থেকে তাড়াতাড়িই বেরিয়েছিলাম। একটু কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া হয়ে তারপর অশোকদের বাড়ি পৌঁছতে দেরিই হয়ে গেছিল।
টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যেই বেরোলাম। মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই বাসস্ট্যান্ড। কিন্তু বৃষ্টির জোর বাড়লো। ছাতা দিয়ে তাকে সামলানো যাচ্ছে না। সামনে একটা খোলা বারান্দা দেখতে পেয়ে উঠে পড়লাম।
বেশ পুরনো বাড়ি বোঝা যাচ্ছে। জানালার ফাঁক দিয়ে হাল্কা হলদেটে আলোর আভা। বৃষ্টি আরও জোরে নামলো। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। জলের ছাট লাগছে গায়ে। দেয়ালের সঙ্গে সেঁটে গিয়েও রক্ষে হচ্ছে না। ছাতাটা খুলে সামনের দিকে আড়াল দিলাম। যতটা বাঁচা যায়।
দরজাটা খুলে গেল। বোধ হয় আমার ছাতা খোলার শব্দ পেয়েছে ঘরের লোকজন।
” ভিতরে আসুন “, একটি অল্প বয়সী ছেলের ডাক এল। ইতঃস্তত করছিলাম। এবার ভিতর থেকে কোন বয়স্ক লোকের ডাক এল, ” সংকোচ করবেন না। ভিতরে আসুন। “
জলঝরা ছাতাটা দরজার একপাশে রেখে ভিতরে ঢুকলাম।
ইজিচেয়ারে একজন বৃদ্ধ বসে আছেন। ঘরের দেয়াল ঘেঁষে একটা তক্তপোষ। একপাশে একটি টেবিল। বোঝা গেল ছেলেটি পড়াশোনা করছিল।
ছেলেটি আমাকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল। বসে পড়লাম। বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে নমস্কার করে বললাম, ” আমার নাম রক্তিম বসু। চাকরি করি। অফিস ফেরতা এদিকে এক বন্ধুর বাড়ি এসেছিলাম। পথে এই বৃষ্টির পাল্লায় পড়লাম, আপনাদেরও বিরক্ত করলাম। “
বৃদ্ধ বললেন, ” না না, কিচ্ছু অসুবিধা হয় নি। বাইরের মানুষজন তো তেমন এই ঘরে পা দেয় না! আপনি আসায় তাই খুব ভাল লাগছে। বৃষ্টি এক্ষুনি থামছে না। আপনি ভাল করে বসুন। কিন্তু আপনাকে কি দিয়ে আপ্যায়ন করি! আমার ঘরে আবার চা চলে না। তপু , দেখতো! “
ছেলেটি ভিতরে গেল। এবার আমি অপ্রস্তুত হলাম।
ভদ্রলোক বললেন, ” আমার নাম অমিয় মুখার্জি। বাচ্চাটি আমার নাতি – তপোব্রত। এই আমাদের সংসার। “
“ছেলেটির মা বাবা? “
” নেই। বছর পাঁচেক আগে এক পথ দুর্ঘটনায় তারা দুজনেই চলে গেছে। আমি রিটায়ার্ড স্কুল মাস্টার। এই নাতিকে বুক দিয়ে আগলে বড়ো করছি। “
বলতে বলতে ছেলেটি ঘরে এল। এক হাতে একটি কাচের বাটি ও চামচ, অন্য হাতে জলের গ্লাস। গ্লাসটা টেবিলে রেখে কাচের বাটিটা আমার হাতে দিল তপোব্রত।
” এ সব আবার কেন? “
অমিয়বাবু বললেন, ” আজ তপুর জন্মদিন। বারো বছরে পা দিল। তাই একটু পায়েস করে দিয়েছি। আপনি খান। তপুর কল্যান হবে। “
আমি আপ্লুত। তপোব্রতকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালাম।
পায়েস খেয়ে অফিসের ব্যাগটা খুলে আজকেই কেনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজর্ষি উপন্যাসটা তপোব্রতকে উপহার দিলাম। বইটা এমনভাবে কাজে লাগবে ভাবিনি।
বৃষ্টি ধরে এল। অমিয়বাবুকে বিদায় জানিয়ে আবার আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে উঠে পরলাম।
চোখের কোণদুটো ভিজে উঠলো কি? বুকের মধ্যে কোন আবেগ কি নাড়া দিল? আজকে তো আমারও জন্মদিন!
মা বেঁচে থাকলে দুটো জিনিস এই দিনে আমি অবশ্যই পেতাম – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি বই এবং এক বাটি পায়েস।
মা মারা যাবার পরে প্রতি জন্মদিনে বই আমি ঠিকই কিনি। আর পায়েসটা?
Bhalo legeche
খুব ভালো লাগলো।