প্রবদ্ধঃ প্রসঙ্গ শ্রীকৃষ্ণচরিত্র ও বঙ্কিমচন্দ্র – রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী

প্রসঙ্গ শ্রীকৃষ্ণচরিত্র ও বঙ্কিমচন্দ্র
রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী

Bankim Chandra Chatterjee
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

সবার আগে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ১৮৪ তম জন্মদিনে (জন্ম ২৬ শে জুন ১৮৩৮) অন্তরের গভীর তলদেশ থেকে উৎসারিত শ্রদ্ধাসহ প্রণাম জানাই। সাহিত্য সম্রাটের সারাটা চাকরি জীবনে আঠাশ বার বদলি হতে হয়েছে‌ অর্থাৎ বারবার তল্পিতল্পা গুটিয়ে অস্থায়ী বাসস্থান বদলাতে হয়েছে। অজস্র পারিবারিক কাজের মধ্যেও অজস্র প্রবন্ধ ও চৌদ্দখানা অসামান্য উপন্যাস লেখা কি মাত্র ছাপ্পান্ন বছরের জীবদ্দশায় করা যায়? আমাদের উত্তর, হ্যাঁ তা করা সম্ভব হয়েছিল বলেই না তিনি হয়েছিলেন সারা ভারতবর্ষের নমস্য সাহিত্য সম্রাট।
আমরা তাঁকে সাহিত্য সম্রাটের ভূমিকায় দেখি যখন ‘বন্দে মাতরম্’ গানটি তাঁর ‘ আনন্দ মঠ’ উপন্যাসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো। কেননা এই রচনার আগে সারা ভারতে দেশপ্রীতির পরিপূর্ণ রসে আর কোনো উপন্যাস রচিত , জাতীয় কংগ্রেস গঠিত হবার অনেক আগেই আনন্দ মঠ বঙ্গদেশে এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুবাদ হতে শুরু হয়েছিল। তখন থেকেই সাহিত্য সম্রাটের প্রতি আপামর সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধার আসন পাতা হয়ে গিয়েছিল।
সাহিত্য সম্রাট এক অসাধারণ গ্রন্থ ‘ কৃষ্ণ চরিত্র ‘ রচনার ( প্রথম ভাগ ১৮৮২ এবং সম্পূর্ণ ১৮৯২ – এ প্রকাশিত) পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন – আমি নিজেও কৃষ্ণকে স্বয়ং ভগবান বলিয়া দৃঢ় বিশ্বাস করি; পাশ্চাত্য শিক্ষার পরিণাম আমার এই হইয়াছে যে, আমার সে বিশ্বাস দৃঢ়ীভূত হ ইয়াছে। …..এ গ্রন্থে আমি কেবল মানব চরিত্রেরই সমালোচনা করিব।” (কৃ চ ১ম খ উপক্রমণিকা)

বঙ্কিমচন্দ্র শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাঁকে মানুষ হিসেবেই দেখাতে চেষ্টা করেছেন। রাধাকৃষ্ণের অনন্ত প্রেম লীলার কথা তিনি পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চান নি। তাঁর কাছে শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন শ্রেষ্ঠ যাদব বীর যোদ্ধা। তিনি ছিলেন বিচক্ষণ কূটনীতিক, তাঁর সঙ্গে কোন প্রেমের ঘটনা মহাভারতে এবং মহাভারতের গীতাতেও নেই। এই কৃষ্ণ দ্বারকাবাসী, জন্মস্থান কংসের কারাগার মথুরায়। তাঁর ক্রীড়া ক্ষেত্র হস্তিনাপুর ইন্দ্রপ্রস্থ আর মহা সমরভূমি কুরুক্ষেত্র। বৃন্দাবন ধামের প্রসঙ্গ মানুষ কৃষ্ণে তিনি দেখতে পাননি।
অথচ ২য় খণ্ড ৫ম অধ্যায় কৃষ্ণ চরিত্র গ্রন্থে স্বয়ং সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র মহাভারতের সভা পর্ব থেকে উল্লেখ করেছেন :- “আকৃষ্যমানে বসনে দ্রৌপদ্যা চিন্তিতো হরিঃ।
গোবিন্দ দ্বারকাবাসিন্ কৃষ্ণ গোপীজন প্রিয় !
কৌরবার্ণব মগ্নাং মাং উদ্ধরস জনার্দন …”
অর্থাৎ কুলাঙ্গার দুর্যোধনের নির্দেশে ততোধিক কুলাঙ্গার ভাই দুঃশাসন যখন দ্রৌপদীর বস্ত্র ধরে টানাটানি করছিল তখন কূলবধূ দ্রৌপদী নিজের লজ্জা নিবারণে সাহায্যের জন্য রাজসভার এদিকে ওদিকে আকুল চোখে তাকিয়ে দেখলেন তাঁর নমস্য গুরুজনেরা কেউ কোন কথা না বলে অসংস্কৃত চরিত্রের কুলাঙ্গার দুর্যোধনদের ভয়ে মাথা নিচু করে বসে আছেন। এমনকি তাঁর পতি ধৃতরাষ্ট্র এবং মহাবীর ভিম, অপ্রতিদ্বন্দ্বী ধনুর্ধর অর্জুন সহ ভ্রাতৃসম চার দেবর সবাই নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে হাত কচলাচ্ছেন। নিরূপায় হয়ে দ্রৌপদী শেষ পর্যন্ত ‘ বিপদে মধুসূদন ‘ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করলেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বন্ধু, আজকালকার ‘ বয় ফ্রেন্ড ‘ নন, তাঁর সুহৃদ, যিনি অনুরাগী মাত্র সকলের মঙ্গলকারী সেই অগতির গতি শ্রীকৃষ্ণের স্মরণাপন্ন হলেন। তিনি আকুতি ভরা কন্ঠে ডাকলেন – হে কৃষ্ণ, হে গোবিন্দ, হে দ্বারকাবাসী কৃষ্ণ, হে গোপীজন প্রিয় কৃষ্ণ, আমি কৌরব সাগরে ডুবে যাচ্ছি। আমি নিরূপায়। হে জনার্দন আমার লজ্জা নিবারণের জন্য তুমি আমায় রক্ষা কর।”
বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, ” হে গোপীজন প্রিয় কৃষ্ণ ” কথাটার মধ্যে বৃন্দাবন লীলার স্মরণ মহাভারতে ছিল। বৃন্দাবন লীলা আর শ্রীকৃষ্ণ কখনও আলাদা হন না।
অবশ্য, ব্যক্তি জীবনে বঙ্কিমচন্দ্র একসময় কৃষ্ণলীলার নাটকীয়তায় বিশ্বাস রাখতে চাইতেন না। তাই তিনি সমালোচনায় মুখর হয়ে ‘কৃষ্ণ চরিত্র ‘ রচনা করেছিলেন।
তবুও, বঙ্কিমচন্দ্র এক সময় অক্ষয়চন্দ্র সরকার সম্পাদিত ‘ প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ ‘ সমালোচনায় যাঁরা কৃষ্ণলীলা বিষয়ক কাব্যকে অপবিত্র, অরুচিকর ও অশ্লীল বিবেচনা করেন তাঁদের উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন – যাঁহারা এইরূপ বিবেচনা করেন তাঁহারা নিতান্ত অসারগ্রাহী। যদি কৃষ্ণলীলার এই ব্যাখ্যা হইত , তবে ভারতবর্ষে কৃষ্ণ ভক্তি এবং কৃষ্ণ গীতি কখন এতদিন স্থায়ী হইত না।”
কৃষ্ণ চরিত্র গ্রন্থ সাতটি খণ্ডে প্রায় দুই শ’ পৃষ্ঠায় হরিবংশ, বিষ্ণুপুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবত ও অবশ্যই মহাভারত মহাপুরাণের ইত্যাদি গ্রন্থের সাহায্যে কৃষ্ণ চরিত্র বর্ণনা, সমালোচনা ও মূল্যায়ন করেছেন। এক কথায় এক অপূর্ব কৃষ্ণ চরিত্র রচনা করে পাঠকদের এক অমূল্য সম্পদ দান করে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অমর হয়ে আছেন, যেমনটা অন্যান্য গ্রন্থ , বিশেষ করে বন্দে মাতরম্ গান লিখে অমর হয়ে রয়েছেন।
ব্যক্তিজীবনে তিনি কখনও শ্রীকৃষ্ণের নাটকীয়তা পছন্দ করতেন না, একথা যেমন সত্যি তেমনই তিনি একবার কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের কাছে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারেন নি বা চান নি। সেবার নিজ কন্যা শরৎকুমারীর প্রথম সন্তানের অসুস্থতায় মুমূর্ষু অবস্থায় ডাক্তার বদ্যি ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলে বঙ্কিমচন্দ্র পারিবারিক শ্রীশ্রীরাধাবল্লভের চরণে লুটিয়ে পড়েছেন। তিনি সম্ভবত, প্রথমবার ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন – প্রতিজ্ঞা করলেন, তাঁর কৃপা না পাওয়া পর্যন্ত তিনি মন্দির ছেড়ে উঠবেন না। জানা যায়, ঐ বিগ্রহের চরণামৃত ছোঁয়ার পর তাঁর দৌহিত্র সুস্থ হয়ে উঠেছিল অর্থাৎ বঙ্কিমচন্দ্র অলৌকিক ভাবেই শ্রীকৃষ্ণের কৃপা পেয়েছিলেন। সেই থেকেই লেখক তাঁর জীবন ধারা বদলে নিয়েছিলেন।

7 thoughts on “প্রবদ্ধঃ প্রসঙ্গ শ্রীকৃষ্ণচরিত্র ও বঙ্কিমচন্দ্র – রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী

  1. বাহ্, খুব ভালো লাগলো।যথেষ্ট সমৃদ্ধ হলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *