মুক্তগদ্যঃ সাহিত্যের সম্রাটের চোখে খাঁটি মানুষ – ভূমিকা গোস্বামী

সাহিত্যের সম্রাটের চোখে খাঁটি মানুষ
ভূমিকা গোস্বামী

খাঁটি মানুষ কেমন হবে তার একটা আন্দাজ দিয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র।
আপনারাও হয়তো প্রায়ই আমার মত মানুষের মতো দেখতেদের মুখোমুখি হন। ভাবেন মানুষের মতো দেখতে হলেও এরা মানুষ নয়।
মনুষ্যত্ব মানুষের ধর্ম। এইগুণ যার নেই তাকে মানুষ বলা যাবে না। পশু পাখি এরা তাদের ধর্ম নিয়েই জন্মায়। সমস্যা হল, মানুষ তার ধর্ম নিয়ে জন্মায় না। মানুষ হয়ে উঠতে হয়।শাস্ত্রীয় ভাষায়- ধর্মেণ হীনাঃ পশুভিঃ সমানাঃ । মনুষ্যত্ব নামে যে গুণ তা না থাকলে তাকে মানুষ বলা যায় না। সে পশু সমান।
মনুষ্যত্ব ধর্মের পাঁচটি লক্ষণ হ’ল — (১)চুরি না করা ,
কেবল পরের জিনিস না বলে নেওয়াকেই চুরি বলে না। ভারতীয় দর্শনে ঋণ শোধ না করলেও চুরি করা হয়।
মানুষ পাঁচটি ঋণ মাথায় নিয়ে সংসারে আসে। ঋষি ঋণ, দেব ঋণ, ভূত ঋণ , পিতৃমাতৃ ঋণ ও নৃ ঋণ।এই সব ঋণ শোধ না করলেও সে চোর।
আমরা আমাদের কতটুকু অধিকার তার প্রতি সজাগ হতে চেষ্টা করি। কিন্তু ততটা সজাগ আমাদের কর্তব্যের ক্ষেত্রে হ ই না।
নৃ ঋণ -অর্থাৎ সমাজের কাছে আমি ঋণী। বাবা মা , মনীষী। যাঁরা আমাদের সংস্কৃতি দিয়েছেন, তাঁদের কাছে ঋণী।
দেবতাদের কাছে ঋণী – এমন কিছু আননোন ফ্যাক্টর আছে যিনি কেমন সব ঠিক করে দেন সেই শক্তিকেই আমরা ঈশ্বরের করুণা বলি। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা।
ভূত ঋণ হল – পশু পাখি ও ইতর প্রাণীর প্রতি ঋণ। আমাদের অজান্তেই এরা আমাদের জন্য কম পরিশ্রম করে না এরা না থাকলে আমরা বাঁচতে পারতাম না। তাদের যত্ন নেওয়া। সব ঋণ যদি পরিশোধ করতে নাও পারি অন্তত ঋণের বোধটা যেন আমাদের থাকে।
(২) শুচি থাকা , অন্তর ও বাইরের শুচি।
(৩) হিংসা না করা অর্থাৎ সকলকে ভালবাসা, শ্রদ্ধা করা ।
(৪) সংযম-
অর্থাৎ -ইন্দ্রিয় ও রিপুর বশে না থেকে নিজের বশেই ইন্দ্রিয় ও রিপুকে রাখা।
(৫) সত্য।
সত্যের ভিতরে সব ই পড়ে। যে পাঁচটি গুণের কথা বলা হল , সবই সত্যের মধ্যে আছে। সত্য পালন করছি মানে জীবনটার ভিতর বাহির এক রকম। যা চিন্তা করি তাই বলি। কিন্তু ভাবছি এক , করছি আরএক– এরই নাম অসত্য। এই অসত্যেই মানুষের জীবন খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়। জীবনের integration নষ্ট হয়ে যায়। সত্যের চেয়ে সুন্দর আর কোন কিছু নেই।
এবারে মূল কথায় আসি। মানুষ হওয়ার এই পাঁচটি গুণ অর্জন করতে হয়। নিজের ভেতরে অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে। বিদ্যান , বুদ্ধিমান , নাম , যশ, প্রতিভা ধন সম্পদ এগুলো মনুষ্যত্ব নয়। মনুষ্যত্বের পাঁচটি গুণ যার আছে তাকেই আমরা মানুষ বলতে পারি।
ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র বলছেন- খাঁটি মানুষের বৃত্তি চার রকমের। ১) শারীরিকি ২)জ্ঞানার্জনী ৩) কার্যকারিণী ৪) চিত্তরঞ্জিনী।
১) শারীরিক বৃত্তি তে তিনি দেহের পুষ্টি ব্যায়ামাদির অনুশীলন করতে বলেছেন। শরীর সুস্থ না হলে কোন বড় কাজই করা যায় না। অতএব নীরোগ স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ নজর দিতে বলেছেন।
২) জ্ঞানার্জনী বৃত্তিতে তিনি বলেছেন – জ্ঞান ছাড়া ঈশ্বর কে জানা যায় না। তিনি স্কুল কলেজের শিক্ষায় শিক্ষিতকেই শুধুমাত্র শিক্ষিত বলেন নি। তাঁর কথায়–”যে লেখাপড়া জানে না তাহাকেই মূর্খ বলিও না। আর যে লেখাপড়া করিয়াছে তাহাকেই জ্ঞানী বলিও না। জ্ঞান পুস্তিকা পাঠ ভিন্ন অন্য প্রকারেও উপার্জন হইতে পারে। জ্ঞানার্জনী বৃত্তির অনুশীলন বিদ্যালয় ভিন্ন অন্যত্রও হইতে পারে।আমাদের দেশের প্রাচীন স্ত্রী লোকেরা ইহার উত্তম উদাহরণ স্থল। তাঁহারা প্রায় কেহই লেখাপড়া তেমন জানিতেন না। কিন্তু তাঁহাদের মত ধার্মিকও পৃথিবীতে বিরল। তাঁহারা নিত্য কথকতা শুনিতেন।”
তিনি বলেছেন- বিজ্ঞানচর্চা এবং সাহিত্য চর্চা দুটোরই প্রয়োজন সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে। যে কোন একটির অভাব হলে অর্ধেক মানুষ হ ওয়া যায়। সম্পূর্ণ মানুষ হওয়ার জন্য সম্পূর্ণ জ্ঞান চাই। শুধুমাত্র জ্ঞান হলেও হবে না , তার সঠিক ব্যবহার জানা চাই। এখানে তিনি একটি গল্পের উপস্থাপনা করেছেন।
একজন ইংরেজ একটি বাগান কিনেছেন। একদিন তার মালি তাকে একটি নারকোল এনে দিল। ইংরেজ ভদ্রলোক ছোবড়া খেয়ে বলল –এটি সুস্বাদু নয়। মালি বলল- সাহেব এর ছোবড়া নয় আটিটি খেতে হয়।
পরে একদিন মালি আম নিয়ে এল। ইংরেজ ভদ্রলোক মালির আগের বারের কথা অনুযায়ী ছোবড়া ফেলে আটিটি খেল। এটাও রসাল মনে হল না। মালি তখন শেখাল- কেবল খোসাটা ছাড়িয়ে ছুড়ি দিয়ে শাঁসটা কেটে খেতে হয়। সাহেব সে কথাটা মনে রাখল ।
এরপর বাগান থেকে এল ওল। সাহেব খোসাটা ছাড়িয়ে কেটে খেয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল। শেষে মালিকে মারধর করে জলের দামে বাগানটিকে বেচে দিল।
সেই রকম অনেকের মানসক্ষেত্র এই বাগানের মত ফুলে ফলে পরিপূর্ণ তবে মালিকের লাভ হয় না। কারণ তিনি ছোবড়ার জায়গায় আটি , আর আটির জায়গায় ছোবড়া খেয়ে বসেন। এ রকম জ্ঞান বিড়ম্বনা মাত্র।
একটি ঘাস আর একটি বটবৃক্ষ একই উদ্ভিদ হয়েও এক নয়। বৃক্ষ যেমন শাখা-প্রশাখা, কাণ্ড , ফুল ফল নিয়ে সম্পূর্ণ , তেমনি যে মানুষের সমস্ত বৃত্তিগুলি পরিণত হয় সে-ই সম্পূর্ণ
খাঁটি মানুষ।
অনুশীলনের মধ্যে দিয়েই মানুষ তার বৃত্তিগুলি পরিণত করতে পারে। কৃষক যেমন কর্ষণ করে প্রাণদায়ী ধান গম উৎপন্ন করে, তেমনি বৃত্তিগুলি বার বার অনুশীলনের ফলে মানুষ খাঁটি মানুষ হয়ে গড়ে ওঠে।

4 thoughts on “মুক্তগদ্যঃ সাহিত্যের সম্রাটের চোখে খাঁটি মানুষ – ভূমিকা গোস্বামী

  1. দারুণ লেখা । সমৃদ্ধ হলাম । খুব ভালো লাগলো ।

  2. খুব ভালো লাগল, লেখিকাকে আমার প্রণাম জানাই…🙏🙂

Leave a Reply to PRABIR GANGULY Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *