মুক্তগদ্যঃ ওকল্যান্ড সেমেটরি – শিখা কর্মকার (আটলান্টা, জর্জিয়া)

ওকল্যান্ড সেমেটরি
শিখা কর্মকার

উচ্ছল, দুরন্ত, হুড়মুড় করে বাড়তে থাকা আটলান্টা চেয়েও দ্যাখেনা ওকল্যান্ড সেমেটরির এখানে সেখানে প্রস্ফুটিত হচ্ছে শান্ত কুঁড়িগুলি । রোদে গা এলিয়ে শুয়ে থাকে গ্রেভইয়ার্ড, বুকভরা মন খারাপের কাহিনী নিয়ে। তার শীতল শরীরের এখানে ওখানে ফুটে ওঠে গুচ্ছ গুচ্ছ ড্যাফোডিল। একেবারে মানায়না তাদের উজ্জ্বল সুন্দর হাসি এই ছাতাপড়া সিমেন্টের ব্লকে, হেডস্টোনে, শোকার্ত পরির পেটের ভাঁজে, নীরব বেঞ্চের ছায়ায়। এখানে এলে দর্শনার্থীরাও কি পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের মত ধীর, স্থির হয়ে যায়, শোকের অভিশাপে হয়ে পড়ে স্থাণুবৎ, নির্জীব ? নাকি স্মৃতি এসে ভারি এক চাদর বিছিয়ে দেয় তাদের মনে?

তবু পাকে লাল বেরিগুলি, শত শত, হাজার হাজার, ফাটলের ফাঁকে বড় হয়ে ওঠা আগাছার মত, ডাকে পাখি, কাঠবেড়ালি, ইঁদুর ও কিছু সর্বস্বান্ত মানুষের খিধেমাখা পেটগুলিকে । সেমেটরি জানে অগুন্তি মানুষ আসে এইখানে, যারা গৃহহীন, আশাহীন, কাটিয়ে যেতে যতটুকু সময় পারে। তখন আরও বেশি নীল হয়ে আভা ছড়ায় আকাশ এই শেষ হয়ে যাওয়া মাসের দিনটিতে । এজেলিয়াতে, পেয়ারে, কুঁড়ি আসে ঝেঁপে। কিছু নাম না জানা গাছ সটান বেড়ে ওঠা বাচ্চাদের মত মাথায় বড় হয়ে গিয়ে গোলাপি ফুলে ভরে থাকে ।

জ্যাজ মিউজিকের শব্দ শুষে নেয় আটলান্টার বিশাল ডাউনটাউন, তার কাঁচের শততল, তার উদাস বাদামি ঘাস। হাঁটতে বের হয় কেউ কেউ দিন ভালো বলে, যতই পার হয় পথ, ছবি আঁকা দেওয়াল দুধারের, বেল্টলাইন, ট্রেনলাইন, গলফের মাঠের সবুজ বেড়া, তবু পথের শেষ প্রান্তের ও দিগন্তের মুখ ঝাপসাই থেকে যায় ।
যোগাযোগ রাখবে ব’লে কেউ কেউ নিয়ে রাখে পুরো নাম, বাড়ির ও ই-মেলের ঠিকানা, লিঙ্কড-ইন, হোয়াটস-অ্যাপের ম্যাজিক্যাল নাম্বার। হাতের মুঠোয় ভরা থাকে ফোন, জিয়ন-কাঠি শুদ্ধ। তবু মধ্যরাতে ইথারে ভাসতে থাকা কান্নায় ভেঙ্গে পড়া গলায় কেউ ডায়াল করতে গিয়েও থেমে যায় । তার দ্বিধাটুকু না বুঝেই বিশাল চাঁদ উঠে নির্লজ্জের মত জ্যোৎস্না ছড়ায় ।
হয়ত দেখা হবে কোনদিন, সে ভাবে। কিন্তু ভুল স্বপ্নেও কেউ ফেরেনা যারা চলে গেছে একদিন ‘আসছি’ বলে। পথের খালে জমা বৃষ্টিজলের মত টলটল করে ফেলে আসা দিন। কে কে থাকল তবে প্রিয়জন বলতে তার, সে মনে করার চেষ্টা করে। যোগাযোগ হলে পরে, আনন্দে গলে গিয়ে কে কে ফোন তুললে নহাজার মাইল দূর থেকে উষ্ণতায় বুক ভরে দিতে পারে একঝলকেই, সেইসব মুখও ঝাপসা হয়ে আসে। যত রোদের আঁচ নিভে আসে, একটা দুটো করে রবিন আর কার্ডিনাল পাখি আসে খুব কাছে, দু চোখে প্রশ্নচিহ্ন নিয়ে, বাতাসে মাথা নাড়ে লিলিরা। অচেনা এক মধুর গন্ধে ভরে থাকে উদাস বিকেল। বেল বাজে বেল-টাওয়ারে । অরগ্যানের সুর ভাসে কাছাকাছি কোথাও । ফিরে আসার পথে, দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা ফুলে গা ভরে ওঠা ম্যাগনোলিয়াগাছ নিঃশব্দে বলে ওঠে, “একবার এলে, কত ভালো লাগলো । সময় সুযোগ পেলে, আবার এসো । আমি পথ চেয়ে থাকবো”।

2 thoughts on “মুক্তগদ্যঃ ওকল্যান্ড সেমেটরি – শিখা কর্মকার (আটলান্টা, জর্জিয়া)

  1. ভালো লাগলো। পরবর্তীতে অপেক্ষায় রইলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *