পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য চলে গেলেন – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য চলে গেলেন
রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

শ্রদ্ধেয় কবি সাহিত্যিক স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং চাকরি সূত্রে একজন দক্ষ পরিসংখ্যানবিদ সুদর্শন একশো বছর বয়েসেও নিজের ব্যক্তিগত কাজে পারদর্শী মাত্র একশো বছর সাত মাস তেইশ দিন এই মাটি জল ভরা পৃথিবীতে থেকেছেন।
তাঁর এই জীবন অবসানে তাঁর প্রায় তিরানব্বুই বছরের স্ত্রী কবিতা দেবী অস্ফুট স্বরে স্বামীর নিথর নিস্পন্দ নির্বাক দেহটা ধরে কী যেন বলছিলেন। স্বাস্থ্য বিধি মেনে স্থানীয় কাউন্সিলর ও এলাকার বিধায়ক এবং আত্মীয় পরিজন আমরা অনেকেই উপস্থিত ছিলাম। ফলে তিনি সংযত হয়ে কাঁদছিলেন। অস্ফুটে বলার কারণটা সম্ভবত, তাই। কান পেতে শুনলাম, তিনি বলছিলেন – তুমি চলে গেলে! আমায় সঙ্গে নিয়ে যেতে পারলে না?”
তাঁরা একসাথে সাতশট্টি বছর ধরে চলেছেন । সত্যিই সাথীহারার ব্যথায় তিনি হয়েছিলেন শোকস্তব্ধ। তাতে আমাদের, সমস্ত ভীড় করা মানুষদের চোখের কোনায় বিচ্ছেদ ব্যথায় কমবেশি অশ্রু উঁকি দিয়েছে।
পূর্ণেন্দু প্রসাদ আদতে ছিলেন কবি। তাঁর স্ত্রীর মুখে নিজের জীবন সঙ্গীর একটি কবিতা প্রায়ই শোনা যেত :-

“অনেক সুন্দর আছে পৃথিবীতে, তবু আমি দু’চোখ ফেরাই
কেবল তোমার দিকে। অনেক সুরেলা কন্ঠ মৃদু রোশনাই
হিমেল বাতাসে ঢালে, তবু আমি তোমারি ডাকের প্রতীক্ষায়
কান পেতে থাকি আর তোমাকেই ডাকি শুধু প্রাণের কানায়।…” (১৯৫৬ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘তৃতীয় নয়ন’ কাব্যগ্রন্থ থেকে ‘ভালবাসি’ কবিতার প্রথম স্তবক)

দ্বিতীয় স্তবকটিও কবিপত্নী আধো লাজে নিমীলিত চোখে মাথা নীচু করে আবৃত্তি করতেন :-

“একি প্রেম ? এই অন্ধ পক্ষপাত যদি প্রেম, যদি ভালোবাসা,
এই ভালো, এই বেশ ভালো তবে। উদয়ের সূর্য ও পূর্বাশা
এই অন্ধ পক্ষপাতে খোঁজে আর নিয়তির মতো ভালোবেসে
বাষ্প ওড়ে, মেঘ ঘামে, হিম গলে, নদী নামে একক উদ্দেশে।….” (ঐ ২য় স্তবক)

আন্তরিক কবি পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য এই কবিতার শেষ এবং অষ্টম স্তবকে লিখেছিলেন :-

” আমি নেই, আমি নেই, তোমাকেই বারবার আমাতে জাগাই
তোমার ই ঢেউ-এর ছন্দ, তোমারি আনন্দ আর তোমার কান্নাই।
তুমি নেই, তুমি নেই, তুমিও তো আমি হয়ে ওঠ, আছে এই
সমুদ্র ই, ভালোবাসা তার নাম, ভালোবাসি ভালোবাসাকেই।”
(ঐ, শেষ ও ৮ম স্তবক)

কবিকে নিয়ে, তাঁর ভাব, ভাষা ব্যবহার, সাবলীল ছন্দ প্রয়োগ ইত্যাদি বিভিন্ন দিক নিয়ে অজস্র লেখা যায়। তাঁর রাজনৈতিক চেতনার উদয়কাল, প্রতিপক্ষ বৃটিশ সরকারের জেলের কক্ষে বসে বিএ পরীক্ষার প্রস্তুতি, নিরপেক্ষতা অথচ নানান নামের এক ঈশ্বর ও আধ্যাত্মিক চেতনায় সমৃদ্ধ অজস্র রচনা সমূহ নিয়ে বিভিন্ন দিক থেকে স্মরণ করা ও আলোচনা করার অনেক প্রয়োজন, এমনকি তাঁর জীবনের কথা লেখার জন্য বিভিন্ন জন আশা প্রকাশ করেছেন। জানিনা, কতটা বর্তমান লেখকের সাধ্যে কুলোবে।

প্রয়াত কবিকে প্রণাম জানাই। কবিপত্নী মা শ্রীমতী কবিতা ভট্টাচার্যের প্রতি থাকছে শ্রদ্ধা সহ প্রণাম। তাঁকে ও তাঁর দুই পুত্র, তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানদের সান্ত্বনা দেবার ভাষা আমার জানা নেই, তাঁদের সকলকে জানাই অফুরন্ত ভালোবাসা। দুই ভাইয়ের একমাত্র জ্যেষ্ঠা ভগ্নী ( কবিকন্যা প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে আমায় সহ্য করে চলেছেন) তাঁকে এবং কবির স্বপ্নের একমাত্র দোহিত্রী ও দুই দৌহিত্র সকলকে দিতে চাই শীতল সান্ত্বনা আর অকৃত্রিম স্নেহ।
জানি, তোমরা মেনে নেবে, কবি শুনেছেন ‘ বন্দরে জাহাজের ডাক ‘।

7 thoughts on “পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য চলে গেলেন – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

  1. “বিদায়কালে কী বল নাই, সে কি রয়ে গেল গো সিক্ত যুঁথীর গন্ধবেদনে?”

  2. বড়ই মর্মস্পর্শী। আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই ।

  3. এমন মানুষের সান্নিধ্য পাওয়া সত্যিই খুবই মূল্যবান উপহার।
    আমার শ্রদ্ধা জানাই 🙏

    1. খুব ভালো লাগলো। এমন মানুষ তো আর এখন পাওয়া যায় না। কবিকে আমার প্রণাম জানাই।

      1. আমার দাদা, লোককবি ও গায়ক জালাল উদ্দীন খাঁর বন্ধু ছিলেন কবি যতীন্দ্র প্রসাদ ভট্টাচার্য। সে সুবাদে আমার দাদা ও বাবা (কবি খান মো. আবদুল হাকিম ), এ দুজনের সাথেই পূর্ণেন্দু কাকার পত্র যোগাযোগ ছিল। কাকার দু একটি চিঠি এখনো আমাদের কাছে আছে। একটি চিঠি তার বই জালাল গীতিকা সমগ্রতে ছাপা হয়েছে। আব্বা ও দাদার কাছে সারা বাংলা সাহিত্যমেলার পত্রিকাগুলো তিনি পাঠাতেন, যা আমার ছোট বেলায় দেখেছি। আপনার নামটাও আমার জানা, কারণ আপনার লেখা পড়েছি, সম্ভবত ঠিকানা ছিল ২৮ মান্নাপাড়া রোড।
        আমার আব্বা দীর্ঘদিন আগেই প্রয়াত। আব্বার মৃত্যু সংবাদ আমি ৭৮ সনে চিঠি লিখে কাকাকে জানিয়েছিলাম। পূর্ণেন্দু কাকা এতদিন বেঁচে ছিলেন তা জানতাম না, তবে কিছুদিন আগে তা কোথাও চোখে পড়েছে। আপনি যোগাযোগ রাখলে খুশি হব। আপনাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের জন্য অনেক শুভকামনা। কাকীমাকে প্রণাম। ড. গোলাম মোরশেদ খান , বনানী ডি ও এইচ এস, ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *