ছোটগল্পঃ একটা বউ চাই – রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী

একটা বউ চাই
রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী

সুজন ব্যাঙ্কের টিফিনের সময় বন্ধ দরজার একটু ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল। পকেটে পেনসনের টাকা। প্রতি দিন জিনিস পত্রের দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই। তবু সংসার চলে যাবে। কেননা সে একা, অকৃতদার, রামকৃষ্ণ মিশনে ছোট বেলা থেকে দুঃস্থ আর অনাথ হিসেবে মানুষ হয়েছে, তার তিন কুলে কেউ নেই। অনেক দিন ধরে সঙ্গে আছে কাজের ছেলেটা মনু। কত আর খরচ ! তাছাড়া দুমাস গেলে ডি এ বাড়বে। হ্যাঁ, যারা এই করোনা-কভিডের আতঙ্ক ভ্রূক্ষেপ না করে ট্রেন বাস চলতেই অফিস কাছারি কারখানায় গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছে আসছে তারা ডি এ বাড়লে যা পাবে সুজনরা পাবে তার অর্ধেক। তবু চলে যাবে অনায়াসেই। যারা কিছুই পায়না, রুটি রুজির উপায় নেই তাদের দুএক জনকে প্রয়োজনে সহযোগিতাও করা যাবে।
সুজন বাজারে ঢুকল। প্রায় সব বন্ধ। দুপুরের খাওয়া দাওয়া করতে যে যার বাড়ি চলে গেছে। কারোর দোকানে সবজির ঝুড়িগুলো ওল্টানো, কেউবা বস্তা দিয়ে আনাজ বা অন্য পসরা ঢেকে ইট চাপা দিয়ে চলে গেছে। কোথা থেকে ছুটে এল কলম্বাস, না ইতিহাসের নয়, পুরনো মাছ বিক্রেতা – দাদু মাছ নেবেন ? হাফ কিলো আছে। আপনি আসবেন বলেছিলেন তাই বরফ দিয়ে রেখেছি, ড্রেস করা আছে।”
— না, কলম্বাস। বড্ডো দাম !”
সকালের দিকে সুজন দেখে গেছে বাজার কেনাকাটায় গমগম করছিল। তখনই কলম্বাস চেঁচিয়ে বলেছিল – দাদু, ভালো চিংড়ি আছে, আপনার জন্য রেখে দেবো।”
সেই কলম্বাস মাছগুলো ওজন করতেই সুজন জিজ্ঞেস করল — কত দেবরে ?”
— দেড়শ।”
—- বড্ড দাম ! চিংড়ি মাছ তো জলের পোকা।”
—- সব মাছই তো জলে চাষ হয়। আকাশে তো মাছের চাষ এখনো শুরুই হয়নি –“
সুজন ধমক দেয় — অনেক কিছু বুঝতে শিখেছিস ! “

সুজন সময় দেখার জন্য বাঁ হাতের কব্জির দিকে তাকালো, নাঃ কব্জিতে করোনার ভয়ে অনেক দিন, তা প্রায় ন’ মাস হল ঘড়ি আঙুলের আংটি পরা আর হয়না। আশপাশের দোকানের দিকে তাকিয়ে দেখল যদি সময়টা দেখা যায়। অফিসের লোকেরা মোবাইল ফোন দিয়ছিল। সেটা ব্যবহার করা হয়না তেমন। সুজন পা চালিয়ে বাড়ির দিকে ফিরতে লাগলো, বিকেলে আসবেন প্রতিদিনকার মত কয়েকজন তারই মতন রিটায়ার্ড মানুষ জন, তাঁরা কেউ একসময় ছিলেন আই পি এস, ডব্লিউ বি সি এস অফিসার, কেউবা কোনও ব্যাঙ্কের অফিসার থেকে ক্লার্ক বা পিওন। তাঁদের জন্য চিনি ছাড়া, চিনি দিয়ে দুধ ছাড়া, চিনি দুধ দিয়ে গোল্ডেন চা বানাতে বানাতে মনু প্রায়ই বলে থাকে – সব কজন যেন ফিউজ বালব।” ও ফিউজড্ বলতে পারে না। সুজন একদিন শুনে ফেলেছিল। রাগ দেখিয়ে চেপে ধরতেই বলেছিল – বলবো না! কেউ আমাকে একটা ছোটমোট চাকরি দিতে পারেন না। বলেন ওঁদের নাকি আর ক্ষমতা নেই। জিরো পাওয়ার আর হাজার পাওয়ারের ফিউজ বালবের কোন দাম নেই।”
— ও দাদু কী করেছ ! অবেলায় চিংড়ি এনেছ !”
কখন বাড়ি চলে এসেছে তা সুজন খেয়াল করতে পারে নি। মনুর কথায় বাস্তবে ফিরে এসে ওর হাতে মাছের পুঁটলিটা দিয়ে বলে — এখন ফ্রীজে তুলে রাখ। ওবলায় যা করার করবি। জামা কাপড়গুলো স্নানঘরে রেখে হাত মুখে জল দিয়ে আসছি। টেবিলে খাবার সাজাতে থাক। তাড়াতাড়ি তৈরি হতে হবে।”
— কেন গো দাদু ? তোমার আবার এই বয়েসে তাড়া কেন ? তুমি তো বিয়ে থা করোনি যে তোমার মেয়ের শ্বশুর বা ছেলের শ্বাশুড়ী আসবে। অত তাড়া না করে শান্তি মত খেয়ে নাও।”
একটু থেমে আবার বলে — তোমার হলে আমি বসবো, তারপর সাফসুতরো করতে করতে তোমাদের নিত্যকার মিটিং শুরু হবে। তার জন্য আবার সব টুল কাঠের চেয়ার স্যানিটাইজ করে রাখতে হবে। না হলে ঐ বাবুরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে চলে যাবেন।”
প্রতিদিনকার মত অকৃতদার সুজন খেতে খেতে শুনতে পেলেন — সুজনভাই আছো নাকি ? ও দিকটা খুলে দিতে বলো। আমি বসি ততক্ষণ তুমি খেয়ে নাও।”

বিকেলের আড্ডায় মুখে মাস্ক পরে সোস্যাল ডিসট্যান্স মেনটেন করে প্রায় ঘন্টা দেড়েক আড্ডা দিলেন ও পাড়ার ফনীবাবু, যিনি সদ্য দীক্ষা নিয়েছেন এক স্বনামধন্য সাধুবাবার কাছ থেকে। ছিলেন এ পাড়ার বেণীবাবু, যিনি ধর্ম টর্ম একদম মানেন না। ছিলেন হরিহর বাবু, যিনি সম্প্রতি ঘটকালি করতে বেশি ব্যস্ত। সেই হরিহর বাবু হঠাৎ সকলের সামনে একটা পুরণো প্রশ্নে সুজনকে যেন বেকায়দায় ফেলে দিল — আচ্ছা সুজনবাবু, আপনি তো আর বিয়ে করলেন না ! এত টাকা পেনসনের, খাবে কে ?”
এসময় সুজন বাবুর খাস সহযোগী মনু এসেছিল চা দিতে। হরিহর বাবুর কথায় সে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো — ঠিক বলেছেন হরিহর দাদু। আমাদের দাদুর বিয়ে হলে আমি একটা দিদিমা পাবো। ব্যস, আমার আর রান্না করতে হবেনা, শুধু এটা সেটা এগিয়ে দেব।”
সুজন বাবু কটমট করে ওর দিকে তাকিয়ে দেখলেন, মনে হল ছেলেটা বেশ বেশি কথা বলছে। তিনি ওর কথায় উত্তর না দিয়ে হরিহর বাবুকে বললেন — ক’দিন আর বাঁচবো। টুপ করে একসময় ঝরে যাব। বিধবা স্ত্রীকে কে দেখবে ?”
“কেন, আপনি মরে গেলেও” — হরিহরবাবু তাঁর ফোকলা দাঁত বার করে হে হে করে হেসে বললেন — সুজন বাবু, আপনি যদি মরেও যান আপনার পেনসনতো মরবে না।”
সুজন মনুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর, হরিহর বাবুকে হাসতে হাসতেই বলতে লাগলেন – আপনার হাতে কোন পাত্রী আছেন ? বেশ সুন্দরী ?”
” কেন থাকবে না ?” সোৎসাহে হরিহর বাবু নিজের সঙ্গের ব্যাগ থেকে একটা লম্বা ফর্দ বের করে পড়তে লাগলেন — আপনার উপযুক্ত রেডি চারজন পাত্রী আছেন , এক বয়স বাহান্ন এম এ ইন ফিলোসফি উচ্চতা পাঁচ ফুট নয়, দুই বয়স সাতান্ন নন ম্যাট্রিক উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত, তিন বয়স আটচল্লিশ বি এ অনার্স ইন হিস্ট্রি উচ্চতা পাঁচ ফুট দুই – – “
” থামুন থামুন। আর লিস্ট পড়তে হবেনা। আরও, বয়সটা আরও কম চাই, বুঝলেন হরিহরবাবু ” চিৎকার করে উঠল সুজন — লেখা পড়া বি এ এম এ লাগবেনা। শ্যামলা স্বাস্থ্যবতী আর রাঁধতে জানলেই চলবে, তবে খেয়াল রাখবেন বয়েসটা পঁচিশের মধ্যে হওয়া চাই। “

হরিহর বাবু তাঁর চোখ দুটো চশমা সহ কপালে তুলে বললেন — অত কম বয়স ! “
বেণীবাবু ঘর ভরিয়ে হাসি তুলে মন্তব্য ছোঁড়েন — পারবেন সামলাতে ?”
ফণীবাবু জুড়লেন — বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা ! “

হরিহরবাবু ওঁদের থামিয়ে সুজনকে বলেন — সব বয়সের পাত্রী আমার স্টকে আরও আছে। বলেন তো এই রবিবারই পাত্রী দেখানোর ব্যবস্থা করি, কী বলেন সুজন বাবু ?”

সুজন সম্মতিতে ঘাড় নাড়ে।
মাস্ক পরা মানুষগুলো মুখের মাস্ক হাতে এনে হাঁ করে সুজনের দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। সবাই চুপচাপ, নিস্তব্ধ হয়ে থাকে সুজনের বাড়ির বারান্দা। সামনেই মনুর হাতে সাজানো ফুলের বাগান থেকে বেলফুলর সুগন্ধ আসছে। বয়স্কদের হাতের মাস্ক হাতেই রয়ে যায়। খানিকটা সময় গন্ধটা নিতে চান ওঁরা।
সুজন খুব ধীরে ধীরে বলতে থাকে — মনুটার রান্নায় আর চলছে না। বলে কিনা, চিংড়ি আবার মাছ নাকি ! আরে ব্যাটা চিংড়ি যেমন জলের পোকা অন্য মাছও জলের পোকা। মৎস্য তো রন্ধন। ওটা ঘরের বৌরা ভাল বোঝে। হরিহরবাবু তাড়াতাড়ি করবেন।”

বেণীবাবু এবার বলেন — সত্যিই ! দেখবেন সুজনবাবু আমরাও যেন ইলিশের পাতুরির ভাগ পাই। হা হা হা হা – – -“
সুজন যেন একটু রাগতঃ স্বরেই বলতে থাকে – – জানেন, এই মনুরও তিন কূলে কেউ নেই। আমার এই বাড়িতে ক্লাবের লাইব্রেরী হবে একদিকে আর অন্যদিকে মনুকে বউ নিয়ে থাকার জন্য লিখে দিয়েছি। ও যাবে কোথায় ? কিন্তু ও তো কোন রকমে রান্না করে। আমার জন্য, হ্যাঁ আমার জন্যই একটা রান্না জানা বউ চাই যে ইলিশের পাতুরি, কাতলার কালিয়া, চিংড়ির মালাইকারি বানাবে।”
আর প্রতি সন্ধ্যায় বেলফুল খোঁপায় আটকে মনুর সঙ্গে সিনেমা দেখে ফিরে এসেই অসময়ে রান্নাঘরে গিয়ে এক কাপ চা বানাবে। বলবে “দাদু চা “। তাই আমার একটা অল্প বয়েসী বউ চাই। হরিহর বাবু – আর দেরী করবেন না।”

সুজন তাকিয়ে দেখে ওর সাথীরা মুখে মাস্ক লাগিয়ে ধীরে ধীরে যে যাঁর বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছেন।

2 thoughts on “ছোটগল্পঃ একটা বউ চাই – রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী

  1. কি সুন্দর গল্প । মুগ্ধ হলাম।

  2. We absolutely love your blog and find many of your post’s to
    be precisely what I’m looking for. Does one offer guest
    writers to write content in your case? I wouldn’t mind publishing a post or elaborating on many of the subjects you write related to here.
    Again, awesome website!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *