ছোটগল্পঃ ইন্টারভিউ – দেবাশিস রায় (কলকাতা)

ইন্টারভিউ
দেবাশিস রায়


ইয়েস ।
ভেতর থেকে গম্ভীর কণ্ঠে অনুমতি পেয়ে দুরুদুরু বক্ষে ভারি কাঠের দরজা ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢুকলাম।
জীবনের প্রথম চাকরির ইন্টারভিউ । পরে দেখেছিলাম এটাই প্রথম আর এটাই শেষ। আর কখনো কোথাও
ইন্টারভিউ দিতে যেতে হয় নি।
আমার জীবনে ঠিক এইরকম দুরুদুরু বক্ষে গৃহপ্রবেশ আর মাত্র একবার হয়েছিল। সেবারে অন্যরকম
ক্ষেত্র ছিল কিন্তু অনুভূতি ছিল প্রায় এই একরকম। সেটাও ছিল এটার মতই জীবনের প্রথম আর শেষ।
আমি আমার ফুলশয্যার বাসর ঘরের কথা বলছিলাম। জীবনের সব কিছুই আমার কাছে প্রথমবার এসেই
থমকে দাঁড়িয়ে যায়। আর সুযোগ দেয় না।
যাক সেসব কথা। ফিরে আসি এই ইন্টারভিউ এ। ঘরে পুরো বডিটা তখনও ঢোকে নি। চেয়ারে বসবার
অনুমতি অনেক দুরের কথা। সোজাসুজি বসে থাকা কোটের বোতাম খোলা গুঁফো লোকটা বাজখাই গলায় হুঙ্কার
দিয়ে উঠলেন,” তোমার পদবী রায়?”
“ ইয়েস স্যার। দেবাশিস রায়।” পেছনের পা তখনও ঘরের মধ্যে ঢোকাতে পারি নি। সুইং ডোরটা খটাস করে
পায়ের ওপর আঘাত করলো।
“দুজন বিখ্যাত রায় এর নাম বল।”
এ যেন ইনিংসের প্রথম বলটাই শরীর ছুঁয়ে লাফ দিয়ে ওঠা বাউন্সর। মাথা নামিয়ে বলটা ছেড়ে দেব না ব্যাট
দিয়ে আটকাব, ভাবতে ভাবতেই গায়ের ওপর আছড়ে পড়া বাউন্সর। থতমত খেয়ে মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে
আওয়াজ বেরল,”সত্যজিত রায়।”
” তুমি সিওর উনি রায় ছিলেন?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ স্যর।”
“তোমার নামের সাথে যে রায় আছে তার বানান ইংরেজিতে লিখেছ Roy । আর ওনার নামের সাথে যে বানান
আছে ইংরেজিতে তা হোল Ray । দুটো এক হোল কি করে? তুমি ভুল বলেছ।”
প্রাথমিক ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা ততক্ষণে কাটিয়ে উঠেছি। সামান্য হলেও আত্মবিশ্বাস ফিরে আসতে আরম্ভ
করেছে। সামনের পা বাড়িয়ে ডিফেন্সিভ খেললাম। ” না স্যর। দুটো একই। বানান আলাদা হলেও বাংলায় দুটো
এক। একই উচ্চারণ।”
” প্রমাণ দাও জেন্টেলম্যান। শুধু মুখের কথায় তো মানবো না।” বাপরে। গুঁফোটা ডেঞ্জারাস তো। অনেক পরে
লেখক গুন্থার গ্রাসের গোঁফের সাথে ওনার গোঁফের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছিলাম।
যাই হোক, একটার পর একটা ঘাবড়ে দেওয়া প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে মনে হচ্ছিল, আচমকা যেন বজ্র বিদ্যুত
সহকারে বৃষ্টিপাতের মধ্যে এসে পড়েছি। কালবৈশাখী। সাহস করে ছাতা মাথায় দেওয়ার চেষ্টা করলাম,”
স্যর, ইংরেজিতে Buy, bye এবং By শব্দ তিনটের বানান সবার আলাদা আলাদা কিন্তু উচ্চারণ দেখুন
এক।”
” সো হোয়াট? তিনটে শব্দের অর্থ তো আলাদা।”
আমি তখন মরিয়া। বললাম,” স্যর, নামের বেলায় উচ্চারণটাই আসল। এই যেমন আপনি Debashis কে
দেবাশিস বলছেন। গড ব্লেশ কি বলছেন স্যার?”
এবারে দেখি ঐ ঘাবড়ে দেওয়া বজ্জাত গুঁফোটা হো হো করে হাসছেন। এত হাসির কি আছে? এদিকে আরেকটু
হলে আমার প্যান্ট ভিজে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল আর কি। বাপরে রে বাপ। এর নাম ইন্টারভিউ? এ যেন
আমার বাল্যবন্ধু জোতির্ময়ের পিসেমশাই। তখন ক্লাশ থ্রি তে পড়তাম। প্রথম আলাপেই জিজ্ঞেস করে
বসেছিলেন, তুমি ক্লাসের ফার্স্ট বয়? আচ্ছা বল তো ইংরেজিতে, লেফটেন্যান্ট; সাইকোলজি আর
রেস্টুরেন্টের বানান?” সেই পিসেমশাই এর সাথেও আমার সেই প্রথম আর সেই শেষ মোলাকাত । পিসেমশাই
অনেকবার চেষ্টা করলেও আমি পিছলে বেরিয়ে যেতাম। আবার নতুন কি জিজ্ঞেস করে বসবেন, সেই ভয়ে।
হাসি থামতে উনি খুব স্নেহ্ভরা কণ্ঠে বললেন,”খুব বুদ্ধিমান তুমি। গুড। আমি দেখেছি রায় যাদের পদবী
তারা খুব বুদ্ধিমান হয়। বাই দা ওয়ে, আমিও রায়। বুঝলে? আই এম মিস্টার ধীরাজ রায়। “
এতক্ষণে যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে এল। কে জানে কেন, আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে এল,” দুনিয়ার রায় এক হও
!!!”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *