লক্ষ্যভেদ
পার্থ রায়
-আমি ওর সাথে একটু একান্তে কথা বলতে চাই।
-দেখুন অফিসার, প্লীজ ওকে একটু প্রাইভেসি বজায় রাখতে দিন। তদন্তের নামে যদি এই ভাবে বারবার ওকে ইন্টারোগেট করতে থাকেন …।
-আমিও কোন বাড়ীর ছেলে। আপনাদের যন্ত্রণাটা ফিল করছি। ওর কো-অপারেশন ভীষণ জরুরী, প্লীজ।
ঘটনার প্রেক্ষাপট – [রাতের শেষ মেট্রো ট্রেনের কামরায় জনা তিনেক মদ্যপ যুবক, কোলকাতার এক নামী দামী বিশ্ব-বিদ্যালয়ের ফাইন্যাল ইয়ারের ছাত্রী ঈশানী চ্যাটার্জীর শ্লীলতাহানি করে। দুই একজন যাত্রী যারা ছিল, তারা সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত মানসিকতার পরিচয় দিতে কুণ্ঠা বোধ করেনি। আতঙ্কিতা, দিশেহারা ছাত্রীটি আপ্রাণ চেষ্টা করে কোন মতে দুষ্কৃতীকারীদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে পরের ষ্টেশন যতীন দাস পার্কে ট্রেন আসা মাত্র মরীয়া হয়ে দরজার দিকে দৌড়ে যায়। ধ্বস্তাধস্তির মধ্যেই ট্রেনের দরজা বন্ধ হবার উপক্রম হতে, মেয়েটি প্ল্যাটফর্মে ঝাঁপ দিয়ে নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করে ঠিকই কিন্তু মাথায়, হাতে আঘাত পায়। প্ল্যাটফর্মে কর্তব্যরত আরপিএফের দুই পুলিশ কর্মচারী আহত, বিধ্বস্ত ছাত্রীটিকে উদ্ধার করে। বিভিন্ন সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেলে এই খবর ছড়িয়ে পড়ামাত্র জনমানসে এক তীব্র ক্ষোভ দানা বাঁধে। মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী কোলকাতা পুলিশের গুন্ডা দমন শাখাকে অবিলম্বে অপরাধীদের পাকড়াও করার কড়া নির্দেশ দেন।]
তদন্ত ভার দেওয়া হয় গুন্ডা দমন শাখার তরুণ দক্ষ সাব-ইন্সপেক্টর অরুনাভ সান্যালকে। ছাত্রীটির স্টেটমেন্টের ভিত্তিতে এক সপ্তাহের মধ্যেই কয়েকজনকে ধরাও হয়। গুন্ডা দমন শাখার অফিসারেরা নিশ্চিত এদের মধ্যে দুই জন মূল অপরাধী। সমস্যা হল, সন্দেহভাজনদের মধ্যে একজন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় রয়েছে। ধরা মাত্রই চাপ আসছে ছেড়ে দেবার জন্য। তার থেকেও বড় সমস্যা – ভীত,সন্ত্রস্ত মেয়েটি ও তার অভিভাবকরা কিছুতেই সনাক্তকরণ করতে রাজী নয়। হতাশ বড়বাবু অরুণাভকে একবার যেভাবে হোক শেষ চেষ্টা করে দেখতে বললেন।
ইচ্ছা করেই অরুণাভ আজ ইউনিফর্ম পরেনি। চাকুরী জীবনে আজ ওর এক কঠিন পরীক্ষা। ওকে জিততেই হবে। দপ্তরের গাড়ী না নিয়ে নিজের বাইকটা নিল। ক্যান্সার হাস্পাতালের পেছনেই ঈশানীদের দোতলা বাড়ির সামনে বাইক রাখল। নিজের মতো করে কিছু হোমওয়ার্ক করে ভগ্নমনা ঈশানীর মুখোমুখি হল।
-ঈশানী, কেমন আছেন? বেশ ফ্রেশ লাগছে আপনাকে। তারপর? মাস্টার্স করার পরে কী করার ইচ্ছে?
-(ভগ্ন কণ্ঠস্বরে) জানি না। সব শেষ হয়ে গেছে।
-হা হা হা। কিচ্ছু শেষ হয়নি। আগে, একটা ব্যাপারের ফায়সালা হোক। আমরা কি বন্ধু হতে পারিনা? আপনাকে কি তুমি বলতে পারি?
-হুম।
-থ্যাঙ্কস, আমার নাম অরুণাভ। তুমি কি অ্যাকডেমিক লাইনে যাবে? জানো, আমার না শিক্ষক হবার স্বপ্ন ছিল। একজন আদর্শ শিক্ষক।
-হলেন না কেন?
-এই যাহ! বন্ধুকে আপনি বলছ। বন্ধুর কিন্ত খারাপ লাগছে।
-হলে না কেন মাস্টার মশাই?
-(একটা দীর্ঘশ্বাস) অর্থনৈতিক কারণে। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে সবে এমএতে ভর্তি হয়েছি, বাবা রিটায়ার করলেন। ছোট বোন তখন সবে কলেজে ঢুকেছে। চাকুরীর চেষ্টা করতে করতে এই পুলিশের চাকুরীতে ঢুকে পড়লাম।
- এমএটা প্রাইভেটে কমপ্লিট করতে পারতে।
- নাহ! আর হল না। এক বছরের ট্রেনিং-এ চলে গেলাম, তারপরে তো… (আবার দীর্ঘশ্বাস)।
কথা বলতে বলতে, ঈশানীর মধ্যে একটা স্বাভাবিকতা ফিরে আসার লক্ষণ অরুণাভর পুলিশি চোখে এড়ায় না। কিন্তু তাড়াহুড়ো করলে চলবে না।
-ঈশানী।
-হু
-এক কাপ চা……
-এমাআআ, সরি। এক্ষুনি মাকে বলছি….
-উঁহু, তোমার হাতের চা।
-(মৃদু লাজুক হাসি) আমার হাতের চা তোমার মুখে রুচবে না।
কিছুক্ষণ বাদে চা আর প্লেটে কিছু স্ন্যাক্স নিয়ে ফিরে এল।
-দেখো, খেতে পারো কিনা।
চায়ে চুমুক দিয়ে, অরুণাভ বলল, “নট ব্যাড। চিনিটা আর একটু কম দিও। আজকাল অনেকেই চিনি কম খায়”
-হুম।
-ঈশানী, আমি কি হেরে যাবো? তুমিও কি হেরে যাবে না?
-মানে? বুঝলাম না।
-তুমি অপরাধীদের শনাক্ত করলেই কিন্তু আমরা ওদের শাস্তি দিতে পারব। তা নাহলে, ওদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হব।
-ও ও, এই জন্যেই বন্ধু হবার নাটক করেছেন? আমি কোথাও যাব না।
-না না, একেবারেই না। বন্ধু যখন হয়েছি, বন্ধুই থাকবো। পুলিশও বন্ধু হতে পারে। প্লিজ একটু ভেবে দ্যাখো আজ ওরা শাস্তি না পেলে, ওদের সাহস আরও বেড়ে যাবে। একজন মেয়ে হয়ে চাও অন্য মেয়েদেরও ক্ষতি হোক? কারণ শাস্তি না পেলে ওদের সাহস আরও বেড়ে যাবে। আরও বড় কোন অপরাধ করবে।
ঈশানী নিরুত্তর। যে আশার আলো দেখা গিয়েছিল হঠাৎ যেন সেটা উধাও হয়ে গেল। হতাশ অরুণাভ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “হেরে গেলাম আজ। পুলিশ এই ভাবেই মাঝে মাঝে অপরাধীদের কাছে হেরে যায়। ভালো থেকো। পড়াশুনাটা চালিয়ে যেও। আসি”। অরুণাভ ফেরার জন্য ঘুরতেই হাতে একটা নরম ছোঁয়া অনুভব করে। ঈশানী আলগোছে ছুঁয়ে আছে। ওর হাত।
-তুমি এসে নিয়ে গেলে যেতে পারি।
-আসব, আমিই নিয়ে যাব তোমাকে।
নিজের বাইক স্টার্ট দিতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল অরুনাভ। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিল, কেউ তাকে দেখছে। পিছন ফিরে দোতলার জানালায় দৃষ্টি মেলতে দেখতে পেল ঈশানী নিস্পলক চোখে ওকে দেখছে। নিজের মুখে ভোরের সূর্যের রঙ এনে হাত ওপরে তুলল অরুণাভ। ঈশানীও মৃদু হেসে হাত নাড়ল।