অণুগল্পঃ আ মরি বাংলা ভাষা – পার্থ রায়

আ মরি বাংলা ভাষা
পার্থ রায়

উত্তর কোলকাতার শতাব্দী প্রাচীন এই বিদ্যালয় রত্নগর্ভা। বিভিন্ন ক্ষেত্রের বহু বিখ্যাত মানুষ এই বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। কয়েক দিন ধরে স্কুলটাতে যে সাজো সাজো রব চলছিল আজ সকালে সেটা চূড়ান্ত সীমা স্পর্শ করেছে। সপ্তাহব্যাপী শতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্না ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখিকা সুচিত্রা আয়ার আজ প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করবেন। তাঁর জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শোনার জন্য সবাই উদগ্রীব। প্রধানশিক্ষক মশাইয়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শত ব্যস্ততার মাঝে কিছু সময় বের করে এই স্কুলে আসতে রাজি হয়েছেন। অবশ্য শিক্ষামন্ত্রীর ব্যাক্তিগত হস্তক্ষেপও এই প্রচেষ্টাকে ফলপ্রসূ করেছে। সেই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। অনেক ভাবনা চিন্তা, আলোচনার পরে স্থির হয় যে সমগ্র অনুষ্ঠানটা সঞ্চালনা করবে স্কুলের সেরা ছাত্র কৌস্তভ রায়। যেহেতু লেখিকা ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেন এবং আয়ার উপাধি দক্ষিন ভারতীয় তাই কৌস্তভকে ইংরেজিতে সঞ্চালনা করার নির্দেশ দেওয়া হল। মজাটা হল যখন সুচিত্রা দেবী তাঁর বক্তব্য রাখতে উঠলেন। সবাইকে চমকে দিয়ে নিখুঁত বাংলায় বলতে শুরু করলেন, “আমার সামনে যেন সারি সারি নুতন পাতার মতো সজীব সবুজেরা বসে আছে। কী যে ভাল লাগছে! আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। কিন্তু একটা জিনিষ বুঝতে পারলাম না সঞ্চালনা কেন বাংলা ভাষায় হচ্ছে না?”। প্রধানশিক্ষক নগেন্দ্রবাবু কৈফিয়ত দেবার মতো করে বললেন, “আসলে আমাদের জানা ছিল না যে আপনি এতো ভাল বাংলা জানেন এবং বলতে পারেন”।
“বুঝতে পেরেছি। আমি ইংরেজি ভাষায় লিখি, ইংল্যান্ডে থাকি এবং আমার সারনেম আয়ার। তাই ভেবেছিলেন যে আমি বাংলা ভাষা বুঝতে পারব না। জানেন আমার মা বাঙালি। বাবা দক্ষিন ভারতীয়। বাংলা ভাষা পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী ভাষাগুলোর মধ্যে একটা। আমি যখন ছোট ছিলাম মা আমাকে শুধু অ, আ, ক,খ শিখিয়ে ক্ষান্ত হননি পাশে বসে ঠাকুরমার ঝুলি, সুকুমার রায়ের ছড়া, রামায়ণ, মহাভারতের গল্প পড়ে শোনাতেন। আমাকে পড়তে বলতেন। তারপরে তো যতো বড় হয়েছি বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, নজরুল, বিভূতিভূষণ এমন সব দিকপাল লেখকদের গল্প উপন্যাস পড়ে বড় হয়েছি। বাংলা ভাষা সম্পর্কে আমার ব্যাক্তিগত মতামত কী জানো? বলতে পারবে তোমরা?”
ছেলেরা সমস্বরে চেঁচিয়ে বলে, “না, ম্যাডাম”
এমন সমস্বরে উত্তর পেয়ে প্রাণখোলা হাসি মুখে সুচিত্রা আয়ার বললেন, “নিজেকে বেশ দিদিমণি, দিদিমণি মনে হচ্ছে। ভাগ্যিস আমি আজ এখানে এসেছিলাম। এবার শোন আমার প্রশ্নের উত্তর আমিই দিচ্ছি। আমি বলি বাংলা ভাষা পৃথিবীর সেরা ভাষা। বাংলা ভাষা রবি ঠাকুরের ভাষা। বাংলা ভাষা আমার মায়ের ভাষা…….”।
স্বতঃস্ফূর্ত তুমুল হাততালিতে বিদ্যালয় প্রেক্ষাগৃহ মুখরিত হয়ে ওঠে। আবেগে ভেসে যাওয়া সুচিত্রার চোখে জল।

One thought on “অণুগল্পঃ আ মরি বাংলা ভাষা – পার্থ রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *