মাতৃভাষা দিবস
জয়ন্ত বাগচী
একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জাতীয় জীবনে এক গৌরবময় ও ঐতিহ্যবাহী দিন। বাঙালির জাতীয় জীবনের
সকল চেতনার উৎস হচ্ছে এ দিনটি। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার ঐতিহাসিক দিন
এটি। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন উর্দুকে
পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। পূর্ববঙ্গ থেকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন। এভাবেই ভাষা
আন্দোলনের সূত্রপাত। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু
থেকেই উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চক্রান্ত চলতে থাকে।
১৯৪৭ সাল ১৫ আগষ্ট অবিভক্ত ভারত বিভক্ত বা দ্বিখন্ডিত হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করল। একটি হলো
‘ভারত’ আরেকটি হলো পাকিস্তান , এই দুটি দেশ হলো স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। আবার পাকিস্তান দুটি
বিভাগ, পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান । এরপর ১৯৪৭ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারী করাচী ’ শহরে স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে
প্রথম অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের সাংসদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয়
অধিবেশনে একটি প্রস্তাব করেন যে, ‘ পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের বৃহৎ সংখ্যক জনগণের মাতৃভাষা ‘ বাংলা ‘
তাই আমি প্রস্তাব রাখছি যে, ” এই প্রদেশের মাতৃভাষা যেন বাংলা রাখা হয়।
এরফলে পাকিস্তান এর প্রশাসকেরা অত্যন্ত সমস্যার সৃষ্টি করেন। এই প্রশাসকেরা পশ্চিম পাকিস্তান এর
মতোই পূর্ব পাকিস্তান এর রাষ্ট্রীয় ভাষা উর্দুকে ঘোষণা করেন। বাংলাভাষাকে কোন মতে রাষ্ট্রীয় ভাষা
হিসাবে স্বীকৃত দেওয়া যাবে না। এমনকি পাকিস্থানের স্রষ্টা ‘ মহম্মদ আলি জিন্না’ বাংলা ভাষাকে সেই
সময়কার পূর্ব পাকিস্তান এর রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে মর্যাদা দেওয়ার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে ছিলেন। ১৯৪৮ সালে
জিন্না ঢাকা সফরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র – শিক্ষক সমাবেশে ঘোষনা করেন, ” উর্দু ভাষা, একমাত্র
উর্দু হবে পাকিস্তান এর রাষ্ট্রভাষা “। শুরু হল প্রতিবাদের ডাক ও আন্দোলন। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা
করার দাবি জানাতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলাভাষার অধ্যাপক ড. মহম্মদ শহীদুল্লাহ
লিখলেন, ” শিশু্র যেমন মাতৃ দুধের অধিকারও কেউ কেড়ে নিতে পারেনা, তেমনি মাতৃভাষার অধিকার ও কেউ কেড়ে
নিতে পারেনা”।
১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারী ভাষা আন্দোলন এক চরম পর্যায় পৌঁছে গেল। ” রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই
” ধ্বনিতে রাস্তায় নামলো ছাত্র – শিক্ষক সমাজ। সরকারী ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে ও অমান্য করে। বিনা
প্ররোচনায় নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী ছাত্রদের প্রতি পুলিশ গুলি চালায়। এরফলে চারজন ছাত্র (
রফিক, সালাম, জব্বর ও বরকত) রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। উত্তেজিত জনতা শাসকের
সংবাদপত্রের অফিস ‘ দ্যা মনিং নিউজএ ” আগুন ধরিয়ে দেয়। অবশেষে ভাষা শহিদদের রক্তের বিনিময় অর্জিত
বাংলা মাতৃভাষা বিশ্বদরবারে সুপ্রতিষ্ঠ হয়।
১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের সংগঠন ‘ইউনেসকো’ ২১ ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষাদিবস ঘোষনা করে। এরপর থেকে সারা বিশ্বে প্রতিবছর এই দিনটি ‘ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ‘
পালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে গণমাধ্যম, রেডিও, টেলিভিশন ও ইন্টারনেটে ও ব্যাপক ভাবে বাংলা ব্যবহার
করা হচ্ছে। ভারত ,বাংলাদেশ ছাড়াও আমেরিকা, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, ইরান, আরব, পাকিস্থান, জাপান ও চিন
গণমাধ্যম ও রেডিওতে অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে বাংলাভাষায়।
একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, বর্তমানে সারা বিশ্বের প্রায় ২৪ কোটি মানুষ বাংলাভাষায় কথা বলে। বাংলা
ভাষাভাষীর মানুষের সংখ্যা বিশ্বের চতুর্থতম স্থানে।
ইউনেসকো ঘোষণা করেছে ঠিকই ২১ ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। কিন্তু ২১
ফ্রেব্রুয়ারী শুধু পথসভা করে, সকাল থেকে টেলিভিশন অনুষ্ঠান করে নয় বা ‘ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ”
শ্লোগান গেয়ে ভাষার প্রতি নামকে ওয়াস্তে দরদ দেখালে হবে না সারাটা বছর ধরে চর্চা করতে হবে। প্রাক্তন
মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায় চেষ্টা করেছিলেন কাজের ভাষা হিসাবে বাংলা প্রতিষ্ঠা করার। তবে আমাদের
সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, ‘মা যেমন আমার নিজের, ঠিক তেমনি ভাষাও আমার নিজের’, তাই আমাদের দায়িত্ব
তাকে যত্ন করে বাঁচিয়ে রাখা। তবেই তো ভাষা আন্দোলনের সার্থকতা। তবেই ভাষা শহীদের যথাযথ মর্যাদা
দেওয়া হবে।
একনজরে বাংলাভাষা
১. ৩০ টি দেশে ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ।
২. ৬টি দেশে রাষ্ট্রীয় বেতারে বাংলাভাষার চ্যানেল।
৩. ১০টি দেশের বেতারে বাংলাভাষায় অনুষ্ঠান।
৪. আরবে ৬ টি দেশে বাংলা সংবাদপত্র।
৫. আমেরিকা, কানাডা সহ ইউরোপে ৮টি দেশে বাংলা সংবাদপত্র।
৬. অস্ট্রেলিয়ার সংসদে স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাভাষা।
যতদূর জানা যায় তা হল, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বপ্রথম উদ্যোগ
গ্রহণ করেন কানাডার ভেঙ্কুভারে বসবাসকারী দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম। তাদের
সার্বিক উদ্যোগে প্রথমে প্রতিষ্ঠিত হয় “মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভারস অব দ্য ওয়ার্ল্ড” নামে একটি সংগঠন।
এরপর আরও নানা সুধীজনের সহযোগিতায় বিভিন্ন ওঠাপড়ার শেষে ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত
ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব
উত্থাপন করা হয়। সেই অধিবেশনেই মোট ১৮৮টি দেশের সমর্থন সহযোগে প্রস্তাবটি পাশ হলে তার পরের
বছর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখে জাতিপুঞ্জের সদস্য দেশগুলিতে যথাযথ মর্যাদায় আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়ে আসছে।
এরপরে ২০১০ সালের একুশে অক্টোবর সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে জাতিপুঞ্জ
স্বয়ং একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে পালনের উদ্যোগ নেয়। এই প্রস্তাবটি উত্থাপন
করেছিল বাংলাদেশ। তার পরের বছর মে মাসে জাতিপুঞ্জের ১১৩ সদস্য বিশিষ্ট তথ্য বিষয়ক কমিটিতে উক্ত
প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতিষ্ঠা পূর্ণতা লাভ করে। নিজের
মাতৃভাষা পৃথিবীর সকল মানুষের কাছে পরম আদরের এবং হয়তো সবচেয়ে কাছের একটি বিষয়। সেই ভাষার
প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত একটি দিনকে মানুষ পরম উৎসাহের সাথে পালন করে থাকে। এই
দিনটিতে পৃথিবীজুড়ে মানুষ মেতে ওঠে নিজের ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাসের গৌরবময়
চর্চায়। সমগ্র বিশ্বজুড়ে ভাষার এমন ব্যাপক উদযাপন আর কোন দিন দেখা যায় না। এ যেন এক ভাষা
মহোৎসব।
ভাষাভিত্তিক এই উদযাপনের সম্ভবত সবচেয়ে নির্মল রূপটি দেখা যায় বাংলাদেশে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার
পরেই প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে স্মরণ করে জাতীয় ছুটি ঘোষণা করা হয়।
দেশের রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী তথা বড় বড় বিদ্বজ্জনেরা এই দিনটিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে
বাংলাদেশের ইতিহাসের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করেন। শহীদ দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরার
উদ্দেশ্যে দেশজুড়ে এই দিনে আয়োজিত হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক
ব্যক্তিত্বরাও এই দিনটিতে বাংলাদেশের সমবেত হয়ে থাকেন। টেলিভিশন ও রেডিও জুড়ে ভাষা আন্দোলনের
মহিমা প্রচারিত হতে থাকে। বাংলা একাডেমি ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে ঢাকায় একুশে বইমেলার আয়োজন করে।
মাতৃভাষা এবং সাহিত্যচর্চা পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই বক্তব্যটির প্রকৃত অর্থকে বুঝতে গেলে
সর্বপ্রথম আমাদের সাহিত্যের স্বরূপ অনুধাবন করতে হবে। সাহিত্য হল আমাদের মনের ভেতরকার সেই সব
কল্পনা যাকে আমরা ভাষার মাধ্যমে জীবন্ত রূপ দিতে চাই। এ-বিশ্বে যা কিছু প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক, তা
কিছুই সুন্দর। মানুষ স্বাভাবিকভাবে নিজের মনের অন্দরমহলে সাহিত্যিক কল্পনার রূপ দান করে আপন
মাতৃভাষায় চিন্তার মাধ্যমে।
তাই কোন মানুষ যদি নিজের মাতৃভাষায় দুর্বল হয়, তার পক্ষে সমৃদ্ধ সাহিত্যকে রূপ দান করা
কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এমন সাহিত্য গড়ে উঠলেও তা নিজের স্বাভাবিকত্ব হারিয়ে সুন্দরকে পাশ কাটিয়ে হয়ে পড়ে
দুর্বল। খেয়াল করলে দেখা যাবে এই পৃথিবীতে বিশ্বমানের যত সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে প্রত্যেকটির পিছনে লেখক
বা লেখিকার মাতৃভাষার অবদান সবথেকে বেশি। কারণ নিজের মাতৃভাষায় যত স্নিগ্ধ বা নির্মল ভাবে চিন্তা করা
যায় পৃথিবীর অন্য কোন ভাষায় অসীম জ্ঞান থাকলেও আবেগের অভাব হেতু চিন্তার সেই স্নিগ্ধতা বা গভীরতা,
কোনটাই আসেনা। কিন্তু তা বলে নিজের মাতৃভাষাকে বিকৃত করে অন্য ভাষা থেকে ধার করা শব্দবন্ধের
সংযোজন কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
একবিংশ শতাব্দীর এই বিশ্বায়নের কালে মানুষ যতই বিশ্ব নাগরিক হতে চাইছে নিজের
মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা ততই বেড়ে চলেছে। আমাদের মনে রাখা দরকার, নিজের মাতৃভাষাকে ভালো না বাসলে
কোন মানুষ পৃথিবীর অন্য কোন ভাষাকে আদর্শরূপে আয়ত্ত করতে পারে না। মাতৃভাষা কোন একটি জনগোষ্ঠীর
ঐতিহাসিক ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে ধারণ করে।
মাতৃভাষা হল মায়ের ভাষা। মা যেমন তার সন্তানকে স্নেহের বন্ধনে আগলে রাখে, তেমনি মাতৃভাষাও একটি
নির্দিষ্ট ভাষাগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে ইতিহাসের স্নিগ্ধ বন্ধনে জড়িয়ে রাখে। সেজন্যেই মাতৃভাষা আমাদের
সকলের কাছে পরম আবেগের। নিজেদের এই আবেগকে রক্ষা করার জন্য আমাদের অনতিবিলম্বে সচেতন হতে
হবে।
নিজেদের ইতিহাসকে ও ভাষার ঐতিহ্যকে আপন করে নিয়ে বর্জন করতে হবে বিকৃতি ও
অপসংস্কৃতিকে। নতুন প্রজন্মকে বিশ্বায়িত করার সাথে সাথে তাদের আপন ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপারেও
সচেতন করে তুলতে হবে প্রতিনিয়ত। আমাদের মনে রাখতে হবে নিজেদের মাতৃভাষার চর্চায় আছে “প্রাণের
আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি”। এই লক্ষ্যগুলি সফল হলে তবেই আমাদের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা
দিবস উদযাপন সার্থক হয়ে উঠবে।
তথ্য সমৃদ্ধ লেখাটা বেশ লাগল।