মুক্তগদ্যঃ যত্নে থেকো আমার ভাষা – স্বপন নাগ

যত্নে থেকো আমার ভাষা
স্বপন নাগ

এখন কেউই MA বা MSc পড়ে না, এখন সবাই masters করে। এরা পাশ করে না, তার বদলে এরা pass out করে। কেউই চাকরি করে না but সবাই job করে। প্রথম প্রথম শুনে আমার মনে হত চাকরি পায়নি বলে বা চাকরি পাবার আশায় হয়তো তারা জপ করছে। বেশ কয়েকদিন পর বুঝলাম, ওটা ‘জপ’ নয়, জব। ওরা just ‘job’ করে। তারপরে সেই job থেকে মাইনে পেলেও বলে না but তারা মোটা টাকা salary draw করে। এরা কেউই পরিবারে থাকে না but এরা familyতে belong করে। এই মাইনের যোগ্য নয়, but এরা এই salary deserve করে। সবাই আরো ভালো চাকরি খোঁজে না but এরা better job খোঁজে।
এ সব শুনলে শুধু একটা খাঁটি আধুনিক বাংলা শব্দই মুখে আসে awesome.’
এ সব শুনলে শুধু একটা খাঁটি আধুনিক বাংলা শব্দই মুখে আসে awesome.’
উদ্ধৃত গদ্যাংশটি ফেসবুক থেকে পাওয়া। ‘এরা’ মানে এই সময়ের ছেলেপুলেরা। অর্থাৎ বর্তমান প্রজন্ম। এরা কথায় কথায় ‘কমিট’ করে, ‘প্রোপোজ়’ করে, ‘আউটিং’-এ যায়। কী করবে ! বাংলা প্রতিশব্দটি যে ওদের জানা নেই। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনাধীন থেকে থেকে পুরো দেশীয় ভাষার ওপর ইংরেজির দাপট এত সক্রিয়ভাবে প্রভাবিত ছিল যে মাতৃভাষার প্রতি দরদ লালন করার কোনো তৎপরতা কেউই দেখায়নি। এই যুক্তিটিতেও কিন্তু যথার্থতা নেই। ইংরেজ শাসনকালের অবসান হয়েছে, সেও তো সত্তোরোর্ধ বছর। এই সময়ের মধ্যেই বরং বাংলা ভাষার গরিমা ম্লান থেকে আরও ম্লান হয়েছে।
একুশে ফেব্রুয়ারি এলে বাংলাভাষাকে নিয়ে বাঙালির যত আদিখ্যেতা দেখা যায়, দিন ফুরোলেই নটেগাছটি মুড়োনোর মত বাকি দিনগুলোয় আশ্চর্যরকম নিষ্ক্রিয়তায় বাঙালি ঝিমোতে থাকে।স্কুল কলেজের চেয়ার টেবিলে না হয় ইংরেজি জাঁকিয়ে ব’সে আছে, তা বলে বাংলা, আমার মাতৃভাষা সত্যিই কি এতটা উপেক্ষিত হবার প্রয়োজন ছিল ? সময়মত সমান্তরাল একটি চর্চাক্ষেত্র তৈরি রাখার প্রয়াস জরুরি ছিল না ?
যে-কোনো ভাষাভাষী মানুষের কাছেই তার মাতৃভাষা আদরের। তাকে যত্নে রাখা, টিকিয়ে রাখার দায় ও দায়িত্ব সেই ভাষার মানুষদের সাথে সাথেই দায় থেকে যায় সরকারেরও। আর এখানেই ভারতবর্ষের বাংলা এবং বাঙালির সমস্যা জটিলতর। ভারতের বসবাসকারী বাঙালির মাতৃভাষার ওপর আক্রমণ ইংরেজির সঙ্গে হিন্দিরও। ‘হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রীয় ভাষা’ কেন্দ্রীয় সরকারের বছরভর ব্যাপক প্রচারের দাপটে হিন্দিই ভারতের রাষ্ট্রীয় ভাষা এমন একটি ধারণা গড়ে তোলার দুরভিসন্ধি সকলেই লক্ষ্য করেছি। শুধু প্রচারেই নয়, সরকারি মাধ্যমগুলিকে ব্যবহার করে বাংলার মত অন্য প্রান্তীয় ভাষাগুলোর ওপর হিন্দি চাপিয়ে দেবার জঘণ্য একটি প্রচেষ্টা সক্রিয় আছে দীর্ঘ দিন ধরে। আর সেই চেষ্টায় তাল ঠুকছে গণমাধ্যমগুলিও। এটি একটি ভাষাসন্ত্রাস। একে ঠেকানোর একমাত্র উপায়, যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে মাতৃভাষার সমান্তরাল চর্চা এবং চর্যা। ভুললে চলবে না, ভাষার সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতিও বিপর্যস্ত হতে বাধ্য। কিন্তু নিদারুণ সত্য এটাই যে, পশ্চিমী সংস্কৃতি যেমন বিশ্বব্যাপী আগ্রাসী, বাংলার ক্ষেত্রে সঙ্গে দোসর দেশি হিন্দিও।
ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে রক্ষণশীলতার কথা বলেন কেউ কেউ। এখানে রক্ষণশীলতার কথা নয়, ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে অন্য ভাষার শব্দকে মাতৃভাষার শব্দভান্ডারে অন্তর্ভুক্তি দেওয়ার প্রয়োজন নিশ্চয়ই আছে। ইংরেজি ছাড়াও আরবি, ফারসি, চীনা, জাপানি, পর্তুগিজ কত ভাষা থেকেই তো শব্দকে আহরণ করেছে বাংলা। চেয়ার টেবিল ছাড়াও সেখানে সগৌরবে চা চিনিও বিদ্যমান। কথা হচ্ছে কী নেবো, কতটা নেবো, তা নিয়ে।
‘ছেলেটি দিনে দিনে ডাকাত বনে গেল’, কিংবা ‘খালের জলে মিলল যুবতী লাশ’ এই বাক্য দুটিতে ব্যবহৃত ‘বনে’ আর ‘মিলল’ শব্দগুলোকে লক্ষ্য করুন। ‘বন গয়া’ আর ‘মিলা হ্যায়’ হিন্দি শব্দবন্ধের বাংলায়ন। মিডিয়ায় ক্রমাগত ব্যবহারে আমাদের দৈনন্দিন ভাষায় ঢুকতে চাইছে এমন সব শব্দ। এখানে ‘বনে গেল’ যে কোনো অরণ্যযাত্রা নয়, বা ‘মিলল’ কোনো মিলনের কথা বলে না, বহুব্যবহারে অভ্যস্ত এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বোঝানো একসময় অসম্ভব হয়ে উঠবে।
শুধু কি লেখার ভাষা ! বদলে গেছে বলার ভাষাও। বদলাবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই বদলে যখন কারোরই নিয়ন্ত্রণ থাকে না, তখন পরিবর্তিত রূপটি দাঁড়ায় এক কিম্ভুতকিমাকার চেহারায়। রাস্তাঘাটে ছেলেমেয়েরা কথা বলে যে-বাংলায়, তাকে ঠিক বাংলা বলতে সাহস হয় না। শুধু ওদের দোষ দেবো কেন, ওরাও তো আশপাশ থেকেই নিচ্ছে শব্দ, বাক্য। যে-ভাষা শুনি এফ এমে, তা যে বাংলা, তাও মানতে চায় না মন। মনে পড়ছে, বছর কয়েক আগে এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ওরা যে-ভাষায় কথা বলে, আমি সেটা চিনি না। নিয়ন্ত্রণহীন, অভিভাবকহীন এভাবেই বাংলা ভাষা বয়ে চলেছে দিকশূন্যপুরের দিকে।
এবার দেখা যাক বাংলার বানানবিধি। সেখানেও অদ্ভূত এক বিশৃঙ্খলা। এই বিশৃঙ্খলার বড় হোতা সাইনবোর্ড, রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়াল লিখন। বছর চারেক আগে বাংলাদেশে গিয়েও পেয়েছি হোর্ডিংয়ে, সাইনবোর্ডে বাংলা বানানে যথেচ্ছ অবহেলার ছাপ। সেখানেও ‘শীতাতপনিয়ন্ত্রিত’-র পরিবর্তে অধিক শীততাপনিয়ন্ত্রিত শব্দের ব্যবহার হতাশ করেছে। নৈঃশব্দ্য, দ্রারিদ্র্য, বৈচিত্র্য শব্দগুলো থেকে কবে যেন হঠাৎ করেই য-ফলা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যাক। গাড়ী, বাড়ী, পাখী-র ঈ-কার হ্রস্বে পৌঁছেছে, তাও মেনে নিয়েছি। ‘শ্রেণী’ শ্রেণি হয়েছে, ভালো কথা, রাণী কী করে রানি হচ্ছে ! ণত্ব বিধানের ব্যতিক্রমী উদাহরণ ? এতদিন তবে ভুল শেখানো হয়েছিল ? ‘রজঃস্বলা’ কিংবা ‘মফঃস্বল’ কোথায় আছে, দেখেছেন ? ভয় হয় ‘সরস্বতী’ এবার সরস্যতি হয়ে না উপস্থিত হন। কেন কি, আমাদের মিডিয়ার ভূমিকা এমনই ভয়ঙ্কর। স্যরি, ‘কেন কি’ মানে বুঝলেন না ? কেন কি মানে কেননা। ইনিও হিন্দি থেকে ‘কিঁউ কি’-র হাত ধরে বাংলায় ঢুকে পড়েছে। এটাই ভাষা। আজকের ভাষা। শুদ্ধ বাংলা বলতে না পারাই আজ আধুনিকতা। তা চলতে দেওয়া মানে মাতৃভাষাকে হত্যা করা, তার সর্বনাশ করায় নিজেকেও শামিল করা। এন আর সি নিয়ে অনুপ্রবেশ রোধের ভোটমুখী প্রয়াসের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি ভিন ভাষার শব্দের অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর।
পৃথিবী থেকে কত ভাষার অবলুপ্তি ঘটেছে। অন্য অনেক কারণের মধ্যে ঔদাসীন্য অন্যতম একটি কারণ। তাই বছরের নির্দিষ্ট একটা সময়ে মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করে দায়িত্ব শেষ করা যায় না। শহীদ বেদীতে মাল্যদান আর রফিক সালাম জব্বার বরকতদের স্মরণ করে, দশ-বিশ লাইনের কবিতা লিখে সম্পূর্ণ হয় না দায়িত্ব পালন। বাংলা ভাষার বর্তমান অবস্থা যথার্থই স্তম্ভিত করে দেওয়ার মত। স্তম্ভিত শব্দের মূল ‘স্তম্ভ’ হয়ে আমাদের দাঁড়াতে হবে সমস্ত আক্রমণ আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। আরও বেশি বেশি করে বাংলা ভাষা দিয়ে সাজাতে হবে আমাদের প্রতিটি দিনের যাপনকে। ভাষার স্বার্থে, শিল্পের স্বার্থে, সংস্কৃতির স্বার্থে বাংলাকেই করে তুলতে হবে মন্ত্র, উপাসনা। তবেই বাঁচে একটি ভাষা। তবেই মাথা তুলে দাঁড়ায় একটি জাতি।
এই উদাসীনতা, এই গা-ছাড়া মনোভাব আজ আমাদের খাদের কিনারে টেনে এনেছে। কবে আমরা জাগবো ! আমাদের বড় ভরসা, আমার ভাষায় কথা-বলা মানুষের সংখ্যা বিশ্ব জুড়ে নেহাত কম নয়। আমাদের বড় ভরসা বাংলাদেশ নামে একটি দেশ। তবুও ভয় পাই। তবুও শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে ভিনভাষার অযাচিত চাপে।
পরিশেষে একটি অনুরোধ, প্রতিবেদনটির সঙ্গে সহমত হলে প্লিজ় শেয়ার করবেন। প্লিজ়ের পরিবর্তে দয়া কামনা করতে পারি বড় জোর, কিন্তু শেয়ার করার বিকল্প খুব সহজেই না পাওয়ার দায় আমাদেরই। এই দায় থেকে সরে দাঁড়ালে ক্ষমা করবে না আগামী প্রজন্ম, সেই অভিসন্ধিতেই আজ সক্রিয় ভাষাসন্ত্রাসবাদীরা আড়ালে মুচকি হাসছে।

2 thoughts on “মুক্তগদ্যঃ যত্নে থেকো আমার ভাষা – স্বপন নাগ

  1. বেশ মজার লেখা। সত্যি এসব ভাবায়, খুব ভাবায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *