দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা ও কয়েকজন।
রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী(রাধু)
বন্ধুত্ব হয়েছিল তরুণ তর লারী আজাদের সঙ্গে। সুদূর মীরাটের ছেলে। আমাদের সর্বভারতীয় সাহিত্য সম্মেলনের অর্থাৎ অখিল ভারতীয় ভাষা সাহিত্য সম্মেলনের এক বার্ষিক অনুষ্ঠানে এসেছিল। শিবপুর বেঙ্গল ইনজিনীয়ারিং কলেজের অডিটোরিয়ামে। সে অনুষ্ঠানের উদ্বোধনীতে এসেছিলেন ভারতের ত্ৎকালীন মাননীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় রাজ্যপাল নুরুল হোসেন, মাননীয়া বিচারপতি পদ্মা খাস্তগীর, ভূপাল থেকে সাধারণ সম্পাদক শ্রীসতীশ চতুর্বেদী, বিশিষ্ট পণ্ডিত অম্লান দত্ত, উপদেষ্টা কবিও স্বাধীনতা সংগ্রামী শ্রীপূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য এবং আরও অনেকেই। ডঃ চন্দন রায়চৌধুরী ও শ্রীকৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়ে অক্লান্ত প্রয়াসে এই অনুষ্ঠানটি বর্ণময় হয়ে উঠেছিল। অনুষ্ঠানের স্মারক পত্রিকার সম্পাদনার গুরু দায়িত্ব বহন করতে হয়েছিল এই অধম লেখককেই।
মনে আছে, লারী আজাদের লেখা অনেক গুলো হিন্দী কবিতার চট্ জলদি বাংলায় অনুবাদ করে দিয়েছিলাম। দুদিনের অনুষ্ঠানের আগে পরে আমাদের দুজনের আর কাকদ্বীপ অঞ্চলের তরুণ কবি ওয়াজেদ আলীও ছিল। আমাদের তিন জনের কথা যেন ফুরোতে চাইছিল না। কিন্তু লারী আজাদের সঙ্গে পরবর্তীকালে আর যোগাযোগ ঘটেনি। এখনকার মত মোবাইল বা স্মার্টফোনের ব্যবহার তখনও ছিল না। কেমন আছে কি করছে কিছুই জানিনা বা জানাবার কোন সুযোগই আর নেই।
অবশ্য, এই ঘটনার আগেই মাঝেমধ্যে কাকদ্বীপের ওয়াজেদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে সাহিত্য মেলা, সারা বাংলা সাহিত্য মেলা ও আমাদের অবেক্ষণ পত্রিকার সৌজন্যে। ও আমার মা থাকতে আমাদের বাড়িতে কয়েকবার এসেছিলও। ছোটবেলায় বিখ্যাত এস ওয়াজেদ আলীর লেখা ” সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে ” এরকম কথা সহ ‘ ভারত বর্ষ ‘ প্রবন্ধ পাঠ্য ছিল। কাজেই নামের সাদৃশ্যের জন্য আমাদের কবিবন্ধু ওয়াজেদ তার নিজের মধুর ব্যবহার ও মিষ্টি মিষ্টি কবিতার জন্যও চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ওয়াজেদের বাড়ি কাকদ্বীপের দিকে। তাই এই সূত্র ধরে আজ লিখে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর জেলার পরিচিত কয়েকজনের কথা। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার কয়েকজন ছিলেন যাঁদের স্মৃতি প্রায় অর্ধ শতকের পরও আমার মনে জ্বলজ্বল করছে।
তাই সংক্ষেপে বলি, আমাদের জ্ঞান হবার পর চব্বিশ পরগনা বলতে একটাই জেলা জেনে এসেছি। গত শতকের ছিয়াশী সালে অর্থাৎ ১৯৮৬ সালের ১লা মার্চ শনিবার থেকে প্রসাশনিক কাজের সুবিধার জন্য এই জেলা ভেঙ্গে উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা করা হয়। ইতিহাস বলে এক সময় চব্বিশ পরগণার মধ্যে সর্বমোট পঁচাত্তরটি পরগণা যুক্ত হয়েও পঁচাত্তর পরগণা নাম না হয়ে চব্বিশ পরগণা নামটাই রয়ে গিয়েছিল।
যাই হোক, দুই জেলা তৈরী হবার আগে থেকেই আমাদের অফিসের এক জয়নগর অধিবাসী সহকর্মী শীতের কুয়াশা ঢাকা ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠেই নিজেদের দোকানের জন্য সদ্য তৈরী হওয়া অনেকগুলি মোয়া সংগ্রহ করে নিয়ে সোজা অফিসে চলে আসতেন। আমাদের ডিপার্টমেন্টের সকলকে ভালোবাসার সঙ্গে মোয়া খাওয়াতেন। আজও সে মোয়ার স্বাদ আমাদের অনেকেরই মুখে লেগে আছে।
বারুইপুরে থাকতেন বেশ কয়েকজন সহকর্মী তাঁদের একজন প্রায়ই নিজেদের বাগানের পুরুষ্টু পেয়ারা এনে ডিপার্টমেন্টের অনেককে খাওয়াতেন।
জয়নগরের কয়েক জন তখনকার তরুণ কবি শুধু কবিতার জন্য কলকাতার আমাদের সারা বাংলা সাহিত্য মেলায় আসতেন। জয়নয়গর-মজিলপুর অঞ্চলের তরুণ কবিবন্ধু কে এম শহীদুল্লাহ প্রায় আসতেন, ১৯৭২ সালে যখন আমরা বনগাঁ বর্ডার পেরিয়ে প্রায় পঁচাত্তর জনের একটি দল সারা বাংলা সাহিত্য মেলার ব্যানারে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ গিয়েছিলাম তখন শহীদুল্লাহও এক প্রতিনিধি হয়ে সঙ্গে ছিলেন। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কবিতা লেখার অভ্যাস ছিল। এখনও আছে কিনা জানি না। তবে পেশায় ডাক্তার কবি শহীদুল্লাহর নাম স্মরণে যতবার আসে ততবারই আমাদের আগের প্রজন্মের বিশেষভাবে বিখ্যাত পণ্ডিত ডঃ শহীদুল্লাহর লেখা গ্রন্থের কথা মনে পড়ে।
কাকদ্বীপের নিরহংকারী সাদামাটা চলনের বিশিষ্ট লেখক গবেষক নরোত্তম হালদারের সঙ্গে পরিচয় সেই সারা বাংলা সাহিত্য মেলা ও পত্রিকা সাহিত্য মেলার সৌজন্যে। তিনি দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কথা , বিশেষ করে গঙ্গারিডি সংস্কৃতির কথায় সারাজীবন অতিবাহিত করেছেন। তিনি বৃহত্তর গাঙ্গোপদ্বীপ বা দক্ষিণ পুণ্ড্রবর্ধন অঞ্চলকে গঙ্গারিডি দেশ নামে অভিহিত করা হোত বলে মনে করতেন। তিনি মনে করতেন এক সময় গঙ্গা নদী কলকাতা হয়ে কালীঘাট, রাজপুরের পশ্চিম, বারুইপুরের পশ্চিম, আটিসারা, সরিষাদহ, জয়নগর ও মজিলপুরের মাঝখান দিয়ে ছত্রভোগ, কাশীনগর, বকুলতলা ইত্যাদি স্থান দিয়ে আরও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে গিয়ে কাকদ্বীপ, মনসাদ্বীপ, মগরা-ধবলাট হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ত। আদি গঙ্গার খাত এখনও এইসব অঞ্চলে দেখা যায়। নরোত্তম হালদার মহাশয় অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রীর সন্ধান পেয়ে এই অঞ্চলের প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতি নিয়ে একাগ্রতা সহ সাধনা করেছেন। এ রকম বিরল ব্যক্তিত্বের প্রতি সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাতেই হয়।
অপূর্ব সাহা এক দীর্ঘ দেহী সুপুরুষ যিনি দেহের শক্তির চাইতে মনের শক্তির উপর বেশী জোর দিতেন। শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমের আদর্শে বিশ্বাসী অপূর্বদা আমার দাদার মত ছিলেন। তাঁর জাগরী পত্রিকায় প্রায়ই আমার লেখা দিতে হতো। তবে জাগরীতে লেখার আগেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ঘটেছিল সারা বাংলা সাহিত্য মেলার আসরে। কবিতা, প্রবন্ধ, বিশেষ করে শ্রীঅরবিন্দ ও শ্রীমার উপর লিখতে বেশি ভালবাসতেন। অনেকবার পুডুচেরী আশ্রমে গিয়েছিলেন। তিনি শ্রীঅরবিন্দকে শ্রদ্ধা জানাতে শান্তিনিকেতনে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের ‘ নমস্কার ‘ কবিতা রচনার (৭ই ভাদ্র ১৩১৪ বঙ্গাব্দ) শতবর্ষ পালনের দ্বারা সূচনা করেছিলেন। শ্রীমতী ভূমিকা গোস্বামীর সুমধুর কন্ঠে উদ্বোধনী সঙ্গীত ” সংগচ্ছধ্বম্ সংবোদদ্ধম্ সংবো মনাংসি জানতাম ” দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করা হয়।
সেই থেকে প্রতিবছরই ২৪ শে আগস্ট আমরা ছুটে যাই শান্তিনিকেতনে, সেখানে হাতিপুকুরের পাশে কলকাতার শ্রীঅরবিন্দ ভবন পরিচালিত শ্রী অরবিন্দ নিলয়ে। কাছের দূরের অনেক কবি সাহিত্যিক আজও সমবেত হয়ে থাকেন। সূচনালগ্নে জাগরী সম্পাদক অপূর্ব সাহা, সাহিত্য মেলার সম্পাদক ও বিশিষ্ট কবি স্বাধীনতা সংগ্রামী শ্রীপূর্ণেন্দুপ্রসাদ ভট্টাচার্য, নবকুমার শীল, মেদিনীপুরের ঐতিহাসিক স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা কৃষ্ণচৈতন্য মহাপাত্র ছাড়াও স্থানীয় বিভিন্ন গুণীজনদের উপস্থিতি স্মরণযোগ্য হয়ে আছে। কৃষ্ণচৈতন্যদা, নবদা, অপূর্বদারা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও প্রতি বছর আমাদের তরুণতর কবিপুত্র শ্রীঅতনু সাহা এবং শ্রীবিশ্বনাথ সাউ কলকাতার শ্রীঅরবিন্দ ভবনের সহযোগিতায় ” অরবিন্দ রবীন্দ্রের লহ নমস্কার…..” নমস্কার কবিতার উৎসব পালন করে থাকেন।
সাবলীল আত্মকথা।
বাহ্। খুব সুন্দর।