স্বয়ংবর
ভূমিকা গোস্বামী
আজ সকাল থেকেই ওদের বাড়ির পরিবেশ বেশ থমথমে।
মৌলী মাস ছয়েক হল কলকাতার এক নামী স্কুলে চাকরি পেয়েছে। শহরের উপকণ্ঠে ওদের বাড়ি। সকাল সকাল বাড়ি থেকে না বেরলে সাড়ে দশটায় স্কুলে পৌঁছতে পারে না।
সাধারণত রবিবার ও বেলা আটটার আগে বিছানা ছাড়ে না। তারপর বাবা মা-র সাথে গল্প করতে করতে চা আর ব্রেকফাস্ট করে। বিকেলে বন্ধুদের বাড়িতে ডাকে বা ও বন্ধুদের বাড়িতে যায়।
ছুটির দিনে এটা সেটা খাওয়ার বায়না করে মাকে সকাল থেকে ব্যাস্ত করে ও। কিন্তু আজ সকালে শুধু এককাপ চা পেটে পড়েছে। এখন ও নিজের ঘরেই ট্যাব নিয়ে বসে রয়েছে।
বাবা মাও একদম চুপচাপ।
বাবা- মলয় বাবু প্রতিদিন সকাল আটটায় কোনরকম নাকেমুখে গুজে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে রাত আটটায় ঘরে ফেরেন অফিস করে। বাজার করার সময় থাকে না। সাধারণত ছুটির দিনে জমিয়ে বাজার করতে ভালবাসেন।
মা — বীণাদেবীও ইউটিউব থেকে রান্না শিখে, ছুটির দিনে- সকালে ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু করে নানা রকম মজাদার রান্না করে বাপ মেয়েকে চমকে দেন।
এখন বেলা দশটা। এখনও দুজনে লিভিং রুমে । মুখ ভার করে বসে রয়েছে।
অশান্তির সূত্রপাত সকালে চা খেতে খেতে । খবরের কাগজটা হাতে নিয়েই “পাত্রচাই” পাতাটি খুলে মলয়বাবু বীণাদেবীকে বললেন — দেখো তো এই পাত্রটি কেমন ? এই তৃতীয় কলামের শেষটা দেখ।
বীণাদেবী চশমা ঠিক করে মাত্র পাতাটি হাতে নিয়েছেন। অমনি মৌলী ঝাঁঝিয়ে পাতাটি কেড়ে নিয়ে কুটিকুটি করে ছিড়ে ফেলল।
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। নিশ্তব্ধতা ভেঙে মলয়বাবু বললেন – এটা কী হল ? ছেলে মেয়ে বড় হলে বাবা মা-র দায়িত্ব তাদের বিয়ে দেওয়া। তাদের সুখী জীবন তৈরী করে দেওয়া। আমরা তাই করছি। প্রাথমিক পর্যায়ে বাছাবাছি করে তোকে জানাব।
এবার শান্ত গলায় কেটেকেটে মৌলী বলল — কে বলেছে শুনি,ছেলেমেয়ের বিয়ে দেওয়া বাবা মা-র দায়িত্ব ? তাছাড়া আমি আগেও তোমাদের বলেছি, এখন আবারও বলছি আমার বিয়ের ভাবনা তোমাদের নয়। আমাকে মানুষ করতে অনেক ভেবেছো। দ্যাটস্ এনাফ।
— তার মানে ? তুই নিজের পছন্দমতো বিয়ে করবি নাকি ? এটা আমি কোনমতেই মেনে নেব না মনে রাখিস। প্রচণ্ড রেগে কথাগুলো বললেন মলয়বাবু।
বীণাদেবী তাকিয়ে আছেন একবার মেয়ের মুখের দিকে একবার স্বামীর মুখের দিকে ।
— বাবা জেদ কোরো না। বোঝার চেষ্টা করো। জীবনটা আমার। আমি বড় হয়েছি। অচেনা অজানা একটা মানুষের সাথে আমি কিছুতেই মানাতে পারবো না।
— তোর পিশি , মাসি , মামিদের এভাবেই বিয়ে হয়েছে। তারা তিরিশ চল্লিশ বছর সংসার করে বুড়ি হয়ে গেল। তাদের ছেলেমেয়েদেরও তারা বিয়ে দিয়েছে। কোন সমস্যা তো …
মলয়বাবুর কথা শেষ করতে না দিয়েই মৌলী বলল,
— কতটুকু জান তুমি ! বনিদি নর্থবেঙ্গলে ট্রান্সফার নিয়ে চলে গেল । বনিদি আর বাবাইদার সেই কলেজে পড়া থেকে ভাব। বাবাইদার পরিবার মধ্যবিত্ত। মামা মামি তাই জোর করে সমীরণদার সাথে বিয়ে দিল । সমীরণদারা উচ্চবিত্ত। লোকের কাছে বলতে পারবে। জান কি? সমীরণদা বনিদিকে কখনও ভাল ই বাসে নি। পাঁচ পাঁচটা বছর কম চেষ্টা করে নি বনিদি। কোনদিন স্ত্রীর মর্যাদা পায় নি। তারপর চলে গেছে। আমি তো বলেছিলাম বনিদিকে -ডিভোর্স ফাইল করো।
— ওকি বলল জান ?
— বাবার অসম্মান হবে। বাবা লোকের কাছে মুখ দেখাতে পারবে না।
— আর পিশিমণিকে তো চিরকাল পিশাই আয়া ছাড়া কিছু ভাবেই নি। এখনও নিজে এসি ঘরে থাকে। পিশিমণি পাশের ঘরে । ফ্যানটাও চালায় না। এই গরমে হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করে। কোন অভিযোগও করে না। এটা যে বঞ্চনা তাই তো জানে না। খেতে পরতে পারছে ,এটাকেই ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছে।
— কি দোষ করেছিল পিশিমণি , অল্প বয়সে পড়াশোনা শেষ না করিয়েই বিয়ে দিয়ে দিলে।
— বিয়ে কোন ভবিষ্যৎ তৈরী নয় কবে বুঝবে ?
নিজের পছন্দে বিয়ে অপরাধ কেন বাবা, অতীতে তো স্বয়ংবর সভা হতো। মেয়েরা নিজেরাই পাত্র নির্বাচন করতো। বাল্যবিবাহে অভিভাবকরা বিয়ে দিতেন । এখন তো বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ। তবু কেন ?
কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে ছুটে চলে এসেছিল মৌলী।
হঠাৎ বন্ধ দরজা ঠেলে মলয়বাবু আসলেন । চেয়ারে বসা মৌলীর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর মাখা গলায় বললেন – – মৌলীমা , চোখ খুলে গেছে আমার। তুই ই ঠিক। তারপর দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন- আরে ! এগারোটা বাজে । চল, ব্রেকফাস্ট করতে হবে না ?
বাহ্, দারুন লেখা।
স্বাধীন চেতনার কথা বলে এ গল্পটি। বেশ ভালো।
সুখপাঠ্য