জীবন কথাঃ সৌমিত্র স্মৃতি – কৌস্তভ বন্দ্যোপাধ্যায়

কৌস্তভ বন্দ্যোপাধ্যায়

আজ তাঁর জন্মদিনে কত স্মৃতিই না মনে ভিড় করে আসছে। সিনেমা দেখার ও বিভিন্ন ধরণের গান শোনার আগ্রহ আমার স্কুল জীবন থেকেই ছিল।সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে প্রথম সামনে থেকে দেখি 1984 সালে, শিবপুর বি ই কলেজের অনুষ্ঠানে। আমার দাদা ঐ কলেজের প্রাক্তন ছাত্র, সে কারণে কলেজের কোন অনুষ্ঠানেই আমি ও আমার বন্ধুরা অনুপস্হিত থাকতাম না। সেই সন্ধ্যায় আরতি মুখোপাধ্যায় আসর জমিয়ে চলে গেলেন রাত আটটা নাগাদ। তারপরই উঠলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।পরনে মেরুন রঙের পাঞ্জাবি। আবৃত্তি শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথের তোতাকাহিনী দিয়ে। কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, প্রাক্তনদের ভিড়ে তিল ধারণের জায়গা নেই মাঠে। কিন্তু তাঁর আবৃত্তির সময় সারা মাঠ নিঃশব্দ। আমি জীবনে সেদিনই প্রথম তোতাকাহিনী শুনলাম। আজও যা কানে বাজছে। এরপরের ঘটনা একটু অন্য রকম। 1986 সালের সেপ্টেম্বর মাস। আমার বন্ধু দেবাশিসের ইচ্ছে আমতায় তাদের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে এক সকালে সৌমিত্রবাবুকে নিয়ে যাবার।আমি ও দেবাশিস খুব সকালে হাজির হলাম তাঁর গল্ফগ্রীনের বাড়িতে।বাড়ির খোঁজ আমি আগেই নিয়ে রেখেছিলাম, ফলে সমস্যা হয়নি খুব একটা। দেখলাম বাড়ির বাইরে একটা অ্যামবাসাডার গাড়ি দাঁড়িয়ে। বুঝলাম তিনি এখনই বেরোবেন। তাঁর বাইরের ঘরে বসার কয়েক মিনিট পরেই তিনি এলেন, হাতে ধূমপানের পাইপ, পরনে লাল পাঞ্জাবি। আমরা ওনাকে দেখে উঠে দাঁড়ালাম;বললাম আমাদের আশার উদ্দেশ্য। উনি রাজি হলেন, বললেন, “আমাকে নিয়ে যাবার ও পৌঁছে দেবার ব্যবস্হা আপনারা করবেন।” আমরা রাজি হলাম যদিও, কিন্তু পরে সেই অনুষ্ঠানে ওনাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
এরপর আসি 1998 সালে কলকাতার কার্জন পার্কে পয়লা বৈশাখের প্রভাতী অনুষ্ঠানে।অনুষ্ঠানের সংগঠকদের সঙ্গে আমিও যুক্ত ছিলাম, কিন্তু কোন শিল্পী আসবেন, কখন আসবেন এই সম্বন্ধে কোন ধারণা ছিল না। আমি বেশ সকালেই পৌঁছে গেছি। তখনো শ্রোতারা অনেকেই এসে পৌঁছননি, কিন্তু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় উপস্হিত হয়েছেন, পরনে ধুতি, গরদের পাঞ্জাবি। শুরু করলেন জীবানন্দর কবিতা দিয়ে। সেদিন আমার তিন বছরের পুত্রও মোহিত হয়ে শুনল তাঁর আবৃত্তি।
এরপরের ঘটনা 2009 সালে। ছয় জুন আমাদের অফিস ক্লাবের অনুষ্ঠানের জন্য রবীন্দ্রসদন বুক করা হয়েছে। আমি ওনার বাড়ির ফোন নম্বরটি যোগাড় করে ফোন করলাম। উনি একটু রাতের দিকে কয়েকদিন পর ফোন করতে বললেন। আমি কয়েকদিন পর ফোন করলাম। উনি বললেন,ঐ দিনে তাঁর শুটিং আছে। (তখন গৌতম ঘোষের দেখা ছবির শুটিং চলছিল।) অরোরা স্টুডিয়োতে শুটিং চলছে। রবীন্দ্র সদনে পৌঁছতে তাঁর আটটা বাজবে। আমি বললাম, রাত নটা পর্যন্ত আমাদের হল নেওয়া আছে। একটু ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে।উনি আমার সঙ্গে সহমত হলেন।সেই অনুষ্ঠানে ওনাকে আমরা আনতে পারিনি।
এর মধ্যে ওনার টিকটিকি, নীলকন্ঠ নাটক দুটি দেখেছি এবং মুগ্ধ হয়েছি। নীলকন্ঠ নাটকটি অভিনীত হয়েছিল হাওড়া শরৎ সদনে। হাওড়ার সঙ্গে ছিল তাঁর একটি আত্মিক সম্পর্ক। তাঁর কৈশোর কেটেছিল এই শহরে।তিনি ছিলেন হাওড়া জেলা স্কূলের ছাত্র। সেদিন দ্বান্দ্বিক আয়োজিত নাট্যোৎসবের শেষ দিনে দর্শকাসনে উপস্হিত ছিলেন তাঁর কিশোরবেলার কয়েকজন বন্ধু।
কলকাতা পুরসভা কলকাতার ঐতিহাসিক টাউন হলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে সম্বর্ধনা দিল, সম্ভবত 2009 সালে।সেদিন ওনার পরনে ধুতি, গরদের পাঞ্জাবি।সম্বর্ধনা সভায় অনেক কথার মধ্যে তাঁর একটি কথা আমার এখনো মনে আছে; তিনি বলেছিলেন, ” আপনারা আমাকে এতদিন ধরে সহ্য করছেন এইজন্য আমি আপনাদের কাছে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।”
এরপর 2010 সালে আমাদের অফিসের অনুষ্ঠানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এলেন। মঞ্চস্হ হল তাঁর রচিত, নির্দেশিত, অভিনীত নাটক কুরবানি। অভিনয়ের শেষে আমাদের অনুরোধে আমাদের অফিস ক্লাবের পত্রিকাটির উদ্বোধন করলেন। তাঁর সই সংগ্রহের জন্য যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের সকলকে সই দিতে লাগলেন। আমার বন্ধুকন্যার অনুরোধে আমিও গেলাম তাঁর কাছে একটি ডায়রি নিয়ে।আমি বললাম, ” আমার জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে আপনার এক সময় খুবই যোগাযোগ ছিল।” তিনি সই দিতে দিতেই মুখ না তুলে বললেন,”কি নাম আপনার জ্যাঠামশাইয়ের?”আমি বললাম, “সুনীল চট্টোপাধ্যায়।” উনি তৎক্ষনাৎ বললেন, “আচ্ছা, ওনার অনুবাদ করা কিং লীয়ার নাটকটা কি বই হয়ে বেরিয়েছে, বলতে পারেন? আমাকে একটু জানাবেন তো।” আমি বললাম, “নিশ্চই জানাবো।”
পরবর্তীকালে কিং লীয়ার নাটক আলোড়ন ফেলেছিল কলকাতার নাট্যজগতে।
আজ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিনে তাঁকে আমার প্রণাম।

2 thoughts on “জীবন কথাঃ সৌমিত্র স্মৃতি – কৌস্তভ বন্দ্যোপাধ্যায়

  1. সুন্দর স্মৃতি কথায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণ করলেন ভাই কৌস্তভ। লেখনীর টানে পড়ার শেষে দেখি, অনেকক্ষণ মুগ্ধতায় আবিষ্ট হয়েছিলাম। আরো লিখুন ভাই।অভিনন্দন জানাই।

  2. ভীষণ সুন্দর স্মৃতিকথা। ভারী ভালো লাগলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *