রম্যরচনাঃ ছেলেমানুষী কাণ্ড – জয়ন্ত বাগচী

ছেলেমানুষী কাণ্ড
জয়ন্ত বাগচী

ফেসবুক হোয়াটস এপ –এর কল্যাণে আজকাল কিছু মানুষ অতিরিক্ত সংবেদনশীল হয়ে
পড়ছেন , ফলে স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি হারিয়ে বিড়ম্বনা সৃষ্টি করে চলেছেন । কথাটা খুলেই বলি । আমাদের
পাশের ফ্ল্যাটে বন্দনা ব্যানারজী থাকেন ।বেশ আধুনিকা মহিলা ।তবে উগ্রতার ছাপ নেই পোশাকে । তাঁর
সারাদিনের সঙ্গী ওই মোবাইল ফোনটি ।ফোন ছাড়া তাঁর একটা মিনিট চলেনা । সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই তিনি
শুভ সকাল বলে একটা লেখা সবাইকে কপি পেস্ট করে পাঠিয়ে দেন । প্রযুক্তির কল্যাণে সেটা মুহূর্তেই
বহুজনের কাছে পৌঁছে যায় । আর এতেই ঘটেছে বিপত্তি ! উপরের ফ্ল্যাটের সুমিত্রা রায় তিনিও বেশ আধুনিকা
তবে একটু বেশি কথা বলেন ।ফলে তাঁর সাথে বন্দনা ব্যানারজীর একটা চাপা রেষারেষি বহুদিন ধরেই চলে আসছে
যদিও তাঁরা সামনা সামনি খুবই আন্তরিক ব্যবহার করে থাকেন ।
হাউসিং এ ২৩শে জানুয়ারি নেতাজীর জন্মদিন পালন করা উপলক্ষে সভা ডাকা হয়েছে ।
কম্পাউণ্ডের ভিতরে নিজেদের কমিউনিটি হলে সবাই একে একে উপস্থিত হচ্ছেন । বন্দনা দেবী সেখানে
উপস্থিত হয়ে যথারীতি নিজের মোবাইলে খুট খুট করেই চলেছেন আর মাঝে মাঝে মুখ তুলে এর ওর কথায় সায়
দিয়ে চলেছেন । এমন সময় সেখানে সুমিত্রা দেবী আসতেই বন্দনা বলে ,আসুন আসুন দিদি ,ওয়েলকাম । কথাটা
শুনেই সুমিত্রা কটমট করে তাকিয়ে বলেন ,আপনার লজ্জা করে না ?
মানে ?
মানে ওই যে রেকর্ড করা কথাগুলো বলতে ? সে দিন আমার স্বামীর মৃত্যু বার্ষিকী ছিল। সকাল বেলা মোবাইল
খুলতেই দেখি আপনি লিখেছেন,শুভ সকাল ! পাশের ঘোষ গিন্নীকে সাক্ষী মেনে বলেন , আপনিই বলুন তো দিদি
,স্বামীর মৃত্যুর দিনটা কি শুভ হয় ? আপনার কি তাই মনে হয় ? কথাটা শুনে আমতা আমতা করে বন্দনা কিছু
একটা বলতে যেতেই সুমিত্রা দেবী বলেন ,আসলে আপনার ঐ যন্ত্রটা দিনরাত ঘাঁটতে ঘাঁটতে আপনি নিজেই
একটা যন্ত্রে পরিণত হয়েছেন । যন্ত্রের যেমন কোন বোধ বা অনুভূতি নেই আপনারও ঠিক সেই অবস্থাই
হয়েছে ।
পাশ থেকে ভটচায গিন্নি বলেন , এটা কিন্তু সত্যিই তোমার খুব খারাপ কাজ হয়েছে বন্দনা । বন্দনার
ওপর চাপা ঈর্ষা থাকা সেন গিন্নি বলেন , দারুণ খারাপ কাজ করেছ। ছিঃ ছিঃ এমন কাজ তুমি করেছ আমি
ভাবতেই পারছি না !
দেখতে দেখতে মুহূর্তের মধ্যেই কমিউনিটি হলের ভিতর তিনটি দল হয়ে গেল । একটা বন্দনার, একটা
সুমিত্রার আর একটা দর্শক সম্প্রদায় অর্থাৎ নির্দল । চোখ মুখ লাল করে হঠাৎ বন্দনা হল থেকে বের
হয়ে গেল । পিছন পিছন আরও ছ’সাত জন । এক চরম অরাজকতা সৃষ্টি হল । মাঝখান থেকে নেতাজী জয়ন্তীর
সভা বানচাল হয়ে গেল ।
কিন্তু ঘটনাটা এখানেই থেমে গেল না ।বন্দনা কাঁদতে কাঁদতে ফ্ল্যাটে যেতেই তার স্বামী অবাক
হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ,কি ব্যাপার ? কি হয়েছে ? পিছন পিছন আসা মহিলারা হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে বন্দনাকে
কোন কথা না বলতে দিয়েই বলে, দেখুন না দাদা, বউদিকে ঐ ওপরের ফ্ল্যাটের সুমিত্রা বউদি সকলের সামনে
কি ভাবেই না অপমান করলো ! ছিঃ ছিঃ সকলের সামনে এমন কোরে কোন ভদ্রমহিলা যে পরিচিত কাঊকে এমন
অপমান করতে পারে তা আমাদের কল্পনাতেও ছিল না । সকলের সমর্থন পেয়ে বন্দনার ভিতরের আবেগ আরও
উথলে উঠলো । রঙ করা ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমানী স্বরে স্বামীকে বলল ,তুমি তো কেবলই বলো , আমার এই
ক্ষমতা ,আমি ইচ্ছে করলে এটা করতে পারি,ওটা করতে পারি । এবার দেখাও দেখি তুমি কি করতে পারো । না
হলে বুঝবো ……
কথা শেষ না করেই নাকি সুরে কেঁদে উঠলেন । সকলের মাঝে স্ত্রী কে কাঁদতে দেখে পৌরুষে আগুন জ্বলে
ওঠে ব্যানারজী কর্তার ।একটা ভারিক্কি চালে বলেন ,কি হয়েছে আগে তো সেটাই শুনি । তারপর না হয় ……

তিলকে তাল করতে ওস্তাদ মিত্তির গিন্নী বলেন , কিছুই না দাদা ,সামান্য ব্যাপার আর তাই নিয়ে
সকলের সামনে বউদিকে যা নয় তাই বলল । কি না বৌদি ওনাকে সকালে মোবাইলে সুপ্রভাত পাঠিয়েছেন ।তাতেই
উনি কি অপমানটাই না করলেন সকলের সামনে !
ব্যানারজী কর্তা বুঝলেন তাঁর আধুনিকা স্ত্রীর মর্যাদায় আঘাত করা হয়েছে । তাছাড়া এতজন
মহিলার সামনে যদি বীরত্ব না দেখাতে পারি , তাহলে আর রইলো কি ?
তাই তিনি বললেন ,ঠিক আছে দেখছি । বলেই পাশের ঘরে চলে গেলেন । কিছুক্ষণ পরেই বাইরে থেকে
মহিলারা শুনতে পেলেন , ব্যানারজী বাবু কার সঙ্গে রীতিমত তর্কাতর্কি করছেন । আনন্দে বন্দনার গাল লাল
হয়ে উঠলো । মিত্তির গিন্নী আরও উস্কে দিতে বল্লেন,আমা্র কত্তা যদি শুনত এমন কথা তাহলে নীচে
এতক্ষণ ফাটাফাটি হয়ে যেত ।উনি সব সহ্য করতে পারেন কিন্তু আমাকে যদি কেউ একটু অসম্মান করে তাহলে
…… এই তো সেবার …
কথার মাঝেই ব্যানারজী কর্তা ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। বলেন , আপনাদের সামনে সব ঘটেছে তো
?
সবাই বলে ,হ্যাঁ হ্যাঁ আমাদের সামনেই ।
ঠিক আছে ,নীচে মিটিং ডাকতে বলেছি হাঊসিং ক্লাবের সেক্রেটারিকে ।আমি নীচে যাচ্ছি । ডাকলে
সবাই আসবেন । বলেই বেড়িয়ে গেলেন ব্যানারজী বাবু ।
মিত্তির গিন্নী হঠাৎ ফোনটা কানে দিয়ে বললেন , কি রে বলিস কি ? ঘরে পোড়া গন্ধ বের হচ্ছে ?
সব্বনাশ ! এই আমি আসছি আসছি। বলেই ফোন নামিয়ে বলেন,কি বিপদ দেখ তো ভাই ,ঘর থেকে নাকি পোড়া
গন্ধ বের হচ্ছে।আমি আসছি কেমন ? বলেই ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন ।
মাইতি গিন্নী বলেন ,ব্যাপারটা কি রকম হল? ফোনে কোন রিং হল না অথচ উনি ফোনে কথা বলেই
সরে পড়লেন ? এতক্ষণ উনিই ত সবথেকে বেশি চীৎকার করছিলেন !
বন্দনা ব্যাপারটা সামলে নিয়ে বলে , না , ফোনটা হয়তো ভাইব্রেট করা ছিল হতেও ত পারে ?
কথাটা শুনে মাইতি গিন্নী বলেন , হতে পারে বটে , কিন্তু আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে !
সেই সময় ব্যানারজী কত্তার ফোন এলো , তোমরা নীচে এস সবাই । সকলেই তড়িঘড়ি নীচে
হলের দিকে ছুটল ।
নীচে এসে সবাই অবাক । নীচে হলের ভিতরে বাইরে প্রায় পঞ্চাশ ষাট জন অচেনা লোক জমা
হয়েছে। আসলে ব্যানারজী কত্তা তখন ফোনে স্থানীয় পাড়ার ছেলেদের ডেকেছিলেন তারা অতি উৎসাহে সেখানে
যখন যাচ্ছে তখন তাদের পাশের নতুন ক্লাবের ছেলেরা বুঝেছে একটা কিছু ঘটেছে । ঘোলা জলে মাছ ধরতে
তারাও ঝাঁপিয়ে পড়েছে । ফলে যা হবার তাই হয়েছে । সমস্যার বল হাঊসিং এর মাঠ থেকে গড়াতে গড়াতে পাড়ার
দুই নব্য রাজনীতির সাথে যুক্ত ক্লাবের মাঠে গিয়ে পড়েছে । ফলে সেখানে একদল আর এক দলের বিরুদ্ধে
শ্লোগান দিচ্ছে । একদল বলছে দেখে নেবো অন্যরা বলছে ভেঙে দেবো গুঁড়িয়ে দেবো । তাই দেখে হাঊসিং এর
মহিলারা ভয়ে থরহরি কম্পমান । আসলে পাড়ার এই ক্লাবটি তাদের নবদুর্গা তে এই হাঊসিং থেকে একটা
টাকাও পায় না কারণ এই হাঊসিং এ পুজো হয় । তাই এবার পুজো টা যদি বন্ধ করা যায় তাহলে এখান থেকেই
কম করেও পঞ্চাশ হাজার টাকা চাঁদা উঠবে । এ মওকা ছাড়ে এমন বোকা কেউ আছে নাকি ?
চীৎকার চেঁচামেচি তর্ক বিতর্কের মাঝে কেউ কারুর কথা শোনেও না বা মানেও না । এমন সময় হাউসিং
এর গেট দিয়ে প্রবেশ করলো একটা সাদা রঙের কোয়ালিস গাড়ি । গাড়ি থেকে নামলেন স্থানীয় কাউন্সিলর
প্রনবেশ সেন । একদল তাঁকে দেখেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো । আর একদল নিপাত যাক বলে চীৎকার শুরু করলো
। হাউসিং এর ভিতর তখন জমজমাটি সার্কাস ! ক্রমে দেখা গেলো তিন জায়গায় তিনটে জটলা । হঠাৎ জটলাও
থেমে গেল । কারণ সেখানে এসে দাঁড়ালো কলকাতা পুলিশের একটা গাড়ি
গাড়ি থেকে নেমে এলেন একজন অফিসার । তিনি সামনে প্রনবেশ বাবুকে দেখে কেমন যেন একটু থমকে গেলেন ।
মুখে হাসি এনে বললেন, স্যার আপনিও এসেছেন । আসলে আমাদের কাছে ফোন এলো এখানে নাকি একটা বিশাল
আকারের দাঙ্গা হতে চলেছে । তাই খবর পেয়েই…।
কথা থামিয়ে প্রনবেশ বাবু বললেন, বেশ করেছেন। আপনারা যে চোখ কান খোলা রেখে কাজ করছেন ,
এটাই আমাদের গর্বের বিষয় ।

পুলিশ অফিসার বলেন , তা স্যার দাঙ্গা ……
প্রনবেশবাবু বললেন , না না তেমন কিছু নয়। কটা দাঙ্গাবাজ চেষ্টা করেছিল কিন্তু আমি
আসতেই সব ঠাণ্ডা । কোন প্রবলেম নেই । আপনি আসতে পারেন ।
অফিসার যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল । ঠিক আছে স্যার বলেই গাড়ীতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিল । এবার
প্রনবেশ বাবু বল্লেন,কিন্তু বিষয়টা আসলে কি ?
সত্যিই তো বিষয়টা আসলে যে কি সেটা এই জন সমাগমের ভিড়ে হারিয়ে গেছে । এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি
করে । সত্যিই তো বিষয়টা কি ? কেউ আর কোন কথা বলে না । পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে মিত্তির , ব্যানারজি
,ভটচায , মাইতি সব একাকার হয়ে গিয়েছে ।
এমন সময় অধ্যাপিকা বনানী দেবী বলেন,কিছুই নয়, একটু ভুল বোঝাবুঝি। আর সেটা মিটেও গিয়েছে। কি
ব্যানারজি বাবু তাইতো ?
ব্যানারজি বাবু একটু থতমত খেয়ে বলেন , কি আর বলবো ,যত্তোসব ছেলেমানুষি কান্ড আর কি !

2 thoughts on “রম্যরচনাঃ ছেলেমানুষী কাণ্ড – জয়ন্ত বাগচী

Leave a Reply to ভূমিকা গোস্বামী Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *