সাম্প্রতিক— ১৬ঃ পুরনো নাটকের নতুন ডায়লগবাজি – অনিরুদ্ধ সুব্রত

পুরনো নাটকের নতুন ডায়লগবাজি

‘অবেক্ষণ’ এখন পাক্ষিক পত্রিকা । চলতি বছরের জানুয়ারি দ্বিতীয় সংখ্যার ‘সাম্প্রতিক’ কলাম লেখার পূর্বেই খেয়াল হয় এই পক্ষের সময় । বিপ্লব, প্রজাতন্ত্র দুই-ই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে । একদিকে সংগ্রামী পৌরুষ আর পাশেই নবগঠিত জাতীয় গণতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণের ফলক । স্বাভাবিক ভাবেই স্যালুট জানাতে উন্নত করতেই হয় শির । এই সংখ্যার সাম্প্রতিক লেখা তাই সেখান থেকেই শুরু হোক ।
ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী তাঁর ‘নেতা থেকে নেতাজি’ প্রবন্ধে সুভাষচন্দ্র বসু সম্পর্কে লিখেছেন, “সুভাষচন্দ্রের ideology-র প্রধান উৎস ছিল অরবিন্দ ঘোষের চিন্তাধারা । তার মধ্যে মিশে আছে দয়ানন্দ-তিলকের আর্য সভ্যতার গরিমাবোধ, বঙ্কিমচেন্দ্রর দেশ, মাতা ও দুর্গার সমীকরণ, বিবেকানন্দের অপরাজেয় পৌরুষের আহ্বান ও শিব জ্ঞানে জীবসেবার নির্দেশ এবং অরবিন্দের নিষ্ক্রিয় এবং প্রয়োজনে সক্রিয় ( সহিংস ) সংগ্রামের ডাক ।”
ঐ একই প্রবন্ধে ১৯২১ এ সুভাষচন্দ্রের নিজস্ব একটি উক্তির উল্লেখ করা যায়, ” I had stood up with courage and composure in a crisis and fulfilled my duty…… I had a foretaste of leadership—– and of the martyrdom it involves…..”
১২৫তম নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্ম বার্ষিকী উদযাপনের নানা তোড়জোড় দেশ রাজ্য ব্যাপী । বিশেষত যা রাজনৈতিক নেতা নেতৃবর্গের কাছে একান্ত পালনীয় হয়ে উঠবে সেটাই স্বাভাবিক । বর্তমান ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের তথাপিও সমকালীন প্রকৃষ্টতম নেতা হয়ে ওঠার এমন বিশ্লেষণযোগ্য প্রস্তুতি কোথায় ? ঠিক কী আদর্শগত অভিধায় কে কোন রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে অংশ নিচ্ছেন । অথবা তাবড় বক্তৃতা সর্বস্ব মঞ্চ ফাটানো নেতাদের কার পশ্চাতে কী মানবিক , সামাজিক, বা ঐতিহ্যগত আত্ম উৎসর্গ আছে ? দেশের নব্য নাগরিকদের সে খবর জানা ভীষণই দরকার ।
সময়ের একটা সুস্পষ্ট দাবি উঠে আসার প্রয়োজন সারা দেশ প্রত্যাশা করে । যেমন রিজার্ভ বেঞ্চের নব্য ক্রিকেটারদের প্রচণ্ড শক্তির পরিচয় পেতে বিলম্ব হলো না । তারা শুধু সাহসে ভর করে সৃজন করতে পারল আটত্রিশ বছর পেরনো নতুন ইতিহাস । অদম্য আত্ম শক্তির উপর বিশ্বাস আর সঠিক লড়াইয়ের মানসিকতা দিয়ে যে দেশটার নবীনরা ক্রিকেটাররা খেলার মাঠে বিদেশি শক্তিকে পরাভূত করতে পারে, সেই দেশের নব্য নাগরিক হিসেবে যুব তরুণদের দল কেন দেশের সত্যিকার নেতাজিদের খুঁজে বের করতে পারবে না । আজকের ভারতবর্ষে প্রকৃত নেতার অভাব বোধ হলেও সে কথা তাদের সোজা হয়ে বলতে হবে । যারা ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দাপিয়ে বেড়ান , তাদের কানে পৌঁছে যাওয়ার দরকার
এই যে, দেশ খুঁজছে আদর্শ নেতা বা নেত্রী । নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে স্মরণ করার এ ছাড়া আর পথ কীই বা হতে পারে ।
তেইশে জানুয়ারির ঠিক দুই দিন পরে আবার এক উদযাপনের ফিরিস্তি । আমরা টেলিভিশন এবং ইন্টারনেটের কল্যাণে ঘরে বসে দেখতে পাবো রাজপথ সরগরম করা সেনা আর অস্ত্র শস্ত্রের মহড়া । একটা দেশের সার্বভৌমত্ব বোঝাতে অথবা জনগণকে জাতীয় নিরাপত্তা আশ্বস্ত করতে এই মহড়া ঠিক কী কাজে লাগে আজও আমার বোধগম্য হয় না । যদি ব্যাখ্যার খাতিরে সে উদযাপন ও দর্শনের অনুষ্ঠানকে সঙ্গত বলে মেনেও নিই, তাতেও কি একশো কুড়ি কোটির কাছে প্রজাতেন্ত্রর আনন্দ প্রকৃতই পৌঁছাতে পারে ! দেশের কোটি কোটি কৃষকদের দীর্ঘদিন রাস্তায় অবস্থান আন্দোলনে কেন পড়ে থাকতে হয়, প্রজাতান্ত্রিক ভারতবর্ষ তার সমাধানে উপযুক্ত কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে তার প্রদর্শন মনে হয় অনেক বেশি যৌক্তিক ছিল । অনেক বেশি যৌক্তিক প্রদর্শনী ছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি আর একটু মানবিক দৃষ্টি । গণতান্ত্রিক সুষ্ঠু কাঠামো তখনই সুস্পষ্ট বোধ হতো, যদি দেশের প্রত্যেকজন নারী নিরাপত্তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন না তুলত । সাংবাদিকদের স্বাধীনতা পদে পদে সুরক্ষিত থাকত । দেশের সাধারণ মানুষ যতক্ষণ না সাধারণতন্ত্র বুঝতে পারল বা তার নির্ভয় ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারল , ততক্ষণ তার কাছে ২৬ শে জানুয়ারি উদযাপনের অর্থ চির নির্থক ।
এই বাংলায় অতি সম্প্রতি নাকি নানা দলের রাজনৈতিক মিছিল থেকে প্রায় ভৌতিক ভাবে ‘গোলি মারো’ জাতীয় শ্লোগান নিক্ষিপ্ত হচ্ছে । তা এ আর তত বেশি কী ! প্রতি নির্বাচন পূর্ব এবং নির্বাচন পরবর্তী খুন খারাপি এই রাজ্যে কম তো হচ্ছে না । আগে হয়তো মিছিলে সেই কথাটা উচ্চারণ করা হতো না, মনে মনে থাকতো । এখন আগে থাকতেই তার অডিও ভার্সান রিলিজ হচ্ছে । আফটার অল ভারতীয় গণতন্ত্রের সাবালকত্ব বলতে আমরা এর চেয়ে বেশি আর কিই বা আশা করতে পারছি ! আসলে নির্বাচনই এই দেশে মূল উদযাপন, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের পরে আর কিছুই নেই মোক্ষ । ফলে হোক তেইশে জানুয়ারি স্মরণ অথবা ছাব্বিশে জানুয়ারি উদযাপন সবই এক প্রকার পুরনো নাটকের নতুন ডায়লগবাজি । যা চলছে চলবে , শক্তি প্রদর্শনের মিছিলের মতো । পাল্টে ফেলার বিপ্লব আদৌ লক্ষ্য করা যায় না ।


—- অনিরুদ্ধ সুব্রত ২২\ ১\২০২১

3 thoughts on “সাম্প্রতিক— ১৬ঃ পুরনো নাটকের নতুন ডায়লগবাজি – অনিরুদ্ধ সুব্রত

  1. একশ তিরিশ কোটি মানুষের দেশে অনেক বৈচিত্র্য আর বিভিন্ন দিকের গতি আমাদের জীবনযাত্রায় আনে নানা মত। এর মধ্যেই আমাদের বেঁচে থাকতে হয়, হবে। লেখককে অশেষ ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *