ছোটগল্পঃ মা – দেবাশিস রায়

মা
দেবাশিস রায়

মাঝে মাঝেই আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার মা ভীষণ কাঁদতে থাকেন। এই কান্নাটা আমারও গলার কাছে জমাট বাঁধে। খুব কষ্ট হতে থাকে আমার। কিন্তু মাকে সেটা বুঝতে দেই না। জানি না মা বুঝতে পারেন কি না। হয়ত পারেন। দুনিয়ার সমস্ত মায়েরাই সন্তানের মনের কথাটা ঠিক বুঝে ফেলেন। খানিকক্ষণ পরে মায়ের কান্না থেমে যায়। আমার ভেতরে সেই কান্নার রেশ থেকে যায় সারা দিন। কখনও কখনও তা রয়ে যায় আরও বেশ কয়েকদিন। আমি খেতে খেতে আচমকা মুখ তুলে তাকালে দেখতে পাই আমার মা কেমন যেন অপরাধীর মত চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ভাতের থালায় আমার আঙ্গুলের অন্যমনস্ক নড়াচড়া দেখে মা ঠিক বুঝে ফেলেন আমার মনের ভেতরের অস্থিরতা।
অথচ মায়ের তো কোন দোষ নেই। আমার বাবা যখন মারা যান, আমার বয়স ছিল তখন দশ। নাবালক আমাকে আর আমার সুন্দরী যুবতী মাকে উপেক্ষা করে আমার বাবার নিয়মিত যাতায়াত ছিল শুঁড়িখানায়। লিভারের অসুখে ভুগে যখন তিনি মারা যান, কানাঘুষোয় শুনতে পেতাম, আর কয়েকদিনের মধ্যেই অন্য বাবা পাবি। না, অন্য বাবা আমি আর পাই নি। একটু একটু করে আমার মা একার চেষ্টায় সেই দশ বছরের শিশু আমাকে আজ বাইশ বছরের যুবক করে তুলেছেন। আশা করি কারো বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না কেন আমি আমার মাকে খুব ভালবাসি। সমস্ত সন্তান মায়ের ভালবাসা পায়। কিন্তু সমস্ত মা, সন্তানের ভালবাসা পায় না। আমি আমার মাকে খুব ভালবাসি। জানি না আর কতদিন ভালবাসবার সুযোগ পাব। আমার মায়ের ক্যান্সার হয়েছে।
এই ক্যান্সার যে সারবার নয়, সেটা জানবার পর থেকেই মায়ের এমন কান্নার সূত্রপাত। নিজেকে অপরাধী ভাবার শুরুও এর থেকেই। বাবা নেই, আমিও চলে যাব এত তাড়াতাড়ি। তুই তো কোন অপরাধ করিস নি। তবে তোকে কেন ঈশ্বর এত অল্প বয়সে এমন অসহায় অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিল? মা নিজেকে অপরাধী ভাবতে শুরু করেন। কান্নার কারন যে এটা, তা বুঝতে আমার অসুবিধা হয় না। কিন্তু আমার মাও তো কোন অপরাধ করেন নি। শরীরে মারণ রোগ বাবা নিজের ইচ্ছায় ডেকে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর সেই নিজের ইচ্ছে খুশি চলবার প্রবণতা, মায়ের ইচ্ছেগুলোকে কেড়ে নিয়েছে। আমার মা তো আজ বারো বছর ধরে একবারের জন্যও নিজের ইচ্ছেকে ডানা মেলতে দেন নি। তিলে তিলে আমাকে বড় করে তুলেছেন। এটা তো মায়ের শ্লাঘার বিষয়। আজ যদি নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে মাকে তাড়াতাড়ি চলে যেতে হয়, মা কেন নিজেকে অপরাধী ভাববেন? মা কাঁদলেই, আমার বুকের ভেতর কষ্ট জমাট বাঁধে। আমারও ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করে। খুব ইচ্ছে করে, মাকে জড়িয়ে ধরে খুব করে কাঁদি। কিন্তু পারি না। জানি, তাহলে মায়ের কান্না আর থামবে না।
রাতের বেলা হলে মায়ের কাছ থেকে সরে আসি। ছাদে চলে যাই। সিগারেট খেতে খেতে আকাশের তারাদের দেখি। পৃথিবীর সমস্ত মায়েদের খোঁজবার চেষ্টা করি। যারা চলে গেছেন এই পৃথিবী ছেড়ে। তাঁরা তো ওই আকাশের গায়ে তারা হয়ে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থাকেন। পৃথিবীতে রয়ে যাওয়া সন্তানদের খেয়াল রাখেন। তাই হয়তো, দিনের বেলাতেও তারারা আকাশের গায়ে রয়ে যান। সূর্যের আলোর জন্য দেখা যায় না। কিন্তু তাঁরা থাকেন। দিবারাত্রির কাব্য। মা এবং সন্তানের।
দিনের বেলা হলে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসি। আমি যে ভদ্রমহিলার কাছ থেকে সবজি কিনি, ওনার বয়স আমার মায়ের বয়সের কাছাকাছি হবে| খুব বেশী হলে দুএক বছর এদিকওদিক | শুনেছি স্বামী মারা যাওয়ার পরে, সংসার প্রতিপালনের তাগিদে ওনার এই সবজি বিক্রি করবার ব্যাবসায় আসা। অদ্ভুত মহিলা। সবজি কিনে যে পয়সাই দেই, কখনও গুণে দেখেন না। অমনি অমনি পয়সার ব্যাগে রেখে দেন।
যখনই যাই, ওনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই প্রতিদিন একগাল নিষ্পাপ হাসি হেসে বলবেন, “বল,বাবা| কি নিবা?”
একটা ভীষন মা মা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে আমার চারদিকে| আমি খুব বড় বড় নিশ্বাসে সেই গন্ধ বুকের ভেতর টেনে নেই। আমার বুকের ভেতরের জমাট বাঁধা কান্নার দলাটা আস্তে আস্তে গলে যায়। আমার মা হয়ত আমায় ছেড়ে চলে যাবেন। হয়ত খুব তাড়াতাড়ি। কিন্তু আমার আরও তো অনেক মা ছড়িয়ে রয়েছেন এই পৃথিবী জুড়ে। আমি তো তাঁদেরও সন্তান।

2 thoughts on “ছোটগল্পঃ মা – দেবাশিস রায়

  1. ভীষণ ভালো লাগলো।
    আসলে মায়েরা তো অন্তরে থাকেন তাই তাঁদের শারীরিক অনুপস্থিতিতেও মানুষের মন অন্যখানে ‘মা’ কে খোঁজে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *