ছোটগল্পঃ গ্রিন কার্ড – জাহ্নবী জাইমা(ঢাকা, বাংলাদেশ)

গ্রিন কার্ড

জাহ্নবী জাইমা

টাইট জিনসের পকেটে আই ফোনটা ছটফট করে উঠতেই আনুস্কা মাথা নিচু করে উঠে গেল। মিটিং ছিলো বলে ভাইব্রেট মোডে রাখা ছিলো। বাইরে বেরিয়ে ফোনের নীল স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো দুটো মিসড কল। একটা এক্সপেকটেড ছিলো আর একটা কার? দেশে যাওয়ার টিকিটের খোঁজ খবর করছিল আনুস্কা। বই মেলা হচ্ছে  মানে সামনের মাসে হবে। বেশ কয়েক বছর বই মেলার সময় দেশে যাওয়া হয়নি। এবারে যদি সব ঠিকঠাক থাকে তবে আনুস্কা বই মেলার অন্তত তৃতীয় দিনে হাজির থাকতে পারবে। সকালে অফিসে বেরনোর আগে টিকিটের এজেন্সিকে ফোন করে ছিলো। ওরাই কল করেছে। ব্যবসা বলে কথা। আর দ্বিতীয় কলটা সামীনের। মেসেজ রেখেছে সিটিজেন শিপের বইটা জোগাড় হয়ে গেছে। সত্যি সামিন আছে বলে অন্যান্য ছোটাছুটিগুলো করতে হচ্ছে না। চাকরিতেই মন দিতে পারছে। গ্রিন কার্ডের অ্যাপ্লাইয়ের সময়ও তাই হয়েছে। সামীনই সব ফর্ম জোগাড় করে এনেছিলো। কোথায় কত কম দামে গ্রিন কার্ডের ছবি তোলা যায় সে সবও ওর থেকেই জেনেছিলো আনুস্কা। আর তখনই জেনেছিলো গ্রিন কার্ডের ছবিতে একটা কান দেখতে পাওয়া চাই আর সেই কানে এবং গলায় কোনও গয়না থাকতে পারবে না। এই সবই নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা। যা এ দেশে এসে জানতে পেরেছে আনুস্কা। এর পর ছিলো ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়া। অফিসটা কোথায় কীভাবে যেতে হবে তার ম্যাপ এঁকে দিয়েছিলো শামীন। এমনকি কোথায় গাড়ি পার্ক করলে বেশি হাঁটতে হবে না, তাও বলে দিয়েছিলো। অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে তাতে সুবিধাই হয়েছিলো। আর এই সুবিধা হওয়ার ব্যাপারটা থাকে বলেই সব ব্যাপারে শামীনকে জিজ্ঞেস করা আনুস্কার অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। অনেক সময় আনুস্কা যতটা জিজ্ঞেস করে শামীন তার চাইতেও বেশি করে। মাঝে মাঝে মনে হয় এ সবের মধ্যে দিয়ে শামীন আনুস্কাকে  ওর উপর নির্ভরশীল করে ফেলছে, কিন্তু আনুস্কাই বা নির্ভরশীল হচ্ছে কেন? শামীন একটা নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে। মানুষের মন পড়তে  জানে যে কোন মানুষের প্রয়োজনে হাসি মুখে সহোযোগিতা করে। এক কথায় অসাধারণ ব্যাক্তিত্বের অধিকারী সে। আনুস্কা নিজেকে মৃদু তিরস্কার করে। শামীনকে নিয়ে এভাবে ভাবাটা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না। শামীন আনুস্কার আগে এই দেশে পি.এইচ.ডি  করতে এসেছিলো, একটা নতুন দেশ, শুধু নতুন নয় সম্পূর্ণ অন্য সিস্টেম ভিন্ন টেকনোলজির দেশে এসে এ্যাডজাষ্ট করতে সময় লাগে। কখনও কখনও কিছু ভুলও হয়ে যায়। তারপর নানা প্রতিকুলতা পেরিয়ে একটা শক্ত অভিজ্ঞতা হয়। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতার খুব কমই দ্বিতীয় বার কাজে লাগানোর সুযোগ আসে। শামীন ওর সেই অভিজ্ঞতাগুলো আনুস্কার ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছে। আর যখন দেখছে, এবারে কাজগুলো অনেক বেটার ওয়েতে হচ্ছে তখন একটা তৃপ্তি পাচ্ছে। তবে এই তৃপ্তিটার সঙ্গে অন্য একটা পরিতৃপ্তিও মিশে আছে। আনুস্কার কাছে নিজের গুরুত্ব বাড়ানোর পরিতৃপ্তি। সাধারণত গ্রিন কার্ডে বেশ সময় লাগে। তবে ভাগ্যিস এই দেশ পি.এইচ.ডি কে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। আনুস্কারও পি.এইচ.ডি ছিলো বলে আলাদা ক্যাটাগরিতে পড়েছিলো। বছর শেষেই গ্রিনকার্ড হাতে এসে গেছে। তারপর নিশ্চিন্ত, দেশে গিয়ে ফরেন এম্ব্যাসিতে ছোটাছুটির ঝামেলা নেই, না হলে প্রত্যেক বার ফিরে আসার আগে একটা টেনশন থাকত। আবার ফর্ম ভর্তি করো লাইন দাও, গ্রিন কার্ড না হওয়া পর্যন্ত মনের মধ্যে একটা টলোমলো ভাব থাকে। ওরকম অস্থিরতা নিয়ে চাকরিতেও মন দেওয়া যায় না। এমনকি কোন ভালো ফার্নিচারও কেনা যায় না। খুঁত খুঁত লাগে কবে চলে যেতে হয়। গ্রিন কার্ড হওয়ার পর মনটা বেশ স্থিতু হয়েছিলো। এখন তোমার ব্যাপার ইচ্ছে করলে থাকো। না হলে চলে যাও। সবটাই তোমার উপর। মনে আছে, একবার একটি বাড়িতে নিমন্ত্রণে গিয়েছিলো অনুস্কা। কয়েকটি কথা বলার পর ভদ্র মহিলা বলেছিলেন তোমার গ্রিন কার্ড হয়েছে? আনুস্কা অবাক হয়ে পাল্টা জানতে চেয়েছিলো, কেন বলুন তো? গ্রিন কার্ড হলে বন্ধুত্ব বাড়াবো। না হলে তো কিছুদিন পরে চলে যাবে। সে দিন আনুস্কা হতবাক হয়ে গিয়েছিলো গ্রিন কার্ডের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে বুঝেছে, কথাটা একেবারেই ফ্যালনা নয়। একটা অস্থায়ী জিনিসের সঙ্গে মনকে জড়িয়ে কী লাভ? দুঃখ পাওয়া ছাড়া, হয়তো এমন দুঃখ উনি ইতোমধ্যেই পেয়েছেন। তার থেকেই এই উপলব্ধি। তাই গ্রিন কার্ড না হলে বন্ধুত্ব করতে মন সায় দেয় না। বেশ কয়েক বছর নিশ্চিন্তে কেটেছিলো। কত বছর হিসেব ছিলো না। অবশ্য শামিনের মত কেউ ধারে কাছে থাকলে কিছুই ভুলে থাকার উপায় নেই, বসনিয়া রুগীর সাথে গ্রিল চিকেন করেছিলো একা খেতে ভালো লাগে না….শামিনকেও বলেছিলো আসতে, মেঝেতে বসে হাতে প্লেট নিয়ে শামীন হঠাৎ বললো, সিটিজেনশিপের অ্যাপ্লাইটা করে দাও। দাাঁড়াও, এই তো সবে গ্রিন কার্ড করে উঠলাম। আবার দৌড়াদৌড়ি..। সবে কী গো? পাঁচ বছরেরও বেশি হলো আর কবে করবে?

-তোমার কী? আমি যদি না করি? তা ছাড়াও এখনও ডিসাইড করিনি এ দেশে থেকে যাব কিনা।

সারাজীবন ধরে ডিসাইড করো। কত দেখলাম, যেতে চাইলে কিছুতেই আটকায় না বুঝলে? গ্রিন কার্ডও, সিটিজেনশিপও এমনকি ছেলেমেয়ে কিছুতেই না। ও কে বাবা, কিন্তু এটাও তো আবার লম্বা প্রসেস। হাজারটা কাগজপত্র, ফর্মফিলাপ করে জমা দেওয়া। তারপর ইন্টারভিউ। এ দেশের ভূগোল ইতিহাস রাজনীতি। যে দেশের নাগরিক হবে, সেই দেশ সম্পর্কে কিছু জানবে না? -জানি না কে বললো? অনেকের থেকেও বেশি জানি। তাহলে আর ভয় কিসের? শামীম উঠে প্লেটটা সিঙ্কে নামিয়ে দেয়। তবু যদি একটা গাইড লাইন থাকতো মানে কোনও বই-টই..। হ্যাঁ তা আছে। তবে জোগাড় করতে হবে। ফোনের মেসেজটা সে ব্যাপারেই। শুধু বলেছে বইটা জোগার হয়েছে। কিন্তু বলেনি কীভাবে সেটা আনুস্কার হাতে আসবে। হুঁ শামীনের এই জাতীয় সূক্ষ্ম চালাকিগুলো আনুস্কার চেনা। এবার আনুস্কাকেই জিজ্ঞেস করতে হবে, বইটা নিতে কখন আসবো? শামীন বলবে, শুক্রবার সন্ধেবেলায়।  তারপর কী কী ঘটবে তাও কম বেশি আনুস্কার জানা। আনুস্কা তাই তৈরি হয়েই যায়। সকালে অফিসে বেরনোর সময়ই ব্যাগ গুছিয়ে গাড়িতে তুলে রাখে। চশমাটা মনে করে নিতে হয়। কারণ ফিল্ম দেখতে আনুস্কার চশমা লাগে। গিয়ে দেখবে লিভিংরুমের টেবিলে দুটো গ্লাস। একটা মাড স্লাইডের বোতল। আর পাশে দুটো ডিভিডি। একটা বাংলা অন্যটা ইংরেজি। গতবারে দেশ থেকে আনুস্কারই এনে দেওয়া হালকা নীল ড্রেসিং গাউনটা পরে সোফায় বসে থাকবে নিজে দুটো পা সটান সামনের টেবিলে তুলে দেওয়া। আনুস্কা স্পষ্ট বুঝতে পারে। এর মধ্যে অনেক গুলোই আনুস্কাকে খুশি করার স্থূল চেষ্টা, গা জ্বলে যায়। অবাক লাগে যে বুঝতে পেরেও খুশি হয়ে থাকি। বিরক্ত লাগে। নিজের অনুভূতির উপর নিজের কোনও কন্ট্রোলই নেই। সবই শামীন নিয়ন্ত্রণ করে।

বাংলা ছবিটা হবে একদম লেটেস্ট। হয়তো দু’সপ্তাহ আগে রিলিজ হয়েছে। দেশে থাকতে আনুস্কা এ সব সিনেমা দেখতো না। কিন্তু এখন দেখে খুব সাগ্রহে দেখে। সিনেমার মধ্যে রাস্তাঘাট, দোকানপাট, মানুষজন দেখে মনে মনে দেশে চলে যায়, মনে হয় আড়াই ঘণ্টা দেশে কাটিয়ে এলাম। ইংরেজি বাংলায় হাঁক ডাক অনেকক্ষণ কানে ভাসতে থাকে। রাস্তার মোড়ের পানের দোকান, রিকশা-অটো, কুলি মজুর চোখের পাতায় লেগে থাকে অনেকক্ষণ। তারপর শামীনের পছন্দমতো ইংরেজি মুভি জমজমাট ডায়লগ, দুর্দান্ত সিনেমাটো গ্রাফি। স্মার্ট এডিটিং এই করে আনুস্কা এখন ইংরেজি সিনেমা সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে গেছে। এ দিনও এর সব কিছুই ছিলো। দুটো মুভির মাঝে ব্রেকে ডিনার সেরে ফেললো। এরকম দিনে সাধারণত আনুস্কাই ডিনারটা নিয়ে আসে। দুটো তিনটে বক্সেই হয়ে যায়। হয় চিকেন বিরিয়ানি না হয় চিকেন নুডুলস। মাঝে আনুস্কা বাথরুম গিয়েছিলো। ফিরে আসতে গিয়ে দেখলো শামীন গ্যারেজ থেকে ফিরছে। -কোথায় গিয়েছিলে?

-গ্যারেজে বইটা তোমার গাড়ির জানালা দিয়ে ভেতরে ফেলে দিলাম

-উঃ তোমাকে নিয়ে পারা যায় না। এতো তাড়া কিসের। এখনই তো যাচ্ছি না।

– তাড়া না থাকলেও কেউ কেউ আছে বহুক্ষণ থাকার পরও যে জন্য আসা সেটাই ভুলে যায়।

-উঃ তুমি কি মনে করো, তুমি না থাকলে আমি কিছুই করতে পারতাম না। ছোট বেলা থেকে পড়াশোনা করেছি এত পরীক্ষা দিয়েছি, কী  কী  ভুলে গেছি? তারপর এ দেশে এসেছি। সব ভুলে ভুলে? পারলে আমার চাকরিটাও তুমিই করে দিতে?

-দরকার হলে তাও করে দিব।

  • -আসলে আমাকে তোমার উপর নির্ভরশীল বানাতে তোমার ভালো লাগে। ছেলেদের যেটা জন্ম জন্মান্তরের স্বভাব।

আর কী করবে বলো, যার যা স্বভার, বলে দ্বিতীয় ফিল্মটা দেখিয়ে দিলো শামীন। ফিল্ম দেখতে দেখতে প্রত্যেক বারেই আনুস্কা সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়ে। শামীন একটা ব্ল্যাঙ্কেট ছুড়ে দিয়ে নিজের বেডরুমে চলে যায়। শামীনের বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে বেশ বেলা হয়ে গিয়েছিলো। বাড়ি ফিরে বাকি সময়টা ইন্টারভিউয়ের পড়া পড়েছে। কে জাতীয় অ্যানথেমের রচয়িতা, কনস্টিটিউশনের রচয়িতা কে? কে প্রথম প্রেসিডেন্ট? পড়া আর পরীক্ষা জীবনে শেষ হবে না। এ দেশে প্রথম এসে গাড়ির পরীক্ষা দিয়ে শুরু হয়েছিলো। তারপর চলছেই। ইন্টারভিউয়ের জন্য ছুটি নিতে হয়েছিলো। বেশ ভিড় ছিলো। আনুস্কার টার্ন আসতে লাঞ্চ টাইম পার হয়ে গিয়েছিলো। যারা আনুস্কার সঙ্গে বসেছিলো, তারা সবাই খাতা খুলে পড়ছিলো। আনুস্কার নাম যখন ডাকা হলো বেশ নার্ভাস লাগছিলো। হাজার হোক এর মধ্যে একটা ব্যক্তিগত পারা না পারার ব্যাপার আছে। একজন কালো মহিলা ছিলো ইন্টারভিউয়ে। সব প্রশ্নেরই তৎক্ষণাৎ উত্তর দিতে পেরেছে আনুস্কা, শুধু প্রথমটা ছাড়া। একটা কাগজে লেখা সব শর্তগুলো পড়ে শোনানোর পর ওই মহিলা জিজ্ঞেস করেছিলো ডু ইউ এগ্রি উইথ ইট? আনুস্কা বলেছিলো ইয়া। আবার পুরো প্রশ্নটা রিপিট করেছিলো মহিলা দ্বিধা জড়ানো গলায় কোথায় ভুল হচ্ছে চিন্তা করতে করতে আনুস্কা আবারও বলেছিলো ইয়া। কিন্তু বলেই সঙ্গে সঙ্গে বুঝেছিলো কী ভুল হচ্ছে। ভাগ্যিস তৃতীয় বার ভদ্রমহিলা প্রশ্নটা করেছিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে আনুস্কা বলেছিলো ইয়েস। ভদ্র মহিলার মুখে সন্তষ্টির রেখা ফুটলো। তারপর, পরের প্রশ্নে চলে গেলেন। ইন্টারভিউ দিয়ে বেরিয়ে আনুস্কা ভাবছিলো, এই ইন্টারভিউয়ের ঘর, ওই ভদ্রমহিলা পাশ করে বেরনোর পর মনের এই অনুভূতি, এই সব কিছুই এক একটি মূল্যবান অভিজ্ঞাতা, যা জীবনকে ক্রমশ সমৃদ্ধ করছে। এর প্রতিটি মুহূর্ত আনুস্কা উপভোগ করে। আর ভাবে ওর মনের পরিধি ক্রমশই বৃহৎ হচ্ছে। জীবন ছড়িয়ে পড়ছে। চারধারে এক জাতি থেকে অন্য জাতিতে। দেশ থেকে দেশান্তরে এবং এও বুঝতে পারে আরও ছড়িয়ে পড়বে। ক্রমশ সমৃদ্ধ হয়ে যাবে আনুস্কা। এই বৃহৎ প্রাপ্তির জন্য দেশকে ছেড়ে  আসার দুঃখকে মেনে দিয়েছে সে।

শপথ নেওয়াও হয়ে গেলো। ব্যাগের মধ্যে সিটিজেনশিপের সার্টিফিকেট। বর্তমান দুনিয়ার সুপার পাওয়ার দেশের সিটিজেনশিপ নেওয়ার লাইনে আনুস্কা দাঁড়িয়ে সবাইকে লক্ষ্য করছিলো। প্রায় প্রত্যেকে সার্টিফিকেটটা হাতে নিয়েই হেসে ফেলছে। আনুস্কা হাসেনি। কারণ আনুস্কার মন সিটিজেনশিপের চাইতে আরও গভীরতম, আরও অনেক বড় কিছু পাওয়ার অনুভূতিতে মগ্ন ছিলো। সেই মগ্নতা আনুস্কাকে নীরব করে দিয়েছিলো। প্রান্তরের মতো বিশাল ঘরটায় হাজার ভাষার কলরবের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে যখন একা একা পার্কিং লটের দিকে, তখন আনুস্কা বিশ্ব দর্শনের অনুভূতিতে আচ্ছন্ন। একটা ঘরে দুই হাজার মানুষ, যারা আজ এক সঙ্গে এদেশের নাগরিক হলো। যারা একটু পরেই এ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়বে। তারপর তাদের সন্তানেরা এ দেশেই জন্মাবে। বড় হবে। তারপর হয়তো একদিন ওই স্টেজের উপর দাঁড়িয়ে আরও দুই হাজার মানুষের নাগরিকত্বের ঘোষণা করবে। ওয়াকি টকি হাতে ঐ কালো পুলিশটার দিকে তাকিয়ে আনুস্কা দেখতে পায় ওর পূর্ব পুরুষকে অ্যালাবামার তুলা ক্ষেতে দাঁড়িয়ে থাকা কালো পাথরের মতো শরীর যার। অথবা ওই ভীষণ সফিস্টিকেটেড সাদা চামড়ার বিচারকটি যার পূর্বপুরুষ হয়েতো এসেছিলো কোন শিপিং কোম্পানির জাহাজের যাত্রী হয়ে। কষ্টকর এক যাত্রার পর নিউ ইয়র্কের হ্যাডসনবেতে এসে দূরে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি আর এলিস আইল্যান্ডের দেখা পেয়ে আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিলেন। ডান হাত বুকের উপর রেখে বাঁ হাতে নতুন ছোট পতাকাটি নিয়ে বিচারকের সঙ্গে সঙ্গে সবাই বলছে আই হিয়ার বাই ডিক্লেয়ার, অন ওথ দ্যাট আই অ্যাবসোলিউটলি এ আ্যাল্ড এন্টায়ারলি রিনাউন্স অ্যান্ড অ্যাবজিওর…। আনুস্কা তখন চারদিকে তাকিয়ে দেখছে, কোনও মুখ কিউবান, কোনও মুখ ভিয়েতনামী কেউবা এলো সালভাদরের অথবা মেক্সিকোর সবার একটিই আশা। একই উদ্দেশ্য এদের সবাইকে বিভিন্ন সুদূর গ্রাম অথবা শহর থেকে নিয়ে এসে এখানে একত্রিত করেছে। এদের সবার ছোটবেলায় রয়েছে আলাদা আলাদা কোন স্কুল, বাড়ি, অন্য রকম কোনও খেলার মাঠ অথবা অন্য কোনও সহপাঠীয় দল। যে সহপাঠীর দল সবাই মিলে হয়তো কোনদিন বেড়াতে গিয়ে কোনো পাথরের গায়ে নাম লিখে এসেছিলো। তারা সবাই হয়তো এক সঙ্গে আছে, শুধু এই একটি মুখ বিচ্ছিন্ন হয়ে আজ এখানে আনুস্কার মতো সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করে। পাশে অতিকায় পর্দার আলোর ফোয়ারা তারপর প্রেসিডেন্ট বলেন ‘ওয়েলকাম টু দি ফিউচার।’ সাবই আনন্দে হাতের পাতাকাটি ছুঁড়ে দেয় কেউ মাথার টুপি, শুধু আনুস্কা বাংলাদেশের পতাকা হাতে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে আর ফিউচার শব্দটি নিয়ে ভাবতে থাকে। তারও কী ফিউচার স্থির হয়ে গেলো এই দেশে? না না সে দেশে ফিরে যাবেই বাবা মায়ের কাছে। যখন প্রথম সে আসে ভেবেছিলো পড়াশোনা শেষ হলেই ফিরে যাবে। তারপর গ্রিন কার্ড হলো। শামীনের উৎসাহেই হয়েছে। এখন নাগরিকত্বও হয়ে গেলো সেটাও শামিনের উৎসাহ ও তাড়াতেই। কিন্তু আনুস্কাতো থামাতে পারতো। থামায়নি বরং ওর আনা ফর্মগুলোতে নিখুঁতভাবে সই করে গেছে। কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। মনে হাজার দোলাচল নিয়েও লোভের পথেই আনুস্কা নিজেকে গড়িয়ে দিয়েছে। আনুস্কা এখন বুঝতে পারে মনের মধ্যে ইচ্ছা থাকা এক জিনিস আর সেই ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার শক্তি জোগাড় করা অন্য ব্যাপার। আনুস্কা সেই শক্তি অর্জন করতে পারেনি। আর শামিনকেও বুঝতে পারে। শামীন আনুস্কাকে যেখানে এগিয়ে দিয়েছে সেখান থেকে আনুস্কা কোনদিনও ফিরতে পারবে না। এটা শামীন খুব ভালো জানে। একটা চাপা দুঃখকে নাড়াচাড়া করতে করতে আনুস্কা আরও ওই পথেই এগিয়ে যাবে। 

বই মেলা শুরু হয়ে গেছে আজ দ্বিতীয় দিন। আনুস্কা ছটফট করছে। বার বার তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে বাংলায় লেখা বড় বড় সাইন বোর্ডগুলো, লোকে লোকারণ্য বই মেলা প্রাঙ্গণ। চিন্তা হচ্ছিলো, টিকিটটা তো কেটে ফেললো বাংলাদেশে যাবার। এখন সিটিজেনশিপের সব কাজকর্ম মিটলে হয়। কিন্তু সত্যি এদেশের সরকারি কাজের রকম দেখলে তাজ্জব হতে হয়! এত বড় একটা কাজ এবং এতো জনের। কেমন সুন্দরভাবে হয়ে গেলো। এখন শুধু প্লেনে ওঠার অপেক্ষা। তা হলেই ঠিক সময় মতো বই মেলায় পৌঁছে যেতে পারবে। আনুস্কা দেশে গেলে শামীন এয়ারপোর্টে ড্রপ করে দেয়। শামীন দেশে গেলেও আনুস্কা তাই করে। এই প্রথম আনুস্কা যাচ্ছে অথচ শামীন পাশে নেই। আগে কখনও এরকম হয়নি। এবারে শামীন কনফারেন্সে শহরের বাইরে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলে শাটল নিতে হয়েছে। শাটলের নম্বরটা শামীনই ফ্রিজের উপর আটকে দিয়ে গিয়েছিলো। শপিং সবই হয়ে গেছে। আসলে সারা বছর ধরেই যেখানে যা পছন্দ কিনে রাখে। না হলে হুট করে কিনতে গেলে অনেক দাম পড়ে যায়। শুধু একবার খুব তাড়াতাড়ি আর্মস্ট্রং নার্সারিতে যেতে হবে। সকাল নটার আগে ওরা খোলে না। অতএব আগে গিয়ে নিয়ে আসবে তার উপায় নেই। গতকালই ওরা ফোন করেছিলো। গ্লাডিওলাসের হাইব্রিড বাল্ব এসেছে। আবারও তাজ্জব হয়েছিলো। আনুস্কা যখন খোঁজ করেছিলো তখনও এ বছরের গ্লাডিওলাসের বাল্ব এসে পৌঁছায়নি। ওরা বলেছিলো এলে জানাবে। সত্যিই জানাবে আনুস্কা ভাবতে পারেনি। যাক এবার তা হলে গ্লাডিওলাসের বাল্ব দেশে নিয়ে যেতে পারবে। এবার বাবাকে চমকে দেবে। আগের বার নিয়ে যেতে পারেনি। 

সকাল নয়টার আগে অন্য সব কাজ শেষ করে ফেললো। কম্পিউটারটা বন্ধ করার আগে শেষ বারের মতো মেইলটাও চেক করে নিলো। নাঃ নতুন কোন মেইল আসেনি। শামীন কি এতই ব্যস্ত। কে জানে? নার্সারি থেকে ফিরে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই বাইরে ট্যাক্সির হর্ন শুনতে পেল। সত্যি ট্যক্সিওয়ালাদের কি সময় জ্ঞান। ঘড়ি মিলিয়ে নেওয়া যায়। বাল্বগুলোকে ব্যাগের মধ্যে খুব যত্নে রাখতে হয়েছে। যেন বাতাস লাগে। দু’দিন ঠিকই থাকবে মনে হয়। রাস্তা ফাঁকাই ছিলো এয়ারপোর্ট মাত্র চল্লিশ মিনিট। বেরনোর আগে ছোটাছুটির পর ট্যাক্সিতে বসে হাত পা একটু শিথিল করলো আনুস্কা। ভাবনো না করেও শামীনই মাথার মধ্যে ভেসে উঠলো। আনুস্কা কী নিজে পারে না? সব কিছুই পারে এই তো এবারে তো সব কিছুই আনুস্কা নিজে করলো। সবই ঠিক আছে। শুধু প্রত্যেকবার একজন থাকে, সে এবারে নেই। শামীনের উপস্থিতির অভাবটা অনুভব হচ্ছে শুধু। সে তো যে কেউ থাকলেই হতো। তবুও কেন শামীনকে মনে পড়ে। ব্যাগের দিকে একবার দেখে নিলো আনুস্কা গ্লাডিওলাসগুলো ঠিক আছে কি না। জার্নির ধকলটা সহ্য করতে পারবে তো? দুটো দিন কোনও রকমে বেঁচে থাকলেই হলো। গিয়েই বাবার হাতে দিয়ে দেবে। তারপর আনুস্কার দায়িত্ব শেষ। এই এয়ারপোর্ট সব সময়ই গমগম করে। সারা পৃথিবীর লোকজন আসা যাওয়া করছে। অদ্ভূদ একটা গতিময়তা এখানেও, চেকিংয়ের লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখলো আনুস্কা। কতো দেশের বিভিন্ন জাতের মানুষ। শামীন থাকলে বলতো টিকিটটা ঠিক আছে তো? পাসপোর্টটা বের করে হাতে রাখো আর ফোন নম্বর লেখা নোট বুকটা যেন…। সত্যি আনুস্কা যেন কিছুই পারে না। কিছু মানুষ থাকে যারা অন্যকে অক্ষম বানিয়ে রাখতে ভালোবাসে। সামনে মাত্র আর একটি ফ্যামিলি। তবে এদের লোকের সংখ্যা একটু বেশি। সবার চেকিং চলছে সময় লাগবে। আনুস্কার নতুন পাসপোর্ট। কাউন্টারে পৌঁছতেই চকচকে নতুন পাসপোর্টটা এগিয়ে দিলো আনুস্কা। ছেলেটি পাসপোর্ট হাতে নিতে নিতে পাশের কাউন্টারের মেয়েটিকে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো হাউ ওয়াজ ইওর উইকেন্ড? বলতে বলতেই পাসপোর্টটা আনুস্কার দিকে এগিয়ে দিলো। তারপর বললো ‘হোয়ার ইজ ইওর বাংলাদেশি ভিসা?’ প্রথমে আনুস্কার মাথায় কিছু ঢুকলো না। ভিসা? কিসের ভিসা? ভিসা শব্দটা এখানে কেন? এবার আবার ছেলেটি জিজ্ঞেস করলো আপনি যে অন্য দেশে যাবেন? তার ভিসা কোথায়? অন্য দেশ মানে? অন্য দেশ তো নয়, এতো আমার নিজের দেশ। আমি বাংলাদেশি আর আমি বাংলাদেশেই যাচ্ছি। কিন্তু আপনার পাসপোর্ট বলছে আপনি আমেরিকান। কিন্তু আমি বাংলাদেশে জন্মেছি বড় হয়েছি। আমার সবইতো ওখানে বাবা মা লেখাপড়া, গলা বুজে এলো আনুস্কার। ছেলেটি চোখে মুখে একটু ব্যস্ততারভাব ফুটিয়ে বললো কিন্তু আপনি একমাস হলো আর বাংলাদেশি নন। তারপর মাথা হেলিয়ে আনুস্কার পিছনের দিকে তাকিয়ে বললো, নেক্সট। আনুস্কার পাসপোর্ট ধরে থাকা হাতটা কাঁপছে। গ্লাডিওলাসের ব্যাগটাকে পা দিয়ে লাইনের পাশে ঠেলে দিয়ে নিজেও সরে দাঁড়ালো। তারপর শূন্য দৃষ্টিতে এপাশ ওপাশ তাকালো। না! আজ তো পাশে কেউ নেই। ওখানে দাঁড়িয়েই ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করলো, তা হলে কি আমি যেতে পারবো না? শেষের দিকে কান্না মিশে গেলো গলায়। ছেলেটি অন্য একটি পাসপোর্ট দেখতে দেখতে বললো সরি ম্যাম আজ পারছেন না। ভিসা পেলেই যেতে পারবেন। আনুস্কা ভুলে গেলো যে, সে পি.এইচ.ডি করেছে এবং একটা নামি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরি করে। বললো, কোথা থেকে পাবো, কীভাবে পাবো? এখানে কিছু একটা ব্যবস্থা করা যায় না? ছেলেটি হেসে বললো, এটা তো ভিসা অফিস নয় ম্যাম, এটা এয়ারপোর্ট। পকেট থেকে ফোনটা বের করে অধৈর্য হয়ে ডায়াল করতে থাকলো সবচেয়ে পরিচিত নম্বরটা কারণ ওটাতেই বেশি অভ্যস্ত আনুস্কা। ফোন বেজেই যাচ্ছে। তারপর ওপার থেকে খুব শান্ত একটা গলা শোনা গেলো। হ্যালো? আনুস্কা রাগে ফেটে পড়লো, কী ব্যাপার ফোন ধরছিলে না কেন? আরও নিরাসক্ত গলায় শামীন বললো, আমার তো সব সময় ফোন সঙ্গে করে ঘোরার কথা নয়। থাকগে কী ব্যাপার? তোমার তো এখন এয়ারপোর্টে থাকার কথা! হ্যাঁ সব কিছুই তো খেয়াল থাকে। কখন কোথায় আমার থাকার কথা, এটা খেয়াল ছিলো না যে, আমার বাংলাদেশি ভিসা নেই? একবারও মনে করাওনি কেন? এবারে তোমার মধ্যে কেমন স্বার্থপর গা টান ভাব লক্ষ্য করছি। তোমার বলা হয়েছে? আর কিছু বলবে? এখন আর বলে কী হবে? বলার কী আছে? শোন তুমি একজন পি.এইচ.ডি করা মেয়ে এদেশে একা এসেছো, একাই থাক। তুমি যদি ভিসা ছাড়া এয়ারপোর্টে চলে যাও, আমার কী দোষ? জানতাম কিছু ভুল হবে এবার যে আমি সবকিছু খেয়াল করিয়ে দেইনি। হয়েছে হয়েছে থাক। কি বলবো? কী শুনতে চাও তুমি? তা হলে আমি এখন দেশে যেতে পারবো না। আমার বই মেলা শেষ হয়ে যাবে? সমস্ত বই আমার ওখানেই মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে? যখন সব বুকস্টল ভেঙ্গে ফেলবে। শামীন বললো ভিসা বের করতে হবে। তা হলেই যেতে পারবে তুমি। কিন্তু কবে? বই মেলার সারা মাঠ জুড়ে শুধু বড় বড় গর্ত থাকবে। তার মাঝে গিয়ে দাঁড়াবো আমি। আর আমার গ্লাডিওলাসের বাল্বগুলোও নষ্ট হয়ে যাবে। শেষের দিকে কণ্ঠস্বর থেকে আর কোন কথা বেরলো না আনুস্কার। নিঃশব্দ হয়ে গেলো দু’জনেই। বেশ কিছুক্ষণ পর শামীনের গলা শুনতে পেলো আনুস্কা। কী করবা এখন? কী ভাবছো? ভিসাটা বের করে ফেলো। কীভাবে? কোথায় যেতে হবে? কতদিন লাগবে? আমার ছুটিতো আজ থেকে শুরু হয়েছে। এখন একা একা ঘরে বসে থেকে ছুটিগুলো নষ্ট হবে? কান্না ভেজা গলায় বললো আনুস্কা।

বাড়ি ফিরে যাও শান্ত হও। সব কিছুরই এজেন্ট থাকে আজকাল। ভিসার জন্যও আছে। সমস্ত বাংলাদেশিদের সে ভিসা করে দেয়, তাদের ফোন নম্বরগুলো এক্ষুণি আমি দিচ্ছি তোমাকে। তোমাকে অফিসে যেতেও হবে না। শুধু বলতে হবে ‘আর্জেন্ট’ খরচ হয়তো একটু বেশি পড়বে। কিন্তু আর শোন কাগজ পত্রগুলো … আনুস্কা শুনছো? আনুস্কা ছলছল চোখ দু’টো মুছছিলো বারবার। শামীনের গলায় আবার সেই আনুস্কার প্রতি পুরনো দায়িত্ববোধ ফিরে আসছে…। আর কিছু শোনার দরকার নেই। উদাসীনতাও এক ধরণের অন্যায় অথবা অবহেলা। সম্পর্ক যে মানুষের সঙ্গেই হোক অথবা দেশের সঙ্গেই হোক তার যথাযথ পরিচর্যার দরকার। এ দেশের নাগরিকত্ব নিতে গিয়ে কখন যে নিজ দেশের নাগরিকত্ব হারিয়ে ফেলেছো খেয়াল করনি। ডুয়াল সিটিজেন শিপের অ্যাপ্লাই করবে এবার। শামীন ফিরে আসছে। দেশও আবার  নিজের হবে শুধু এর মধ্যে গ্লাডিওলাস গুলো হয়তো বাঁচতে পারবে না। 

3 thoughts on “ছোটগল্পঃ গ্রিন কার্ড – জাহ্নবী জাইমা(ঢাকা, বাংলাদেশ)

  1. সুন্দর মূল্যবোধের গল্প, ঝরঝরে।ভাল লাগল।

  2. খুব ভাল লাগল গল্পটা। ঘরে ফেরার অমোঘ টান সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।

  3. মানবতার কল্যাণে বিজয়ের ইতিহাস স্মরণীয় হোক

    নজরুল ইসলাম তোফা:: আজকের এ বাংলাদেশটিকে স্বাধীনের পিছনে প্রতীকিভাবেই চলে আসে মুক্তিযোদ্ধা, শহীদের রক্তে রাঙানো শহীদ মিনার, অসাম্প্রদায়িকতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইত্যাদি। এমন বিষয়গুলো আজকে প্রতীকিভাবেই প্রকাশ করানোর মাঝে বেঁধেছে সংঘাত। এই দেশের স্বাধীনতার পিছনে এমন কিছু বৃহৎ শক্তিগুলোর অবদানকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আজ এইদেশের মানুষ স্বাধীনতা অর্জন বা বর্জনের দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারেনি বলেই যেন তারা সিদ্ধান্তের নিরিখে দোলাচল। সেখানে তাদের প্রতিবাদটাও ‘ভঙ্গুর’। আর যথার্থ প্রতিবাদের ভাষায় উঠে আসে নিম্ন চেতনার কিছু ‘পোড়া টায়ারের গন্ধ’। তাদের আঘাত প্রত্যাঘাতের মাঝে জন্মদাগও মুছে যায়। অবাক হতে হয়, স্বাধীনতার ডাক দিয়ে যে পুরুষ বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল, তাকে নিয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিতে কথা বলায় বুক কাঁপেনা। তারা সংশোধনাগার থেকে আজও সঠিক ঠিকানায় পৌঁছাতে পারলোনা। এই দেশে কিছু কুচক্রী মহলের নিকট থেকে নিরুপায় হয়ে অনেক দূরত্বে যেন ‘সুশীল সমাজ’। কঠিন থেকে কঠিনতর এক বাস্তবতাকে পর্যায় ক্রমিক প্রহসনে রূপান্তরিত অসাধু মানুষ। যেকোনো ধর্মের দোহাই দিয়ে শুধুমাত্র চায়- ”ক্ষমতা”। এ লোভ যেন ইতিহাস বিকৃতির এক ভয়ানক লোভ। “কলমে বঙ্গবন্ধু, ভাস্কর্যে বঙ্গবন্ধু বা চেতনার বঙ্গবন্ধু’কে তারা নিশ্চিহ্ন করতে চায়। ভাববার সময় এসেছে। নতুন প্রজন্মের কাছে এদেশের বিজয়ের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য কতোটুকু সত্য থাকবে সন্দেহ হয়। তাদের এই ”সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত প্রতিবাদের সুরটা” হরহামেশায় কোথা থেকেই মস্তিষ্কে ভর করে।

    অসাম্প্রদায়িকতার বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িকতার এক তান্ডব যেন অনেকাংশেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিছুসংখ্যক ভিন্ন মনোভাব পোষণকারী এবং মতাবলম্বী মানুষদের গুরুত্ব দিয়েই যেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বা সংস্কৃতির আজ বিলুপ্তির পথে। মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধা ও জাতির পিতা “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের গর্ব এবং অহংকার”। মুুুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েই তো আমরা আজকে পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বলতেও পারি যে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ, আর তা দিনে দিনেই এসে দাঁড়িয়েছে প্রযুক্তি নির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশ। তরুণরা এদেশের খুব সত্য ইতিহাস খোঁজে পায়না বললেই চলে, আর অসত্য ইতিহাস জানলেও তাদেরমধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্বের রোগে ভুগবে। একটু বলতে চাই ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধে পরাজিত গোষ্ঠী- ‘জামায়াত, আলবদর, রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীরা’ ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে খুন করেছিল, আর তাদের নেতৃত্বদানকারী আরো কিছু চিহ্নিত দল ঐক্যবদ্ধ হয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বিজয়কে নস্যাৎ করার জন্যে চেষ্টা চালিয়েছিল। বিভিন্ন তথ্য মতে ইসলামিক সংগঠনগুলো জামায়াত-শিবিরসহ উগ্রপন্থী ইসলামিক দলই- স্বাধীনতার সার্বভৌমত্ব নস্যাৎ করার জন্য বিভিন্ন প্রকারের অপকর্ম, বিশৃঙ্খলতা এবং স্বাধীনতার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বা জাতির পিতার স্মৃতি মুছে ফেলার জন্যে অপপ্রচার চালিয়ে এই দেশের জনগণের মধ্যে আজও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেই আসছে। যা দেশের জনগণের ভিতরে একটি স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়েও ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হচ্ছে। এই দেশে স্বাধীনতা বিরোধী পাকিস্তানি দালাল’রা একের পর এক কৌশলে দেশবিরোধী নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তিলকে তাল বানিয়ে অন্যান্য যে গুলো ধর্মালম্বী মানুষদেরকে কোন ঠাসা করছে। বাংলাদেশের জনসাধারণ আজ ধর্মীয় জাঁতা কলেই নিরুপায়। তবুও আজ এই দেশের সত্য ইতিহাসকে তরুণপ্রজন্মের কাছে সঠিক চিন্তা ভাবনার জায়গা সৃষ্টি করে দিতে হবে। তাই, এই দেশের স্বাধীনতার বিজয়ের খুব সত্য কিছু ইতিহাস ধারাবাহিক ভাবে আলোচনা না করলেও একটু সংক্ষিপ্ত ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

    ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশের নিকট থেকে এই দেশের জনগণ স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই পাকিস্তানের দুই প্রদেশের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার ইস্যু নিয়েই সম্পর্কের অবনতি ঘটে, সেগুলোর মধ্যে কিছু তুলে ধরা যেতে পারে যেমন ধরুন ভূূমি সংস্কার, রাষ্ট্র ভাষা, অর্থনীতি এবং প্রশাসনের কার্য ক্রমের মধ্যে যেন দু’প্রদেশের অনেক বৈষম্য, প্রাদেশিক স্বায়ত্ত শাসন, পূর্বপাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও নানাধরনের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংঘাত সৃষ্টি হয়। মূলত ‘ভাষা আন্দোলন’ থেকে বাংলাদেশের মুুুক্তিযুদ্ধের নানা পটভূমি তৈরি হতে থাকে। একটু জানার চেষ্টা করি যে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকেই ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা’ বলা যায়। এ বাঙালিরা ১৯৫৪ সালের ”নির্বাচনে জয়ী” হওয়ার পরেও তারা ক্ষমতা পেয়ে পূর্বপাকিস্তান বা পূর্ববাংলাকে শাসন করার অধিকার পায়নি। ঠিক তখন পূূর্ববাংলার জনগণ মূলত “২১-দফা” প্রণয়ন করে জনগণকে সংঘ বদ্ধ করে রাজনৈতিক আন্দোলনের চিন্তা ভাবনা শুরু করে। আর ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে গিয়েও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করেছে, সেখানেই ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে’ পাকিস্তানের সেই সামরিক এবং বেসামরিক নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের জননেতা- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাপ্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসতে দেওয়া হয়নি কিংবা অস্বীকার করেছে। তাইতো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তার প্রতিবাদে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল। তিনি ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বা বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জন-সমুদ্রে ঘোষণা করেছিল, ”এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,.. এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তারই ঘোষণায় সাধারণ মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। এরপরে ১৯৭১ এ ২৬ মার্চে আবার বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিলে বাংলার মুক্তিকামী মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মুুুক্তি যুদ্ধে অংশ নেয়। দীর্ঘ ৯ মাস রক্ত ক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর চুড়ান্ত বিজয় সূচিত হয়। অর্জিত বাংলার স্বাধীনতা। ২৬ মার্চ আর ১৬ ডিসেম্বর দুটি দিবস কিংবা দিনকে বুঝতে বা বুুঝাতে হয়তো বা অনেকেরই সমস্যা হয়। ‘‘স্বাধীনতা দিবস’’ ২৬ মার্চ আর ‘’বিজয় দিবস’’ ১৬ ডিসেম্বর এ দুটি দিবসকে গুলিয়ে ফেলি। স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসটাকে নিয়ে বহুজনেরই উলটাপালটা হয়। পেপার পত্রিকাতেও এ ভুল অনেকের চোখে পড়ে। দু’জায়গার কথাগুলোকে গুলিয়ে ফেলেই একাকার করে দেয়। পরিস্কার ধারণার আলোকেই বলতে হয়,- বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসটা হচ্ছে ২৬ মার্চ তারিখে পালিত হওয়া এক জাতীয় দিবস, এইটিকেই ১৯৭১ সালের ‘২৫ মার্চ’ রাতে তৎকালীন- পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আনুষ্ঠানিকভাবেই যেন স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করে। আর সেই মুহূর্তের রাতের পর দিনটি আসে ২৬ মার্চ, আর সে দিনটাকে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতা দিবস বলছেন। আরো পরিষ্কার ভাবেই বলতে চাই,- ২৬ মার্চের রাত বারোটা থেকেই এ দেশের জনগণ স্বাধীনতা দিবস পালন করে আসছে। কারণটা হলো যে, ১২টার পর মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তান কিংবা এ বাংলাদেশের জমিনে যতধরণের পাকিস্তানী সেনারা ছিলো তারা যেন হয়েই গেলো ‘বিদেশী হানাদার শত্রু বাহিনী’ এবং তাদের নিজস্ব এই জন্মভূমির মাটি থেকে তাড়াতে যে যুদ্ধ শুরু হলো- সেটাই হচ্ছে ‘মুক্তিযুদ্ধ’, স্বাধীনতার যুদ্ধ একথাটা- “একটু ভুল”। আর ‘২৬ মার্চ’- থেকেই যদি আমরা শুরুর প্রক্রিয়াতে স্বাধীন না হই তাহলে, মুক্তিযুদ্ধটা কিন্তু আর- ‘মুক্তিযুদ্ধ’ থাকে না, পাকিস্তানের সঙ্গে গৃহযুদ্ধ হয়ে যায়। সুতরাং, এমন বিদেশী দখলদার বাহিনীদের সহিত দীর্ঘ- ”নয় মাস” আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে এদেশে ‘বিজয়’ আনে, তাই তো আমরা পেয়েছি ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস।

    এ পৃথিবীতে মাত্র দুইটি দেশ- “স্বাধীনতার ডাক বা কথা” ঘোষণা দিয়েই দেশ স্বাধীন করেছে। এ ‘বাংলাদেশ আর আমেরিকা’। সেই হিসাবে ২৬ মার্চ থেকেই এ বাংলাদেশ স্বাধীন, তা অবশ্যই সাংবিধানিক ভাবেই প্রতিষ্ঠিত, এটা নিয়ে আদৌ তর্কের কোন অবকাশ নেই। বলা প্রয়োজন যে, পাকিস্তানের শাসকরাই চেয়ে ছিল ক্ষমতা সব সময় পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছে থাকুক। সুতরাং তারা যেন দিনে দিনে পূর্ব পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশের মানুষকে যাঁতা কলে বন্দি রাখার বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে।পূর্ব পাকিস্তানের ‘পাট’, ‘চামড়া’ বা ‘চা’ রপ্তানি করেই যে বিদেশি মুদ্রা আয় হতো- তা পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন কাজে চতুরতার সঙ্গে তারা ব্যয় করতো। পূর্ব পাকিস্তান এর চাষ করা ফসলের বাজার দাম পশ্চিম পাকিস্তানেই অনেক কম আর পূর্ব পাকিস্তানে অনেক বেশি। এই সব অসংখ্য তথ্য রয়েছে। যা পূর্ব পাকিস্তান এবং আজকের বাংলাদেশের সকল জনতা মেনে নিতে পারেন নি। আর ভেতরে ভেতরে যেন একধরনের ক্রোধ সৃৃষ্টি হয়েছিল এ দেশের জনগণের। সারা পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের এ দেশ তখন মিছিলের নগরী হয়েছিল।

    ১মার্চ পাকিস্তানের সেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেব জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার পরে বিভিন্ন কাজে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান মুখোমুখি অবস্থানেই দাঁড়িয়ে যায়। পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠির মুখোশ উম্মোচিত হয়। পূর্ববাংলার জনসাধারণ বুুঝতে পারে এইবার তারা আলাদা জন্ম ভূমি গড়তে পারবে। এ দেশের পরিস্হিতি যদিও আয়ত্তের বাইরে চলে যায়, তবুও ৩ মার্চে ঢাকাতে ‘কারফিউ জারি’ করে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়েছিল। এই খবর বাংলার জনতা জানার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার বাইরের যারা তাদেরও যেন দেশের জন্য উত্তেজনা বাড়তে শুরু করেছিল। আর সেই সময়ে মিছিলমিটিংয়ের নতুন গতি পেয়েছিল। আবার ২মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এদেশের পতাকা ওড়িয়েছিল ডাকসুর ভিপি, আ স ম আব্দুর রব আর ৪মার্চে ঢাকায় স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেছিল ছাত্রলীগ নেতা, শাহজাহান সিরাজ। তার ভিত্তিতেই বলা যায় এই দেশে কারফিউ হয়ে ছিল। আসলেই মার্চ থেকে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার দৃষ্টান্তমূলকভাবে আলোচনা করার ইচ্ছা থাকলেও অল্প পরিসরেই তা সম্ভব হচ্ছেনা। তবুও বলি এদেশটা পাওয়ার উদ্দ্যেশে আওয়ামীলীগের ডাকেই সকাল ছয়টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত জোরদার ভাবে হরতাল পালিত হয়েছিল।

    জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশনায়- দুপুর আড়াইটা থেকেই বিকেল ৪ টা পর্যন্ত অতি জরুরি কাজ করার জন্যে সরকারি বেসরকারি অফিস কিংবা ব্যাংক খোলে রাখার নির্দেশ দিয়েছিল। তাছাড়াও তিনি জরুরি সার্ভিস, হাসপাতাল, ঔষধের নানান দোকান অ্যাম্বুলেন্স সহ সংবাদ পত্র এবং সংবাদ পত্রের গাড়ি, পানি, বিদ্যুৎ, টেলিফোন এইগুলো সেই হরতালের বাহিরে রেখে ছিল। এক কথায় বলতে গেলে, জাতির জনক “বঙ্গবন্ধু” যা যা বলেছিল তাই ঘটেছিল। তার নির্দেশে পূর্ববাংলার সকল জনতা একীভূত হয়ে এই দেশটি স্বাধীন করেছে। আরো জানা দরকার, ৬ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ‘ইয়াহিয়া খান’ রেড়িওতে জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দেয়। এতেই ”২৫ মার্চ” জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বসার ঘোষণা ছিল। আর তার সঙ্গে বিশৃঙ্খলা যেন না হয়, এক প্রকার হুমকি বা ধমক দিয়েছিল। তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তা একেবারেই যেন সহ্য করতে পারেননি, তিনিও ৭ মার্চের ভাষণেই তার অনেক জবাব দিয়ে ছিল। আবার ১৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আমাদের পূর্ব পাকিস্তান আসে এবং ১৬মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়ার গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়। সে বৈঠকে কোনো কাজ না আসলে বঙ্গবন্ধু- ”শেখ মুজিবুর রহমান” বাংলা ছাড়ার ডাক দেন। ক্ষুব্ধ ‘ইয়াহিয়া’ রাগেই যেন ফোঁস ফোঁস করে। এ ধরনের আরো অনেক বৈঠক হয়েছিল। কিন্তু কোনো প্রকার কাজ হয়নি। অনেকাংশে তাদের কাল ক্ষেপণের মধ্য দিয়ে যেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকেই- গোলা বারুদ, সৈন্য-সামন্ত বাংলার জমিনে খুব দ্রুত গতিতে আসতে থাকে। তখনই পূর্ববাংলার মানুষরা যুক্তিতর্কের উর্ধ্বে উঠেই যেন স্বাধীনতা অর্জনের নেশায় উম্মত্ত হয়ে যায় এবং যার যাছিল গাইতি, বল্লম, রামদা, বর্শা, লাঠি এই গুলো নিয়েই রাস্তায় নেমে পড়ে। সুতরাং তারাই তো আমাদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’, তাঁরা এই বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে।

    বাংলাদেশের “স্বাধীনতা সংগ্রাম” ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং শোষণের বিরুদ্ধে। ১৮ মার্চ এক অসহযোগ আন্দোলনে ১৬ দিনেই তারা “পদার্পণ করে”। এ আন্দোলনের ঢেউ গ্রাম হতে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। সংকটাপন্ন অবস্থায় এইদেশ, যুদ্ধ চলছে, চলছে লাশের মিছিল। ২০ মার্চ জয়দেবপুরের রাজ-বাড়ীতেই অবস্থিত ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি দক্ষ ‘ব্যাটালিয়ন’ তাদের হাতিয়ার ছিনিয়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্রকে ‘নস্যাৎ’ করে দেয়। তারপরে শহর হতে গ্রামাঞ্চলের অসংখ্য মানুষ একত্রিত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তারা সবাই মিলে টঙ্গী এবং জয়দেবপুরের মোড়ে একটা ব্যারিকেড গড়ে তোলে নব নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের সদস্য, মোঃ শামসুল হকের নেতৃত্বে। ২২ মার্চে শহর হতে গ্রাম পর্যন্ত স্বাধীনতার জন্য বাঙালী সংগ্রামে গর্জে ওঠে। এমন ভাবে যতই দিন রাত অতিবাহিত হচ্ছিল, ‘’রাজনৈতিক সঙ্কট’’ ততই গভীরতর হয়ে যাচ্ছিল। এর পরে আরও আসে, ইতিহাসের একটি ভয়ালতম কালোরাত্রি। সে কালো রাতটা যেন বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে আতংকের রাত। পশ্চিমপাকিস্তানের সামরিক সরকার থেকে গণ হত্যার নির্দেশ আসে। তখন ব্যাপক পরিমাণেই পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের সমাগম ঘটে। অপারেশন সার্চ লাইটের নামে নির্বিচারে গণ হত্যা শুরু হয় এমন রাতে। ২৫ মার্চ কালো রাত ও অপারেশন সার্চলাইট অপারেশনে নেমেছিল সেই কুচক্রী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মাধ্যমে যেন নির্বিচার হত্যার সাথে সাথেই জ্বালাও পোড়াও স্বাধীনতাকামী বাঙালীর কণ্ঠস্বরটাকে বুলেট দিয়ে চিরতরে স্তব্ধ করার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। এ অপারেশনের মূল লক্ষ্য ছিলো ইপিআর (“ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস”, বর্তমানে বিজিবি) ও এই দেশের পুলিশ সহ বাঙালী সেনা সদস্যদের নিরস্ত্র করা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ আওয়ামীলীগ এর নেতা এবং গুরুত্ব পূর্ণ ১৬ জন ব্যক্তির বাসায় হানা দিয়ে তাদেরকে গ্রেফতার করে। জ্বলছে ঢাকা আর মরছেও বাঙালী’রা। একই সাথে শুরু হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার প্রথম প্রহর। এ ভাবেই ‘’মুক্তিযুদ্ধ’’ চলতে চলতে যখন হানাদার পাকবাহিনী বুঝে গেল পরাজয় তাদের অনিবার্য তখনই তারা এ পূর্ব বাংলাকে মেধা-শূন্য, পঙ্গু, কিংবা নেতৃত্বহীন করার জন্যই ১৪ ডিসেম্বর রাজাকার, আল-বদর, আল -শামস বাহিনীর সহযোগিতায় অন্ধকার রাতে হত্যা করে বহু সংখ্যক অধ্যাপক, প্রকৌশলী, ডাক্তার, আইনজীবী, শিল্পী বা কবি-সাহিত্যিকদের। তথ্যের আলোকেই প্রথম সারির দু শতাধিক বাঙালি বুদ্ধিজীবীকে হত্যার মাধ্যমে ইতিহাসের একটি কলঙ্কময় অধ্যায়ের সূচনা করে ছিল।এই দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই প্রায় দুই লাখ মা বোনদের ইজ্জতের বিনিময়ে এই ‘স্বাধীনতা’৷ আবার বহু জন তাঁদের মূল্যবান ধনসম্পদকেও হারিয়ে ছিল। ‘অগ্নি সংযোগ’, ‘নারী ধর্ষণ’, ‘গণহত্যা’, ‘সংঘর্ষ’ কিংবা ‘হামলা’, আর লুটতরাজের মতো অনেক অপ্রীতিরক ঘটনা-ঘটে যাওয়ার পরও বাঙালির চেতনায় যেন স্বাধীনতা ছিল।

    ইশতেহারে বলাই ছিল, আজ থেকেই “স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ” এমন ঘোষণার কথাটা পূর্ণবাংলার মানুষের প্রাণশক্তি, আর তাইতো ৫৪ হাজার বর্গমাইলের ৭কোটি মানুষের আবাস ভূূমির নাম হবে বাংলাদেশ, এতে‌ আজ বাঙালি গর্বিত। মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের পর যুদ্ধ সুকৌশলে চালিয়েই পাক-বাহিনীর আত্ম সমর্পণের মধ্য দিয়েই ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় করেছে। সুতরাং, অভ্যুদয় ঘটেছে স্বাধীন বাংলাদেশের। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হয়ে ছিল বাঙালি জাতির মুল কর্ণধার। সারাবিশ্বের দরবারে বা মানচিত্রে সংযোজিত হয়েছে ‘নতুন ও স্বাধীন’ এদেশ, ”গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ”। এই বাংলার জনপ্রিয় নেতা,- ”বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান” জেল থেকে বাহির হয়েই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল আর তিনিই এ দেশের স্থপতি, তাকে স্মরণীয় ও বরণীয় করে রাখার জন্যেই প্রতিকী ভাস্কর্য নির্মাণ করা জাতির কাছে হবে অনেক গর্বের বিষয়। তাছাড়াও তরুণ প্রজন্ম আগামীতে মহান ব্যক্তিকে স্মরণ করায় হয়তো বাধাগ্রস্ত হবে। ভুলে গেলে কি চলবে, তিনিই ছিলেন সকল জাতি‌ পেশার একজন‌ অসাম্প্রদায়িক নেতা। সুতরাং যুুুুগেযুগে এমন কালজয়ী সর্বশ্রেষ্ঠ মহানায়কের হাত ধরে অর্জিত হওয়া “লাল সবুজের জাতীয় পতাকা” এবং তাঁর ভাস্কর্য অক্ষন্ন রাখা আমার, আপনার অসাম্প্রদায়িক চেতনাতে লালন করা উচিত।

    লেখক:
    নজরুল ইসলাম তোফা, টিভি ও মঞ্চ অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, কলামিষ্ট এবং প্রভাষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *