শ্রীমদ্ভাগবত কথা২ – ভূমিকা গোস্বামী

শ্রীমদ্ভাগবত কথা২
ভূমিকা গোস্বামী

ছবি- সংগৃহীত

বেদান্ত দর্শনের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ব্রহ্মসূত্র। ব্রহ্মসূত্রের দ্বিতীয় সূত্র হচ্ছে —

“জন্মাদস্য যতঃ……সত্যং পরম ধীমহি” এই সূত্র নিয়েই শ্রীমদ্ভাগবতের আরম্ভ। এই দুটি গ্রন্থেরই লক্ষ্য, চরম বস্তু ব্রহ্ম। এই শ্লোকটির তাৎপর্য হল —-পরম সত্যরূপ পরমাত্মাকে আমরা ধ্যান করি।

ভাগবতে কৃষ্ণ, রাম, শিব সহ সব ভগবানের নাম ও তাঁদের কথা থাকলেও ভাগবতের শুরু হয়েছে ” সত্যং পরম ধীমহি ” দিয়ে, শেষও হয়েছে ” সত্যং পরম ধীমহি” তে। এটা ভাবার বিষয়।

ব্যাসদেব ভাগবত রচনা করেছেন। এর আগে মহাভারত সহ অনেক পুরাণ রচনা করেছেন। ঐতিহাসিক সময় বিবেচনা করলে ব্যাস একজন ব্যক্তি হতে পারেন না। মনে হয়, ব্যাস কোন ইন্সটিটিউটের নাম ছিল। ব্যাস অর্থ বিস্তার করা। বেদকে যিনি বিস্তার করেছেন তিনি বেদব্যাস। ভাগবত যিনি রচনা করেছেন তিনি বাদরায়ণ ব্যাস। বদরি মানে কুল। তিনি কুল খেয়ে থাকতেন তাই হয়তো অমন নাম।
সাহিত্যগুণ বিচারে অপূর্ব সাহিত্য এই ভাগবত গ্রন্থ। যেমন তার উপমা , প্রাকৃতিক বর্ণনা তেমন তার ছন্দ। অতুলনীয় এই গ্রন্থ।

ব্যাসদেব যখন আঠের হাজার শ্লোকের ভাগবত রচনা শেষ করলেন । তখন তাঁর ভাবনা হল এই গ্রন্থ সমস্ত লোকের কাছে কেমন করে পৌঁছবে । তাঁর পুত্র শুকদেব আত্মারাম । ব্রহ্মজ্ঞ। জ্ঞানী। কিন্তু সংসার বিরক্ত। বারো বছর বয়সেই দিগম্বর সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ করে বনে চলে গেছেন।
ভাল কোনকিছু সৃস্টি করলেই তো হবে না। জগতের কল্যাণের জন্য প্রচার প্রয়োজন। তার জন্য ঠিকঠাক দক্ষ লোকের প্রয়োজন। আদর্শ সাহিত্য মানুষকে সঠিক পথ নির্দেশ করে। ভাগবত সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে ব্যাসপুত্র শুকদেব শুধুমাত্র ব্যাসপুত্র বলেই নয়, সঠিক পাত্রও। ছেলে শুকদেবের মুখে ভাগবত পাঠ আরও মধুর এবং কল্যাণকর হবে এটা তিনি বুঝেছিলেন। তাই একটি কৌশল করলেন। প্রতিদিন শিষ্যরা যখন কাঠ কাটতে জঙ্গলে যেত তখন একটি করে আকর্ষণীয় শ্লোক ওদের মুখস্ত করে পাঠাতেন। আশা একটাই — যদি শুকদেবের কানে যায়।

এমনই একদিন শুকনো কাঠ কাটতে কাটতে শিষ্যরা ভাগবতের দশম স্কন্ধের একুশ অধ্যায়ে বেণুগীত থেকে পঞ্চম শ্লোকটি গাইছেন –শুকদেবের কানে গেল। অবাক হয়ে শুনলেন।

বর্হাপীড়ং নটবরবপুঃ কর্ণয়োঃ কর্ণিকারং
বিভ্রদ বাসঃ কনককপিশং বৈজয়ন্তীং চ মালাম্।
রন্ধ্রান বেণোরধরসুধয়া পূরয়ন গোপবৃন্দৈ-
র্বৃন্দারণ্যং স্বপদরমণং প্রাবিশদ্ গীতকীর্তিঃ

ব্রজ গোপীরা কৃষ্ণের বাঁশি শুনে মোহিত হয়ে মানস নেত্রে দেখছেন—গোপবালকদের সাথে শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে প্রবেশ করছেন। তাঁর প্রতি পদক্ষেপে , প্রতিটি অঙ্গ সঞ্চালনে হিল্লোলিত হয়ে উঠছে অলৌকিক ছন্দ। তিনি যে নটশ্রেষ্ঠ, দিব্যগন্ধর্ব ! ময়ূরপুচ্ছ তাঁর শিরোভূষণ, দুই কর্ণে তাঁর পীত কর্ণিকার পুষ্প। অঙ্গে ধারন করে আছেন পীতবসন। সোনার দ্যুতি বিকীর্ণ হচ্ছে তা থেকে। গলায় দুলছে বৈজয়ন্তী মালা। মুরলীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভরে দিচ্ছেন তাঁর অধরসুধা।
সঙ্গী গোপবৃন্দ তাঁর কীর্তি গাইতে গাইতে চলেছেন তাঁর পাশেপাশে।

পরে আর একদিন ব্যাসশিষ্যরা কৃষ্ণের পুতনামোক্ষণ বিষয়ের শ্লোক গাইছেন। এই শ্লোকে বলা হয়েছে যে, পাপী পুতনা কৃষ্ণকে বধ করার উদ্দেশ্যে স্তনে কালকূট বিষ মিশিয়ে পান করিয়েছিল। সেই পুতনারও সমস্ত পাপ ক্ষমা করে তাকে বৈকুণ্ঠে ধাত্রী গতি দিলেন শ্রীকৃষ্ণ।এত করুণাময়। এত দয়া তাঁর !
শুকদেব ব্রহ্মজ্ঞানী তো ছিলেন। ব্রহ্মজ্ঞ সবই জানেন। তাঁর জানার কিছু বাকী ছিল না। তবু একটি কথা তিনি জানতেন না যে, পরব্রহ্ম এত করুণাময়। কারণ বেদান্তের ব্রহ্মে করুণাশক্তির বিলাস নেই। যেটা ভাগবতের ভগবানে আছে। তিনি যে প্রিয়স্বরূপে পতি, পুত্র, সখা।

জল আর বরফ একই বস্তু। জলে তৃষ্ণা মেটে । বরফে সেটা হয় না। তেমনই। তাই ব্রহ্মজ্ঞানী শুকদেবেরও ভাগবতে লোভ।
ডেকে বললেন ব্যাসশিষ্যদের

-তোমরা এই মধুর শ্লোক কোথায় পেলে ?

– আমাদের গুরুর কাছ থেকে।

– আরোও আছে?

– হ্যা, অনেক অনেক আছে।

– কে তোমাদের গুরু ?
ওদের মুখে নিজের পিতার নাম শুনে ভাগবত আস্বাদনের জন্য লোলুপ হয়ে পিতা- ব্যাসের কুটিরে আসেন শুকদেব।

চলবে

One thought on “শ্রীমদ্ভাগবত কথা২ – ভূমিকা গোস্বামী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *