সাংবাদিকের নিরাপত্তা ও কতগুলি প্রশ্ন
অনিরুদ্ধ সুব্রত
এই সংখ্যার সাম্প্রতিকী লেখার পূর্বে আমরা বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো রচিত ‘সক্রেটিসের বিচার’ গ্রন্থে কাল্পনিক চরিত্র ইউথীফ্রোন ( গ্রন্থ নাম) -এর সঙ্গে সক্রেটিসের সামান্য কথোপকথন উল্লেখ করা যাকঃ
” সক্রেটিসঃ তুমি বলছ যে একই কাজ কেউ ঠিক বলে মেনে নেন এবং অন্য কেউ ভুল বলে মনে করেন ; এই মতানৈক্যের কারণেই তর্কাতর্কি এবং কলহের জন্ম । মারামারি মৃত্যু তার পরবর্তী ঘটনা ।
ইউথীফ্রোনঃ হ্যাঁ তাই তো দেখা যাচ্ছে ।
সক্রেটিসঃ ধরো কোনও একটি সংখ্যা অপর একটা সংখ্যার চেয়ে বৃহত্তর কিনা এ নিয়ে তোমাতে আমাতে মতভেদ হলো । কিন্তু সেজন্য কি আমাদের ক্রোধ হবে কিম্বা পরস্পরের প্রতি শত্রুতা জন্মাবে ? এই বিরোধটি কি সংখ্যা গণনা করলেই তৎক্ষণাৎ মিটিয়ে ফেলা যায় না ?
ইউথীফ্রোনঃ অবশ্যই যায় ।
সক্রেটিসঃ দুটি বস্তুর আকার , ওজন সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠলে তাহলে নিশ্চয়ই আমরা তার প্রকৃত পরিমাপ নেব।
ইউথীফ্রোনঃ অবশ্যই তাই।
সক্রেটিসঃ তাহলে আমাদের ক্রোধান্বিত এবং পরস্পরের শত্রু করতে পারে একমাত্র মতের অমিল? ভ্রম ও ভ্রমহীনতার, মাননীয়তা ও নীচতার, ভালো ও মন্দের প্রশ্ন নয়, প্রকৃত প্রশ্ন হলো মূল সত্যের জ্ঞান ও ধারণার পার্থক্যের ।”
গত ১লা ডিসেম্বর লখনৌ-এ একটি স্থানীয় সংবাদ পত্রের একজন সাংবাদিক এবং তার বন্ধুকে স্যানিটাইজার ঢেলে পুড়িয়ে মারার ঘটনার খবর প্রকাশিত হয়েছে । সংবাদে আরও যা জানা যায়, ঐ ঘটনার অভিযোগ পেয়ে পুলিশ এ পর্যন্ত অভিযুক্ত তিন জনকে গ্রেপ্তারও করেছে।
মৃত সাংবাদিক রাকেশ সিংহ নির্ভীক, স্থানীয় মহিলা পঞ্চায়েত প্রধানের বিরুদ্ধে সৌর প্যানেল সহ একাধিক বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগের সংবাদ সন্ধান বিষয়ক লেখালেখি করেন স্থানীয় কাগজে। এটাই ছিল তার একমাত্র অপরাধ । আর সেই অপরাধের শাস্তি দিতে ঐ পঞ্চায়েত প্রধানের ছেলে অন্য দুই শাগরেদ সহ সাংবাদিককে খুনে প্রবৃত্ত হয়। এমনও জানা যায় যে, এই খুনকে দুর্ঘটনার রূপ দিতে অ্যালকোহল যুক্ত স্যানিটাইজার ব্যবহার করা হয়। যদিও পুলিশ সত্য জেনেছে এবং অপরাধীরা এখন তাদর হেফাজতে ।
ডেভিড বীথাম ও কেভিন বয়েল তাঁদের ‘গণতন্ত্র’ পুস্তিকায় অনেকটা এই ভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবাদ সংস্থা এবং সাংবাদিকের কাজ হলো অতন্দ্র প্রহরা। প্রতিটি সরকারের জনসংযোগ বিশাল প্রক্রিয়ার মাঝখানে প্রকৃত তথ্য সরবরাহ করে জনগণকে সরকারের দাবি ও ঘাটতি উভয় যাচাই করতে পারার সুযোগ করে দেওয়া । যদিও প্রচার মাধ্যম এবং সাংবাদিকতার সাফল্য নির্ভর করে মূলত সাংবাদিক, সম্পাদক ও কর্মীদের স্বাতন্ত্র্য এবং পেশাদার নিষ্ঠার উপর। ‘
এখন প্রশ্ন হলো, ভারতীয় সাংবাদিকতায় নিরাপত্তার গ্যারান্টি ? সত্যিই কি তা নির্ভরযোগ্য ? গণতন্ত্রকে ধ্বজায় প্রতিষ্ঠা দিলেও এদেশের প্রাক্টিক্যাল অভিজ্ঞতা আলাদা । সে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু তদন্ত থেকে শুরু করে স্বাধীন ভারতে হাজার এক ঘটনায় বারংবার প্রমাণিত ।
সরকারি রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি খাটিয়ে সাদাকে কালো ও কালোকে সাদা করার খেলায় এই দেশ মেতে রয়েছে যথারীতি । তথ্য প্রমাণ লোপাটে এক শক্তি আর এক শক্তির চেয়ে কোনও অংশে কম নয় । বহু অভিযোগে আইন আদালত পর্যন্ত সঠিক সমাধান সূত্রে পৌঁছাতে পারে নি। সম্প্রতি পুলিশের সহযোগিতাও তথৈবচ, প্রয়োজনে তারা তাৎক্ষনিক এনকাউন্টার করে মুছে দিতে সক্ষম গোটা ঘটনার ছক।
এই রাজ্যেও সাংবাদিক নিগ্রহের খবর মাঝে মধ্যেই অল্প বিস্তর ঘটে থাকে। যেন ঘটাটাই স্বাভাবিক! কিন্তু আগামী কাল যারা ভোট চাইতে রাস্তায় রাস্তায় বেরবেন, যারা সরকারি প্রচারে পঞ্চমুখ এবং যারা সরকারেরই খুঁত ধরতে সদা তৎপর প্রত্যেকেই যদি গণতন্ত্রের সেবক হন ,তবে সাংবাদিকতার প্রতি সম্মান রাখুন। জনগণকে অসত্যের গোলকধাঁধায় ফেলে যত রাগ গিয়ে বর্তাবে সত্য সন্ধানী পেশাদার সাংবাদিকের উপর ? এসব আর কত দিন ? তাছাড়া চাপসৃষ্টির রাজনীতি সমকালের নব্য ভোটাররা ঠিক কী চোখে দেখে — তার হাল হকিকত সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের থাকাটাই তো স্বাভাবিক ।
খ্রিস্ট পূর্ব চতুর্থ শতকে মহান যুক্তি দ্রষ্টা সক্রেটিস যে সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন সহজে, আজ পঁচিশশো বছর পরও আমরা সত্য বা প্রকৃত তথ্যের দিকে তাকাবো না ! কেবল কলহ, দ্বন্দ্ব, বিতর্ক, বিবাদ আর হত্যা মৃত্যুতে সত্যের উপর খবরদারি চালাবো ! সাংবাদিকতায় নিরপেক্ষতা নিয়ে যেমন আমাদের প্রশ্ন থেকে যায়, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা বা জীবনের গ্যারান্টি নিয়েও ভরসা থাকে না কেন । ভারতীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে এর গ্রহণযোগ্য উত্তর দিতে হবে, কেন্দ্র রাজ্য উভয় স্তরেই ।
লেখাটি যথাযথ। অভিনন্দন।
সঠিক মূল্যায়ন। এরকম লেখার জন্য ধন্যবাদ ভাই।
একদম প্রাসঙ্গিক লেখা। সত্যিই এখন সময় এসেছে এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর জানার। নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা কিন্তু সাংবাদিকদের এখন নেই।