প্রসঙ্গ পৃথিবী – কবি জীবনানন্দ দাশ / রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

Jibanananda Das - Wikipedia

প্রসঙ্গ পৃথিবী – কবি জীবনানন্দ দাশ
রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

কবি জীবনানন্দ দাশের রচনা ও জীবন নিয়ে বহু আলোচনা মূল্যবান প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় বারবারই প্রকাশিত হয়েছে এবং হয়ও। কবি জীবনানন্দ বিষয়ে কিছু বলা ধৃষ্টতা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

স্বাভাবিক ভাবে বাংলার মানুষের কাছে কবি জীবনানন্দ এক অফুরন্ত ভালোলাগার কবি তাঁর যথেষ্ট মাত্রা মেনে চিত্রকল্প সৃজনের জন্য। উপমা যেমন মহাকবি কালীদাসকে চিরকাল আমাদের দেশে, দেশ ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে স্মরণ্য করে রাখবে বলে ধরে নিয়ে তাঁর সম্পর্কে দুচার কথা বলার চেষ্টা করা যায়, তেমনই চিত্রকল্পও আমাদের দেশে ও দেশের বাইরে সর্বাগ্রে কবি জীবনানন্দ দাশের সম্পর্কে সামান্য দুএক কথা বলার আগেই স্মরণ করতে হবে, কেননা বাংলা ভাষায় কবিতাকে কবিতা করে তুলেছিলেন তিনি।
কবি জীবনানন্দ এক সময় প্রত্যক্ষ করেছিলেন ঘরে ঘরে হতাশ্বাস, ক্ষুধা, আক্ষেপ, বিশ্বাসভঙ্গের
ছবিগুলি। কবি হৃদয়ের আবেগ নিয়ে তিনি ছটফট করেছেন। কেননা তিনি এই সমাজের মধ্যেই বেড়ে উঠেছেন, তাই সমাজের দুঃখ কষ্ট বঞ্চনার প্রতি বিরক্ত বিতৃষ্ণ হয়েছেন বারবার। তাই, নির্ভেজাল অকৃত্রিম আবেগ নিয়ে সৃষ্ট হয়েছে তাঁর কবিতাগুলি। তিনি যেন ‘নিসঙ্গ একাকী ‘ যেখানে তাঁর ‘ বোধ ‘ তাঁকে নতুন কিছু শোনানোর জন্য, বলার জন্য তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে। অস্থির পারিপার্শ্বিক অবস্থায় থেকেও দারুণ দৃঢ়তার সঙ্গে স্থির অচঞ্চল হয়ে বলেছেন — স্বপ্ন নয়, শান্তি নয় কোন্ এক বোধ কাজ করে,
মাথার ভিতরে।

বাংলার গাছ-গাছালি, পুকুর, নদী, পাকুড়, মেঠো ইঁদুর, পচা শশা, ডিমের খোলা, হিজলের বন, নিম পেঁচা, বাঁকা চাঁদ, গৃধিনী ইত্যাদি তাদের জায়গা পেয়েছে কবির কবিতায়। অভূতপূর্ব চিত্রকল্পের মাধুর্যে সিক্ত তাঁর সৃষ্টি। তিনি বাংলার গাছগাছালি জলের মধ্যেকার মানুষ। কবি কখনো একাকী হননি তবুও তিনি লেখেন ‘ তবুও আমি একাকী ‘।তিনি প্রাণ ভরে দেখেছেন বাংলাকে আর তাই বলতে পারেন ‘ বাঙলার মুখ আমি দেখিয়াছি ‘ তিনি পৃথিবীর রূপ খুঁজতে চান নি। তবু কবির লেখায় পৃথিবী এসেছে বারবার।
হ্যাঁ, নিতান্ত সাধারণ ডুমুরের ছাতার মত বড় বড় পাতার নীচে বসে ভোরের দোয়েল পাখির মত একান্ত নিজস্ব বাংলাকে ভালবেসেছেন কবি। কবিহৃদয় কিন্তু ব্যথিত হয়েছে হাজারো বার, দেশ জন্মভূমি বাধ্য হয়েই ছেড়ে আসা, দাঙ্গা, মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা, উষ্ণ শোণিতধারা কবিহৃদয়কে ব্যথিত করে তোলে ‘সেদিন এ ধরনীর ‘ কবিতার মধ্যে আমরা যেন শুনতে পাই তিনি সাধারণ মানুষের মতোই প্রায় কেঁদে ফেলেন —
‘ আমার এ শিরা উপশিরা
চকিতে ছিঁড়িয়া গেল ধরণীর নাড়ির বন্ধন
শুনেছিনু কান পেতে জননীর ক্রন্দন —
মোর তরে পিছু ডাক মাটি মা — তোমায়।’

এহেন বাংলার কবির রচনায় পৃথিবী প্রসঙ্গ এসেছে নিজে নিজে এবং তা সঙ্গত কারণেই। স্বাভাবিক ভাবেও। বিশ্ব বোধের জন্য কবিকে কখনো কারো কাছে হাত পাততে হয় নি, না কোনো বিশ্ববিখ্যাত জননেতা, না কোনও ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বিশ্বাসের কাছে। সমগ্ৰ বিশ্বের সঙ্গে কবির একাত্মবোধ একটি অনিবার্য ঘটনা। কবির লেখায় সারা বিশ্বের অনেক কিছুই স্থান করে নিয়েছে, নিয়েছে খুব সহজেই। প্রাচীন মিশরের পিরামিড, ধূ ধূ দিগন্তের মূক মরুভূমি, লোহিত সাগর, পীত সাগর, আরব সাগর, বেবিলন এরকম ইতিহাস ভূগোলের নানান সব চিহ্নে প্রদক্ষিণ সেরে ‘ কল্লোলিনী তিলোত্তমা সম্ভবা কলকাতা এসবই কবির কবিতায় নিজ নিজ যথাযথ জায়গা খুঁজে নিয়েছে।
এই সব দৃশ্যপটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কবি ঘোষণা করেন একাত্মতার কথা, অনুভব করেন পৃথিবীর জাতকদের যন্ত্রণা।
‘ জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে সন্তানের মত ‘ দের সঙ্গে কবি মিলিয়ে নিতে চান। তিনি বলেন — ‘ কিম্বা যারা পৃথিবীর বীজ থেকে আসিতেছে বলে জন্ম দেবে বলে, তাদের হৃদয় আর মাথার মতন আমার হৃদয় নাকি ?’

পৃথিবী শব্দ বারবার ব্যবহার হতে হতে কখনও মনে হয়নি আরোপিত, বরং স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক নিয়মেই ঘটেছে। কবি তো ঋষি। ঋষিতুল্য কবির বোধ তো সাধারণ মানুষের চাইতে অন্য রকম হবেই। তাঁর হৃদয় সুদখোর, মহাজন, নিম পেঁচা, যুদ্ধবাজ মানুষ, হিংসুকদের মত নয়। তিনি কবি তাই চান না কখনো রুধির সিক্ত হোক প্রিয় ধরণীর বক্ষ। তাঁর আবেগ ভালবাসা পৃথিবীর জন্য —
‘- – – – পৃথিবীর প্রেতচোখ বুঝি
সহসা উঠিল ভাসি – – – ‘

‘ মৃত্যুর আগে ‘ কবিতায় দেখি –‘ – – – – একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিল – সোনা ছিল যাহা নিরুত্তর শান্তি পায়, যেন কোন্ মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে।- কী বুঝিতে চাই আর ?

  • – – রৌদ্র নিভে গেলে পাখি পাখালির ডাক ?
    শুনিনি কি ? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখিনি কি উড়ে গেছে কাক ?’

কবি পৃথিবীর সন্তান, অন্যরাও পৃথিবীর সন্তান, তাই পরস্পর পরস্পরের মধ্যে প্রবাহিত এক ভ্রাতৃত্বের, বিশ্বভ্রাতৃত্বের স্রোত ধারা।
কবির হৃদয় তাবৎ সব সন্তানবতী মায়েদের সৃষ্টির জন্য ছটফট করা প্রাণ ওষ্ঠাগত যন্ত্রণার সঙ্গে যেন মিলেমিশে যায়। কবির হৃদয় মন সৃষ্টির যন্ত্রণায় আর উৎকণ্ঠায় হয়ে যায় অস্থির। বিশ্বের সঙ্গে একাত্মতার আকুলতাই কবির বৃহত্তর ‘আমি’ টাকে নিজস্ব ‘ বোধ ‘-এ মগ্ন করে তোলে। মাঝে মাঝে হয়তো ‘ পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ ‘ চায়। সে তো সাময়িক ! পৃথিবীর টান তাঁর কাছে অনিবার্য এবং আন্তরিক। তাই তাঁর স্বগোক্তি —
‘ আমি ঝরে যাবো — তবু জীবন অগাধ
তোমারে রাখিবে ধরে সেইদিন পৃথিবীর পরে আমার সকলগান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে। ‘ তিনি বলেন আরও —
‘ যে পৃথিবী জেগে আছে, তার ঘাস-আকাশ তোমার- – -।’
অন্যত্র ‘ অবসরের গান ‘ – এ পৃথিবী অন্যরূপে প্রতীয়মান। বিরক্ত ভৎর্সনামুখর কবি —
‘ – – -রোধ-অবরোধ-ক্লেশ-কোলাহল শুনিবার নাইকো সময়, জানিতে চাই না আর সম্রাট সেজেছে ভাঁড় কোন্ খানে —
কোথায় নতুন করে বেবিলন ভেঙে গুঁড়ো হয়;
আমার চোখের পাশে আনিওনা সৈন্যদের মশালের আগুনের রঙ;
দামামা থামায়ে ফেল —পেঁচার পাখার মতো অন্ধকারে ডুবে থাক রাজ্য আর সাম্রাজ্যের সঙ।’
যুদ্ধ দাঙ্গা রক্ত পাতে পৃথিবীর মতই যন্ত্রণাবিদ্ধ কবিহৃদয়। ক্ষত বিক্ষত হৃদয় দিয়ে কবি অনুভব করেন —
‘- – – অলস মাছির শব্দে ভরে থাকে সকালের বিষন্ন সময়,
পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পাড়ের দেশ বলে মনে হয়।- – –

পৃথিবীর বহুদিনের সজ্জনবাঞ্ছিত ভ্রাতৃত্ববোধ, সুখ ও শান্তি –এসবকে ধ্বংস করার জন্য কতনা কলকাঠি ! ধর্ম, সাম্প্রদায়িকতা, জাতপাত, বিচ্ছিন্নত, ভাষাগত পার্থক্য, দলাদলি, রেষারেষি,
নানান ভাবের বিচ্ছিন্নতা কত কিছুকেই না অবলম্বন করে নিত্য ঘটে চলেছে রক্তপাত, হচ্ছে হিংসার নব্য অজুহাতের সূত্রপাত। ঘৃণা, প্রচণ্ড ঘৃণা ছিল কবির।
তবুও কবি সযত্নে উপেক্ষা করতে চাইতেন এসব। কবি বৈরাগী নন, তিনি ঋষি, ঋষির সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ স্বাভাবিক, না হলে কবিতার সৃষ্টি সম্ভব হতো না।সম্ভব হতোনা বেদ উপনিষদ ইত্যাদির রচনা। সুন্দরের টানে কবি চলে আসেন ‘ ক্যাম্প ‘-এর অদূরে জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রির মোহনীয় পরিবেশে যেখানে হরিণী বারবার থেকে থেকে আহ্বান করে আর সুন্দরের পিয়াসী কবিহৃদয় হয়ে যায় অনেক পায়ের শব্দে পুরুষ হরিণদের একজন হয়ে —
‘- – – আমার হৃদয় – এক পুরুষ হরিণ –
পৃথিবীর সব হিংসা ভুলে গিয়ে
চিতার চোখের ভয় – চমকের কথা সব পিছে ফেলে রেখে তোমাকে কি চায় নাই ধরা দিতে ? – – – — -‘।

3 thoughts on “প্রসঙ্গ পৃথিবী – কবি জীবনানন্দ দাশ / রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

  1. ভীষণ ভাল লাগল পুরো প্রবন্ধটি।কবি এবং প্রাবন্ধিকের প্রতি রইল আমার অকৃত্রিম শ্রদ্ধা…💐🙏

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *