মুক্তগদ্যঃ সৌমিত্র তুমি – পার্থ রায়

সৌমিত্র তুমি
পার্থ রায়

ইঙ্গিত ছিল ব্রেক আপের। চলে যাবে, চলে যাবে করে সইয়ে নিচ্ছিলে। যাতে আগাম মানসিক প্রস্তুতি বিচ্ছেদের আঘাতকে কিছুটা হলেও সামাল দিতে পারে। তাই না অপু? কিন্তু যতই ইঙ্গিত দাও কিছু ব্রেক আপ যে মেনে নেওয়া যায় না। হৃদয়তন্ত্রী ছিঁড়ে ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায়। করোনা ভাইরাসের থেকেও ভয়ঙ্কর ভাবে মিশে গেছ। নিঃশব্দে, চুপিসারে। আপামর বাঙালির হৃদয়, ফুসফুস, মস্তিস্ক জুড়ে। আমাদের যাপনচিত্রে। মূল পার্থক্য কোথায় জানো? করোনাকে যখন প্রতি মুহূর্তে অভিসম্পাত দিয়ে দূর দূর করছি, তোমাকে তার থেকেও বেশি অন্তরে, মননে সুপ্রথিত করেছি। ভুলে গিয়েছিলাম কালের লিখন। সবাইকেই একদিন চলে যেতে হয় সেই না ফেরার দেশে। বার্ধক্য হল এক নৃশংস খুনি। পরিচিত, অপরিচিত বহু সুন্দর মুখকে নির্মমভাবে অসুন্দর করেছে। ভুল কিছু বললাম? সিনেমা জগতেই তোমার সমসাময়িক যারা তাদের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো। কেন মহানায়িকা? সেই ভুবনমোহিনী হাসিকে অক্ষত রাখার জন্য নিজেকে নিঃশব্দে স্বেচ্ছা নির্বাসিতা করেছেন। এমনকি শেষ সময়েও নিজেকে লোক চক্ষুর আড়ালে রেখেছেন। আর তুমি? যত দিন গেছে তত রঙিন হয়েছ। অন্য রকম মাধুর্য। চির সবুজ! চির প্রেমিক! চির সুন্দর!
**
সে কি আজকের কথা? কয়েক যুগ। যতদূর মনে পড়ে “অপুর সংসার” এ প্রথম দেখেছিলাম। যুবক অপুর গাল ভর্তি দাড়ি, আলুথালু চুল যে কী ভীষণ মেল সেক্সুয়ালিটির প্রতীক হতে পারে এখনকার নিখুঁত ভাবে কামানো নির্লোম শরীরের ফরাসি আফটার শেভ মাখা নায়করা কি বুঝবে? কাঁখে তোমার চরিত্রগত ছেলে। মুখের এক্সপ্রেসনে স্নেহ উজাড় করা এক আদর্শ বাবার মুখ। ওয়ার্ল্ড সিনেমার এক সুপরিচিত জনপ্রিয় সিম্বল। শুধু কী বাবা? জ্ঞাতসারেই হোক বা অজান্তে তোমার সৃষ্ট প্রতিটা চরিত্রর সাথে কী ভীষণভাবে কানেক্ট করতে পারি। আদর্শ শিক্ষক কেমন হয় তা প্রত্যক্ষ করেছি “আতঙ্ক”, “কোনি”, “হীরক রাজার দেশে” দেখে। শিখেছি নীতি, আদর্শ, সততা ধরে রাখতে গেলে অনেক মূল্য দিতে হয়। এক দলা আবেগজারিত মণ্ড নির্লজ্জের মতো চোখ ভাসিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে যখন দেখি তুমি পূর্ণ চক্রবর্তী সেজে নিজের ছেলের পিণ্ড খাচ্ছ। “সাত পাকে বাঁধার” মতো নায়িকা প্রধান সিনেমাতে মহানায়িকার সাথে সমানে সমানে টক্কর দিয়েছ। আবার সেই তুমি ‘’প্রনয় পাশা” তে আমাদের অতি প্রিয় সুচিত্রাকে হত্যা করতে উদ্যত। কেন “ঝিন্দের বন্দী”? সরু গোঁফের হাড় হিম করা নৃশংস চাউনিতেও সুকৌশলে মিশিয়েছ সেক্সুয়ালিটি। যেসব নারী দুষ্ট, প্রবল পুরুষ পছন্দ করে, আমি নিশ্চিত কোন নিভৃত দুপুরে অথবা নিঃসঙ্গ নিশীথ শয্যায় তারা তোমার ময়ূরবাহনকে বুকে টেনে নিয়েছে। আমরা তো ছিলাম “বসন্ত বিলাপের” শ্যাম। মেদিনীপুর রেল স্টেশনে ট্রেন, নুতন চাকুরি সব ছেড়ে ছুড়ে দুরুদুরু বুকে প্রেমিকার জন্য অপেক্ষা করা শ্যাম। কোন চোর যে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পারে, “সংসার সীমান্তে” না দেখলে কি জানতে পারতাম?
ভাগ্যিস তুমি স্টার নও। উত্তমের সাথে তোমার তুলনা সব বিত্তের এবং বৃত্তের বাঙালির অতি চর্চিত আলোচ্য বিষয়। বাস্তবিক “উত্তম”, “সৌমিত্র” এই দুটো নাম আমাদের রক্ত, অস্থি মজ্জায় মিশে আছে। তবে একটা কথা না বলে পারছি না। উত্তমকুমারও বহুদিন ঘরের ছেলে ছিল। তারপরে নানা কারণে যত দিন গেছে ক্রমশ স্টার হতে হতে কিছুটা হলেও প্রতিদিনের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে। স্বপ্নের নায়কদের মতো। তোমার ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটা। টিভির পর্দায় বিস্কুটের বিজ্ঞাপন বলো বা চপ্পলের, সবখানেতেই তুমি। অথচ এতোটুকু ক্লিশে হয়ে যাচ্ছ না। বরং আরও যেন আপন হয়ে উঠেছ। স্টার হলে বোধহয় সচেতনভাবে এমন করতে না বা পারতে না।
**
গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে যখন মেঘমন্দ্র গলায় তুমি “ইতি অপু” পাঠ করছ। মৃত্যুকে হেলায় নস্যাৎ করে দিয়ে বলছ “মৃত্যু আয় তিন পাত্তি খেলি”। আমি নাহয় প্রবীণ। বার্ধক্যের সীমানায় দাঁড়িয়ে। তোমার যৌবন বয়েসের সিনেমা দেখে বড় হয়েছি। কিন্তু আমার ছেলে মেয়ে? তারা তো এই প্রজন্মের প্রতিনিধি। তোমাতে মুগ্ধ। ফেসবুকে কিছু অসামান্য শ্রদ্ধাঞ্জলি পড়লাম। যারা লিখেছে তারা সবাই এই প্রজন্মের। কী অবলীলায় সেখানেও আধিপত্য কায়েম করে বসে আছো। ছায়াছবির মত গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডে বিদ্বান, সংস্কৃতিমনস্ক, রুচিবান ভদ্রলোকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। বসন্ত চৌধুরী, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়দের মতো তুমি তেমনি একজন। জীবনে একটা আক্ষেপ থেকে যাবে। তোমার নাটক দেখা হয়নি। সেখানেও তো অনন্যসাধারণ ছিলে।
বেলা ফুরিয়ে আসে। জীবন চলতে থাকবে তার নিজের নিয়মে। সময়ের স্তর জমতে জমতে শোকের উত্তাপ স্তিমিত হয়ে আসবে। ধ্রুব সত্যি। কিন্তু কেউ কেউ রয়ে যায় অমলিন, তুমি তাদেরই একজন। বেলাশেষেও গোধূলির রঙের মতো শান্ত দীপ্তমান। ভাল থেকো অপু। যতই ব্রেক আপ করো “তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম…”।

One thought on “মুক্তগদ্যঃ সৌমিত্র তুমি – পার্থ রায়

  1. কি অপূর্ব লেখা!! দুর্দান্ত। প্রতিটি বাক্যের সাথে সহমত হলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *