সাম্প্রতিক ৮ঃ অনিরুদ্ধ সুব্রত

পুনশ্চ লোকাল ট্রেন ও শাক্ত পদাঞ্জলি – অনিরুদ্ধ সুব্রত

‘বল্ মা আমি দাঁড়াই কোথা…’
লোকাল ট্রেনের নিত্যযাত্রীদের এই পরিচিত সংগীতটি দীর্ঘ সাত মাসের বেশি সময় বন্ধ । কেউ ওয়ার্ক ফ্রম হোম, কেউ বা গাঁটের কড়ি ঢেলে কোনও মতে অফিস রক্ষা । কিন্তু ফাঁকে পড়ে রীতিমতো কাজ হারিয়েছেন এক বিরাট শতাংশের মানুষ ।কাউকে খুঁজে নিতে হয়েছে বিকল্প কাজ ও ক্ষেত্র । পাশাপাশি ভারতীয় রেলের আর্থিক ঘাটতির পরিমাণও এই সাত মাসে আশঙ্কাজনক স্থানে পৌঁছেছে।
কিন্তু যখন আনলকের পঞ্চম পর্যায়ের শেষে জনজীবনে রেলের দৈনিক চাহিদা সম্পর্কে যথেষ্ট বোধ হলো, তখন সাধারণ নিত্যযাত্রীদের সংগীতটি গেল বদলে —
– ‘ডুব দে রে মন কালী বলে’
কোভিড সংক্রমণের খবরে মানুষের এক জাতীয় অনীহা ইতিমধ্যে তৈরি হতে পেরেছে । কেননা দীর্ঘ রোগ-ভোগ আর সুদীর্ঘ কর্মহানি, দেশের সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিম্ন বিত্তের কাছে জীবন ক্রমশ অনুভূতিহীন এক স্তর । যা শুধুমাত্র মৃত্যু সংখ্যার লাল বাতি দেখে থেমে যাওয়ার নয়। মিডিয়ায়ও একটা সময় খুব খাইয়েছে ‘কোভিড নাইনটিন-এর প্রতিষেধক টিকা কাহিনী’ । আতঙ্কিত মানুষ সে খবর গিলেছেও গোগ্রাসে। তবু মনে মনে দারস্থ হয়েছে শক্তি বা শাক্ত গানে– ‘ আমি কি দুখেরে ডরাই ?
দুখে দুখে জন্ম গেল,আর কত দুখ দেও,দেখি তাই।’
রাজনৈতিক ধুরন্ধর পুঙ্গবরাও একটা ক্ষেপ খেলতে চেয়েছিলেন এই ‘টিকা কাহিনি’ নাটকের ব্যাকস্টেজে। অথচ দীর্ঘ লকডাউন, দীর্ঘ কর্মচ্যুতি, আর্থিক দুরবস্থা এবং কোভিড সংক্রমণ যথারীতি চলতে থাকা দেখে একটা সময় সাধারণের গান হয়ে উঠল–
‘মা আমায় ঘুরাবি কত,
কলুর চোখ ঢাকা বলদের মতো।’
এই কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেও বিহার বিধানসভার ভোট দান, ভোট গ্রহণ,গণনা, ফলাফল ইত্যাদি মিটে যাওয়ায় কোভিড পরিস্থিতিতে ভোট নেওয়ার অ্যাসিড টেস্টটা হয়ে গেল । ইতিমধ্যে রাজনৈতিক জনসভা শুধু বিহার কেন নানা রাজ্যে মাঝে মধ্যেই চলছে ।কখনও রাজনৈতিক প্রতিবাদী মিছিলও। এ রাজ্যে হাইকোর্ট বলল বলে একটু দূরে দাঁড়িয়ে পুজো দেখলাম । তাছাড়া বাজার, হাট তো চিরকালই খেলা ভাঙার খেলায় ছিলই। কিন্তু সব দোষ গিয়ে দাঁড়ালো ঐ লোকাল ট্রেনের বগিতে। কত হুতাশী সুর ছিল নিত্য পঞ্চাশ, একশো কিলোমিটার জার্নি করা মানুষের কন্ঠে—
‘ এখনও কি ব্রহ্মময়ী, হয় নি মা তোর মনের মতো ?’
অথচ লোকাল ট্রেন চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আলোচনার কেন্দ্রে সেই দূরত্ব বিধি । আতঙ্কের সবচেয়ে বড়ো কারণ ট্রেনের সংখ্যা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। রেলের এই নিউ নরম্যাল ইকুয়েশন, অর্থাৎ কম সংখ্যক ট্রেন চলানো আদৌ কি কোনও সমাধানের পথ ? যেহেতু দূরত্ব মেনে স্টেশনের প্লাটফর্মে দাঁড়ানো, টিকিট কাউন্টারে লাইন দেওয়া এবং ট্রেনে উঠে দূরে দূরে থাকা দস্তুর । সেখানে প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্প সংখ্যক ট্রেন চালানোর দর্শনটা আসলে কী ? পাবলিক দিশাহারা হয়ে গায় নি কি—
‘ মা গো তারা ও শঙ্করী
কোন্ অবিচারে আমার পরে করলে দুঃখের ডিক্রী জারি ?’
ঠাসাঠাসি ভিড় এড়াতে বেশি সংখ্যক ট্রেন চালানোই একমাত্র সঠিক পথ ছিল না কি ।কিন্তু রেল খরচ ও পরিষেবার দিক নিয়ে যতটা চিন্তিত ছিল, বাস্তবে মানুষের দীর্ঘ স্তব্ধ জীবন নিয়ে কোনও চেতনাই ছিল না । এমনকি এত গুলো মাস রেলের চাকা না ঘোরার জন্য আগে যে সংখ্যক লোকাল চলত, প্রয়োজন ছিল তার থেকেও আরো বেশি সংখ্যায় চালানো। পরিস্থিতি কিন্তু এই সত্যকে স্বীকার করতে বাধ্য । রাজ্যের ব্যস্ততম শিয়ালদা ও হাওড়া স্টেশনের প্রথম ট্রেন চালু হওয়ার দিনের ভিড় এবং হুড়োহুড়ি তা প্রমাণ করে দিয়েছে। সাধারণ নিত্যযাত্রী বা অন্যান্য সাময়িক যাত্রীদের সম্পূর্ণরূপে ভুলে যেতে হয়েছিল কোভিডের নিষেধাজ্ঞা সমূহ । তখন হয়তো গাইতে চেয়েছে সাধারণ,
‘ ফিরিয়ে নে তোর বেদের ঝুলি।
ও মা মজাস্ নে আর আমায় কালী।।’
ভিড়ের ঠ্যালায় মনে মনে ধ্বনি পেয়েছিল শক্তি সাধনার শাক্তগান— ‘তারা এবার আমারে করো পার।
তরঙ্গে পড়েছি শ্যামা, না জানি সাঁতার ।।’
কিন্তু অতি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো রেল পরিষেবা দানকারী ব্যবস্থার পূর্ব অভিজ্ঞতা বা অভ্যাস কোনও সু পরিকল্পনা করার সুযোগ পায় নি ? দীর্ঘ কালক্ষয়,আলোচনা, কী ফল দিয়েছে ? কেন পূর্ব পরিকল্পনাহীন ভাবে লোকাল ট্রেনের চাকা গড়ালো ট্র্যাকে ? শিয়ালদা থেকে অফিস ফেরতা বনগাঁ লোকাল, ক্যানিং লোকাল বা সন্ধ্যেবেলায় হাওড়া থেকে ঘরমুখী মানুষ নিয়ে যত ট্রেন এতকাল চলেছে তার সাধারণ যাত্রী সংখ্যার কোনও হিসাব রেলের কাছে নেই ? সকালে অফিস টাইমের পাবলিকের সোসাল ডিসট্যান্স থাকা না থাকা রেলের কাছে আদৌ সতর্কতার বিষয় নয় ? না কি সেখানেও শেষে এই শাক্ত সংগীত–
– ‘দোষ কারও নয় গো মা,
আমি স্বখাদ সলিলে ডুবে মরি শ্যামা। ( পড়ুন, ডুবিয়ে মারি)’
তবু একটা যৌক্তিক সমাধানের প্রত্যাশায় থাকতে চাই । পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এই অতি মারী পরিস্থিতির পরবর্তী পর্যায়ে রেল সড়ক পরিষেবা ক্ষেত্রে আর্থিক ঘাটতি মাথায় নিয়েও যেভাবে জন কল্যাণমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে , আমরা তার খুব সমান্তরাল কিছু আশা না করতে পারলেও, অন্তত লোকাল ট্রেন সংখ্যা বৃদ্ধির আকাঙ্খায় থেকে এই শক্তি সাধন লগ্নে গাইতে পারি— ‘এমন দিন কি হবে তারা,
যবে তারা তারা বলে, তারা বেয়ে পড়বে ধারা ‘ (???)

ছবি- সোসাল মিডিয়া থেকে

One thought on “সাম্প্রতিক ৮ঃ অনিরুদ্ধ সুব্রত

Leave a Reply to PRABIR GANGULY Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *