রাজার নীতি – ভূমিকা গোস্বামী
রাজনীতি মানে রাজার নীতি। রাজা যে নীতিতে রাজ্য পরিচালনা করতেন তাকে রাজনীতি বলা হত। রাজা দুষ্টকে দণ্ড দিতেন। আবার সজ্জনের পূজা করতেন, সম্মান দিতেন। অতীতে প্রায় সব রাজাই বড় বড় কবি জ্ঞানী গুণী শিল্পীদের নিজের রাজসভায় রাখতে পছন্দ করতেন। তাঁদের কাছ থেকে বিভিন্ন সংকটের সময় উপদেশ নিতেন। কৃষ্ণচন্দ্র রাজার রাজসভায় গোপাল ভাঁড়ের কথা জানি। রাজা কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিলে গোপাল তাঁকে কৌতুকের মাধ্যমে চোখে আঙুল দিয়ে ভুলটা দেখিয়ে দিতেন। বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় নবরত্নের কথা কে না জানেন। আমরা হয়তো আজও তাঁদের মিস করি।
এছাড়া ন্যায় পূর্বক রাজকোষ পূর্ণ করে সমৃদ্ধ করা রাজার নীতি। কাউকে পীড়ন করে নয়। লুট করে নয়, ন্যায় পূর্বক। নিরপেক্ষতাও রাজার নীতি। সকলের প্রতি সমদৃষ্টি। প্রজারা অন্যায় করলে দণ্ড আর রাজার ঘরের লোক সেই অন্যায় করলে চোখ বুজে থাকা- এ রাজার নীতি নয়। তা ছাড়া রাষ্ট্রকে রক্ষা করা অন্দর এবং বাইরের শত্রুদের থেকে রাষ্ট্র ও প্রজাদের রক্ষা করাও রাজনীতির অঙ্গ।
পুরাণে দেখি রাজা যদি রাজনীতি থেকে ভ্রষ্ট হতেন, তাহলে মননশীল পণ্ডিতেরা রাজাকে উপদেশ দিতেন। রাজা বুঝলে ভাল, না বুঝলে বেন রাজার মত দশা হত তাঁর। শ্রীমৎ ভাগবতে বেন রাজার কাহিনী হয়তো সকলের জানা। তবু অধিকন্তু ন দোষায়- তাই বলছি-বেন ছিল- প্রজা পীড়ক স্বৈরাচারী রাজা।নিজের অযৌক্তিক মত জোর করে প্রজাদের উপর চাপিয়ে দিত। প্রজারা অতিষ্ঠ হয়ে পণ্ডিতদের শরণাপন্ন হল। পণ্ডিতেরা রাজাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন। রাজা মানতে নারাজ। বাধ্য হয়ে পণ্ডিতেরা রাজাকে বিনাশ করলেন। এই হল রাজা বেনের কাহিনী। রাজমাতা সুনীথা অবশ্য ছেলের মৃতদেহ সংরক্ষণ করে রেখে ছিলেন। পণ্ডিতেরা উপযুক্ত রাজার খোঁজ না পেয়ে অপুত্রক বেন রাজার ঊরু মন্থন করলেন।(বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক আবিষ্কার ক্লোনিং-এর মত হয়তো) তার থেকে এক খর্বকায় কৃষ্ণবর্ণ পুরুষ উৎপন্ন হল। পণ্ডিতেরা বুঝলেন এ রাজা হওয়ার যোগ্য নয়। এই প্রজাতিরাই নিষাদ নামে খ্যাত। তখন পণ্ডিতেরা বেনের দুটি বাহু মন্থন করে একটি স্ত্রী ও একটি পুরুষ উৎপন্ন করলেন। এঁরা সর্বগুণ সম্পন্ন। স্ত্রীর নাম অর্চি এবং পুরুষটির নাম পৃথু। ভাগবতে এঁদের লক্ষ্মী-নারায়ণের অংশ বলা হয়েছে। এই পৃথু রাজার আমলে পৃথিবীকে দোহন করা হয়েছিল। পৃথিবীকে গোমাতা ভেবে, ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন উপযুক্ত বৎস দোহন পাত্র, এবং দোহন কর্তা সংগ্রহ করে পৃথিবীকে দোহন করতে লাগল।এর ফলে চিকিৎসা থেকে শুরু করে বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্র,চাষ আবাদ, শিল্প, পথ ঘাট বাসস্থান সব দিক দিয়ে সকলেই উপকৃত হল। আজও কি এমন ভাবে বিজ্ঞান সম্মত ভাবে দোহন করে উন্নতি সম্ভব?ভেবে দেখলে কেমন হয়।
যাই হোক, তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে রাজা প্রজা পালনের বদলে প্রজা পীড়ন করলে একদল পণ্ডিত ছিলেন, তাঁরা রাজাকে বোঝাতেন। প্রয়োজনে রাজাকে সিংহাসন চ্যুত করে অন্যকে রাজা করার ও ক্ষমতা রাখতেন। তাঁদের জীবন যাপন ছিল অতি সাধারণ। তাঁদের স্ত্রীরাও মোটা লাল পেড়ে শাড়ী, সিঁদুর আর শাঁখাতে পতি গর্বে গর্বিত থাকতেন।পণ্ডিতগণ সর্বভূতের হিতে রত থাকতেন। রাজা তাঁদের সমীহ করে চলতেন।
ধীরে ধীরে পরিবর্তন এল। রাজার ছেলেই রাজা হল। তার যোগ্যতা থাক বা না থাক। রাজা মানেই হল প্রজাদের টাকায় উচ্ছৃঙ্খল,কাম ক্রোধ আর অহংকারের প্রতীক। কেউ বলার নেই। কারো কিচ্ছু করার নেই।
সে দিন আজ নেই।এখন কোন রাজা নেই। আমরা সবাই রাজা। অন্তত ভোট দেওয়ার দিন তাই মনে হয়। কিন্তু সত্যিই কি তাই! না: আমরা ভালই জানি বাস্তবে তা নয়। সত্যি যদি তাই হত, তাহলে আমাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ইংরেজি উঠে যেত না। শিক্ষা ব্যবস্থা,পাঠ্যসূচী নিয়ে একেক বার একেক রকম ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারত না। যে ইংরেজি ছাড়া আজকের ইন্টারনেটের দুনিয়ায় পা রাখাই সম্ভব নয়, সেই ইংরেজিতে দখল না থাকার জন্য পশ্চিমবঙ্গের একটা বড় যুব সমষ্টি অন্যান্য বিষয়ে পারদর্শিতা থাকা সত্যেও প্রতিষ্ঠিত হতে পারছেনা।
যাদের অর্থ আছে তারা লাখ লাখ টাকা খরচ করে তাদের বাচ্চাদের প্রাইভেট স্কুলে কলেজে পড়াচ্ছে, অসুস্থ হলে প্রাইভেট হসপিটালে যাচ্ছে, অনেক সময়ে
সর্বস্বান্তও হচ্ছে, কিন্তু যাদের এই সাহস দেখানোর-ও সাহস নেই, তাদের ছেলেমেয়েরা কি করবে? উপযুক্ত শিক্ষা না পেয়ে প্রতিভা থাকলেও সর্বোচ্চ শিখর তাদের অধরা থেকে যাবে, চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের পথে পথে ঘুরে ঘুরপথে প্রাণবায়ু ত্যাগ করবে?
আরেকটা শব্দ কান পাতলেই শোনা যায়, সেটা হল সোর্স। ছেলেমেয়েকে ভাল স্কুলে পড়াতে, সোর্স চাই। মুমূর্ষু ব্যক্তিকে প্রয়োজনীয় হাসপাতালে ভর্তি করতে, সোর্স চাই। এমন শত শত মুশকিল আসান করে সোর্স। যার যত সোর্স পার্থিব সব তার হাতের মুঠোয়। যার সেই তথাকথিত সোর্স নেই, তার যোগ্যতার দাম নেই। যতই প্রতিভা থাক না কেন। এদিকে সোর্সের দৌলতে সর্বত্র অফ টিউনের বাড়বাড়ন্ত।এসব কোন কিছুই আমাদের কারো পছন্দের নয়,
সেদিন খবরের কাগজে দেখলাম- একটি ছেলে কুয়োয় পড়ে গেছে, দমকল বাহিনী অনেক চেষ্টা করেও ছেলেটিকে তুলতে পারল না। কিছুদূরে কুয়ো খুঁড়তে আসা কয়েকজন লোকের মধ্যে থেকে দুটো লোক ছেলেটিকে অল্পক্ষণের মধ্যেই তুলে আনল। তখন যদিও দুর্ভাগ্যবশত: ছেলেটি আর বেঁচে নেই। যাই হোক আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কথায় তৎক্ষণাৎ উদ্ধারকারিকে দমকলবাহিনীতে চাকরি দেওয়া হল।
কোনও চাকরীতে শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াও নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে একজন কর্মচারী নিয়োগ করা হয় প্রায় সব ক্ষেত্রেই তাদের অবদান যেন ঠিক সুরে লাগেনা। অথচ বেসরকারি চুক্তিবদ্ধ কর্মচারীদের দেখেছি কাজের ক্ষেত্রে ওরা অনেক বেশী পারফেক্ট।এর কারণ কী- নিরাপত্তা আর নিরাপত্তা হীনতা? এ ব্যাপারগুলো সরকারের ভাবনায় আছে কি?
রাষ্ট্রপতির নিরপেক্ষতা চাই, রাজ্যপালের,স্পিকারের ক্ষেত্রেও নিরপেক্ষতা চাই। কোন দলীয় পক্ষপাত এঁদের থাকা চলবে না। অর্থাৎ সমতার নীতি। আমার মনে হয় কোন দলীয় পক্ষপাত নিয়ে ভোটে জিতে সরকারে আসার পরে সেই সরকারেরও সমতার নীতি হওয়া উচিৎ। সরকার জনগণের অনেক আশা ভরসার জায়গা। প্রত্যেক ভোট পর্ব চলার সময় একটা ক্ষীণ আশা জাগে সাধারণ মানুষের মনে, এবার হয়তো আগের চেয়ে ভাল কিছু দেখব।
অতীতের মত, এখনও অনেক মননশীল পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব আছেন। তাঁদের বুদ্ধিজীবী বলে ডাকা হয়। এই নামটা আমার একদম পছন্দ না। বুদ্ধিজীবী বলতে বুদ্ধিকে জীবিকা করেন যারা। অর্থাৎ বুদ্ধিকে নিয়ে ব্যবসা করা অর্থ, মান, যশের লোভে প্রতিষ্ঠানের অন্যায় অপরাধগুলিকে বুদ্ধির জোরে যুক্তি খাঁড়া করে লোক ঠকাতেও যাদের আটকায়না। তারা বুদ্ধিজীবী। এরা শুধু জনগণের শত্রু নয় দেশের শত্রু, সরকারেরও শত্রু।
আমি সেই মননশীল, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, নির্লোভ,পক্ষপাতশূন্য,নির্মম,নিরহংকার ব্যক্তিত্বের কথা বলছি। তাঁদের বুদ্ধি-যোগী বলতে চাই। ভাল সরকার পরিচালনার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রের পণ্ডিতদের সঙ্গে পরামর্শ বা উপদেশ গ্রহণ করা হলে কেমন হয়।
যে কোনও সফলতার পিছনে জ্ঞান,কর্ম ও ভক্তির প্রয়োজন। পণ্ডিতদের জ্ঞান, সরকারের কর্ম তাতে দেশও দেশবাসীর প্রতি ভালবাসা মিশলে সফলতা আসবেই।তাহলে আবার স-ব ক্ষেত্রের চূড়ায় চূড়ায় ফুল টিউন দেখতে পাব। প্রতিভাধরেরা সম্ভূতি আর অসম্ভুতির ডানায় বিদ্যা আর অবিদ্যার ভারসাম্যে পাখা মেলতে পারবে শিখর থেকে শিখরে।
সাধারণ মানুষ হোক বা পণ্ডিত সবাই যদি নিজের বাইরে একটু সমাজের কথা ভাবে, অনেকটা সমস্যা কমে যাবে। লেখাটি ঝকঝকে।
চমৎকার লেখা । সামাজিক চিত্র একইরকম রয়ে গেছে । এর বদল দরকার ।