মুক্তগদ্যঃ শ্রী চরণেষু মা – ভূমিকা গোস্বামী (কলকাতা)

শ্রী চরণেষু মা – ভূমিকা গোস্বামী


শরতকালে তোমরা দেবদেবীরা তো ঘুমিয়ে থাকো। তাইনা মা ? বসন্ত কালে বাসন্তী নামেই তো তোমার আগে পুজো হত। শরতকালে তোমাদের ওখানে তো রাত্রি। দক্ষিনায়ন। রাঘব যখন দশানন কে পরাস্ত করতে নাজেহাল তখন এই অকালেই তোমাকে বাধ্য হয়ে জাগিয়েছিল। কত শত অস্ত্র প্রয়োগ করেও রাবন অক্ষত। আর হবে নাই বা কেন , বসন্তকালে দশানন যে তোমাকে প্রসন্ন করেছিল। তুমি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে , তাকে কেউ পরাস্ত করতে পারবে না। তবে এও বলেছিলে -চন্ডী পাঠে ত্রুটি হলে তুমি তাকে ছেড়ে চলে যাবে।

ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে ব্রহ্মার কথা মত শরতকালে তোমাকে বেল গাছের নিচে অকাল বোধন করার সিদ্ধান্ত নিল রাঘব। এই সময় তুমিও যে তখন মর্ত্যে বাপের বাড়িতে আস, ভোলানাথকে রাজি করিয়ে। এদিকে রাঘব যখন অষ্টমী আর নবমীর মাঝের সময়ে সন্ধী পুজোয় বসেছেন। একশো আটটি পদ্ম দিয়ে শ্রদ্ধা আর ভক্তি দিয়ে তোমার পুজো করবে বলে, তুমি দুষ্টুমি করে একটি পদ্ম লুকিয়ে ফেললে। পদ্ম খুঁজে না পেয়ে বিচলিত রাঘব তার নীল পদ্মের মতো সুন্দর চোখ -ই তোমাকে অঞ্জলি দিতে চাইল। তুমি প্রসন্ন হলে, আশীর্বাদ করলে।
এদিকে দশমীর দিন স্বয়ং বৃহস্পতি রাবনের কল্যাণের জন্য চন্ডীপাঠে বসেছেন। হনুমান তাঁকে অজ্ঞান করায় চন্ডী পাঠ অশুদ্ধ হয়ে গেল। তুমি তোমার শর্ত মত রাবনকে ত্যাগ করলে। রাবন বধ হল। রাঘবের জয় হল। পাশাপাশি ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা হল। দেখো মা, সীতা- সুখ। রাম -শান্তি।শান্তিকে বাদ দিয়ে কী সুখের নাগাল পাওয়া যায় বল ? রাবন রাম রূপ শান্তিকে মেরে সীতা রূপ সুখ ধরতে চেয়েছিল। রাবনের চাওয়া ভুল ছিল না। রাহা ভুল ছিল। তাই না বল ?

তুমি দুর্গা। যিনি দুর্গতি বা সংকট থেকে রক্ষা করে। তুমিই তো দুর্গম অসুরকে বধ করেছিলে।সমুদ্র মন্থনের সময় অসুরেরা বিষ্ণুর মোহিনী মায়ায় ভুলে অমৃত থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। সেই প্রতিশোধ নিতে হিরনাক্ষ পুত্র রুরুর বংশধর দুর্গম ব্রহ্মার তপস্যা করে। ব্রহ্মার কাছে দুর্গম বর চাইলো —আমাকে এমন এক নারী বধ করবে যে অনাবদ্ধকে আবদ্ধ করে। এরপর দুর্গম যখন চতুর্বেদকে হস্তগত করলো , তখন সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষার জন্য, মনেপড়ে মা ? তুমি দশভূজা কল্যাণময়ী দেবী রূপে আবির্ভূতা হলে। তারপর দুর্গমকে শূলের আঘাতে বধ করলে। আমরা ভাবপ্রবণ বাঙালিরা তোমার মহিষমর্দিনী চন্ডী রূপ আর দুর্গমনাশিনী দুর্গা রূপকে এক মূর্তিতে প্রতিষ্ঠা করেছি।

বছরে দুবার তুমি মর্তে আগমন কর। একবার চৈত্রমাসে বাসন্তী নামে। আর শরতকালে মানে শারদীয়ায় দুর্গা নামে। শারদীয়ায় তোমার আগমন বেশী জাঁকজমক । আরও কত নাম যে আছে তোমার– চন্ডিকা, যোগমায়া, অম্বিকা, বৈষ্ণবী, মহিষাসুরসংহারিনী নারায়নী, মহামায়া, কাত্যায়নী, কখনও তোমার আঠের হাত। কখনও ষোল। কখনও দশ। কখনো আট। কখনও আবার চার হাত। তবে দশ হাতে তোমাকে দেখতেই আমরা অভ্যস্ত। দশ হাতে দশটি অস্ত্র– ত্রিশূল , খড়্গ , চক্র , বাণ , শক্তি , ঢাল , ধনুক , ঘন্টা , পরশু, নাগপাশ । মনীষীরা বলেন মর্ত্যের নারীরা নাকি তোমার রূপ। সত্যিই তারা দশ হাতে ঘর বার সামলায়। তবে একটা কথা তোমায় গোপনে বলি – তোমার মতো রূপ দিয়েছ , অথচ আয়ূধ দিয়ে পাঠাও নি ? জান না এখনও সব স্তরে লুকিয়ে থাকে কামুক মহিষাসুর আর দুর্গমেরা ? নারী শরীরের মাথার চুল থেকে পায়ের নখ – ও নাকি ওদের কামের উদ্রেক করে। ওরা বলে- এতে ওই অসুরদের দোষ কোথায়। বরং নারীকেই শরীর ঢেকে চলতে হবে। মর্ত্যের দুর্গারা বড় কষ্টে আছে মা…।
এবার মর্তে আসার সময় মনে করে মর্তের দুর্গাদের জন্য দশ হাতের দশ দশটি অস্ত্র আনা চাই।ভুলবে না কিন্তু।

তুমিই পরমা প্রকৃতি । তুমিই সৃস্টির আদি কারণ। তুমিই একবার হৈমবতী হয়ে দেবতাদের অহংকার মোচন করেছিলে । মনে আছে ? দেবতারা তাদের শক্তির বড় বড়াই করতো। তুমি তাদের সামনে সামান্য তৃণ রেখে পবনকে বলেছিলে উড়িয়ে দিতে , বরুণকে বলেছিলে ভিজিয়ে দিতে , অগ্নিকে বলেছিলে পুড়িয়ে দিতে । ওরা সবাই বিফল হল । শেষে দেবরাজ এলে তার সামনে তুমি আসো নি। তুমি যে ইন্দ্রিয় গোচর নও। ঈশান কোণে তোমার ঝলমল জ্যোতিরূপে নিজের হৈমবতী রূপের পরিচয় দিয়েছিলে। কী , মনে পড়ছে ?

তুমিই আবার কার্তিক গণেশ জননী । তুমিই শিবের ঘরনী শিবানী।
বাংলার আগমনী গানে তুমি বাংলার ঘরের মেয়ে উমা। সারা বছর মা মেনকা অপেক্ষা করে বসে থাকে । মহালয়ার পর আর তর সয় না গিরিজায়ার। স্বামীকে অনুরোধ করে বলতে থাকেন — “যাও যাও গিরি , আনিতে গোরী।” আবার কখনও বলেন — এবার উমা এলে আর পাঠাবো না।

তুমি এলে মা মেনকার আনন্দ যেন আর ধরে না। দেখতে দেখতে তিনটে দিন যে কী ভাবে কেটে যায় ! নবমীর রাত পোহালে তোমাকে আটকে রাখে কার সাধ্যি। স্বামী সংসার টানে তোমায়। জানি মা , তুমি যে শিব সোহাগী। বাধ্য হয়ে ই চোখের জলে বুক ভাসিয়ে মাকে — তোমায় বরণ করে বিদায় জানাতে হয়। আবার শুরু হয় তার অপেক্ষা।পাশাপাশি আমাদেরও।
প্রণামান্তে —- ইতি—
তোমার অনুগত ও জগতের কল্যাণকামী সন্তান।

7 thoughts on “মুক্তগদ্যঃ শ্রী চরণেষু মা – ভূমিকা গোস্বামী (কলকাতা)

    1. ভীষণ ভালো লাগলো। সত্যি মর্ত্যের দুর্গাদের এখন মায়ের মতোই দশ হাতে দশ অস্ত্র দরকার।

  1. শারদীয়া র শুরুতে, এ লেখা অপূর্ব। খুব ভালো লাগলো।

    1. বাঃ। সুস্থ ও সুন্দর ভাবনা‌।

  2. খুব সুন্দর, সমৃদ্ধ লেখা। আর সব মেয়ের মনের কথা। ধন্যবাদ লেখিকাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *