অপেক্ষা
কৃত্তিকা ভৌমিক
ভোরে ওঠা একেবারেই অভ্যাস নেই তিথির। অনেকদিন পর আজ ভোর দেখলো। মহালয়ার ভোরের একটা আলাদা আমেজ।
রাতের অন্ধকারের কালিমা কেটে গিয়ে একটা হালকা আলোর আভাস চারিদিকে । চরাচর যেন পাতলা কুয়াশার চাদরে নিজেকে ঢেকে রেখেছে। একটু হিমহিম ভাব।
শরতের এই সময়টা শিউলি আর ছাতিমের গন্ধ মনকে বড্ড মনকেমন করা ভালোলাগায় আচ্ছন্ন করে দেয়। আলোর হাতে নিজের সবটুকু সঁপে দিয়ে অন্ধকারের এখন বিদায় নেওয়ার পালা। টাটকা সুন্দর হিমেল বাতাস তার চোখে মুখে যেন স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। মা বলে ভোরের একটা আলাদা গন্ধ আছে। এখন মনে হচ্ছে তিথি সেই গন্ধটাই যেন উপলব্ধি করছে।
তিথির বাবা রেলে চাকরি করতেন। বরাবর তারা রেল কোয়ার্টারেই থেকেছে। তাদের তিনজনের ছোট্ট সংসারে অভাব অনটন কিছু ছিল না। নিত্যদিনই ছিল তাদের আনন্দের দিন। আসলে তিথির বাবা ছিলেন খুব রসিক মানুষ। চট করে সকলের সাথে আলাপ জমিয়ে ফেলতেন। হৈচৈ হুল্লোড় করে দিন যাপনেই ছিল তার ভালোলাগা। সবাই বাবা কে খুব ভালোবাসতো। সেই দিনগুলো ছিল বড়ো আনন্দের। আশেপাশের কোয়ার্টারের সব ছেলেমেয়েরা একসাথে স্কুলে যেত, বিকেলে মাঠে খেলা করত। তাদের জীবন ছিল বন্ধনহীন নদীর স্রোতের মতো। দুর্গাপুজোর সময় ছোটদের নৃত্যনাট্য এবং বড়দের নাটক অনুষ্ঠিত হতো। অনুষ্ঠানের থেকে মহড়ার জন্য তাদের বেশি আগ্রহ ছিল। সন্ধ্যাবেলা তাড়াতাড়ি পড়াশোনা শেষ করে চলে যেত তারা মহড়ায়।
তিথি তখন ক্লাস ইলেভেন, এরকমই এক মহড়ার সন্ধ্যায় তিথির কানের কাছে ফিসফিস করে অতনু বলেছিল, “আমি তোকে ভালোবাসি তিথি”। প্রথমে কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও ভীষণ রেগে গিয়েছিল তিথি। রাগে তার চোখে জল এসে গিয়েছিল। এ কেমন অসভ্যতা! অতনু তাকে একথা বলল কি করে!! দুদিন সে রাগ করে অতনুর সাথে কথাই বলেনি। এরকম কথা তো সে ভাবতেই পারে না। ছোট থেকে তারা একসাথে বড় হয়েছে। অতনু তার থেকে ঠিক দু বছরের বড়। এখন সে ফার্স্ট ইয়ার। পড়াশোনার কত চাপ আর এখন এসব মাথায় ঢুকলে তো পড়াশোনারও ক্ষতি! অতনুর বাবা মা, মানে কাকু কাকিমা তো অনেক আশা নিয়ে বসে আছে ছেলে ডাক্তার হবে। সেকথা অতনু ভাবলো না!
তিথির একবার মনে হল, মা-কে সব বলে দেবে কিন্তু যতবার বলবে ভেবেছে ততবারই “আমি তোকে ভালোবাসি তিথি” শব্দগুলো মনে পড়ছে আর মনের মধ্যে ফল্গুধারার মতো একটা খুশি তিরতির করে বয়ে চলার আভাস পাচ্ছে তিথি। তাহলে কি সে-ও অতনুকে ভালোবাসে!
সেই দিনের পর তিথিকে আর ভালোবাসার কথা বলেনি অতনু। তিথিও নীরব থেকেছে।
পড়াশোনা শেষ করে তিথি স্কুলে চাকরিটা পাবার পরই তার বাবা মারা যায়। কোয়ার্টার ছেড়ে একটা ফ্ল্যাট কিনে সে আর মা সেখানে শিফট করে। ততদিনে অতনু ডাক্তারি পাশ করে কাকু কাকিমাকে নিয়ে কলকাতায় সেটেলড। ফোনে অবশ্য যোগাযোগ আছে দুই পরিবারের।
বাস স্ট্যান্ডে বসে মাঠটার দিকে তাকিয়ে অতনুর কথাই ভাবছিল তিথি। এই মাঠটা পেরিয়েই তারা সবাই একসাথে স্কুলে যেত। ছোটবেলায় এই মাঠটা কত বড় লাগতো। তিথি এখন ভাবে বিশালতা কি মাঠের ছিল না তার দৃষ্টির! আসলে বড় হয়ে গেলে জীবনটাই তো ছোট হয়ে আসে।
ফোনের মেসেজ বক্স খুলে আর একবার অতনুর মেসেজটা দেখলো তিথি। “সেই কথাটা আজও সত্যি। আমি এখনও অপেক্ষায়”
দুদিন হল মেসেজ এসেছে। উত্তর দেয়নি তিথি। আজ মহালয়ায় স্কুল ছুটি তাই উত্তর নিয়ে নিজেই চলেছে কলকাতায়। ভোরের বাসে গেলে রাতের মধ্যেই ফিরতে পারবে। মা-কে একা রেখে রাতে কোথাও থাকে না তিথি।
দূরে দেখা গেল বাস আসছে। তিথি ভাবলো এই শরৎকালই তো তাদের প্রেমের মাস। শরতের নীল সাদা মেঘের ভেলায় ভেসে ভেসে তিথির মন হয়ত ওর আগেই পৌঁছে যাবে অতনুর কাছে।
মনে এক আকাশ ভালোবাসা নিয়ে বাসে ওঠার সময় তিথি শুনতে পেল কোনও বাড়ির রেডিওতে বাজছে আগমনী সুর, “বাজলো তোমার আলোর বেণু, মাতলো রে ভুবন…”
মিস্টি প্রেমের গল্প।ভাল লাগল।
ধন্যবাদ 😊
খুব সুন্দর হয়েছে। অপূর্ব।
ধন্যবাদ 😊
চমৎকার গল্পটি
ধন্যবাদ 😊
খুব মিষ্টি একটা ভালবাসার গল্প। আমার বেশ ভাল লাগল।
ধন্যবাদ 😊