ছোটগল্পঃ সদানন্দ – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী রাধু ( কলকাতা)

সদানন্দ

রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী রাধু


সদানন্দ একবার জীবনে ঠকেছে। সারা দিন গলদঘর্ম পরিশ্রম করে দিন শেষে এক পয়সাও মজুরি পায়নি। কেননা তার বৌটো মরে গেলে এই জেঠুই তাকে ট্যাক থেকে কয়েকটা টঙ্কা বার করে সাহায্য করে বলেছিলো, – টেঁকার জন্যে তুকে  অযথা ভাইবতে হবেক লা। তুর কাজ চালিয়ে নে তো আগে।”
দিনের শেষে সমস্ত কাজ মিটে গেলে সদানন্দর মজুরির টাকাটা তারই বানানো ক্যাশ বাক্সটায় রেখে বলেছিল,- লোতুন বাসকোটন বানায়েন দিলি, সিটোকে বউনি কইরলুম। সেই যে তুর ধারটো ছিলেক, তুই শুধতে লারলি, আজ শোধবোধ হয়েন গেল”।
তারপর থেকে সদানন্দ আর ঠকেনি। চালাক-চতুর হয়ে গেছে। বড় একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্পেন্টারের কাজ নিজের যোগ্যতায় পেয়ে সে শহরবাসী ও ভদ্রস্থ হয়ে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর কাজ করে কয়েক দিন আগে রিটায়ার করেছে। ইতিমধ্যে সংসারের অলিখিত নিয়মে আবার বিয়ে-থা করে সংসারী হয়েছে। আগের বৌটো মারা যাবার পর অনেক বছর পার করে বৈরাগী বা সন্ন্যাসী বা আজেবাজে জায়গায় গিয়ে ইহকাল পরকাল দুইই নষ্ট না করে অফিসের লোকদের পরামর্শ মত বিয়েতে রাজি হয়েছিল।
এখন তার স্ত্রী আর দুটি মেয়ে আর তাকে নিয়ে চারজনের সংসার। দুটো মেয়ের বিয়ের পাত্র আসানসোলের শীতলাডাঙা আর ঊষাগ্রামে তৈরী হয়ে আছে। পলাশডাঙার বাড়ি ফিরেই হাতের অঢেল সময় পাওয়া যাবে। নিজের মেয়েরা মোটামুটি অনেকটা লেখা পড়া করেছে আর দুটো পাত্র একেবারে সোনার টুকরো না হলেও, শিক্ষায় আর রোজগারে চলনসই।
কাজেই সদানন্দ অফিসের কয়েক লাখ টাকা পেয়ে মহানন্দে আসানসোলের পলাশডাঙ্গায় নিজের ভিটেয় ফিরে এল।
দুদিন পর কিছু কাঠের মেরামতের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনে আনল। আর আসার পথে রাজমিস্ত্রী শকু ভাইকে লোক জন নিয়ে এসে সামনের ভাল দিনে কাজ শুরু করতে বলে এল।
সদানন্দ বাড়ি ফিরে উঠোনে একটা কাঠের পুরনো চেয়ারে বসে হাত পাখায় হাওয়া খেতে লাগল, উঠোনের গাছগুলো
থেকে হাওয়া আসছিল না, তাই।
মনে মনে ভাবছিল, এই আগামী দুই মাসের মধ্যে ঘরবাড়ি মেরামত আর মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে তার কাজ প্রায় সব শেষ। তারপর সে ও তার বৌ। মাত্র দুজন থাকবে। প্রথম প্রথম একা একা লাগবে। তবে মাঝে মাঝেই তো মেয়ে জামাইরা আসবে, ধীরে ধীরে নাতি নাতনিরা হবে, তাতে ঘর ভরে উঠবে কয়েক দিনের জন্য। নিজের অন্তত, একটা ছেলে হলে তার ঘরে নাতি নাতনি হলে হয়তো সারা বছরই ঘর ভরে থাকত। একটা দীর্ঘ শ্বাস বের হল সদানন্দর। তবু মনকে বোঝায় যাক্ যা হয়েছে তাই হয়তো ঘাঘর বুড়ি মায়ের ইচ্ছে। এই নিয়ে তো সে বেশ আছে।
শরীরের ক্লান্তি দূর হলে ছোট মেয়ের কাছে জল চাইলে গিন্নী উত্তর দিল – কখ্খন তোমার জল দেয়া হয়েছে”।

  • ওহো, দেখতে পাইনিকো” বলে ঢকঢক করে জল খেয়ে জলের ঘটিটা বৌর হাতে দিতেই সদানন্দর চোখ সামনে আল দেয়া ফসল তোলা ক্ষেতের দিকে স্থির হয়ে গেল।
    সদানন্দ দেখতে থাকল অনেক মুখ ফাঁক করে চোখ দুটো প্রায় কপালে তুলে – একটা লোক একটু কুঁজো হয়ে বগলের নীচে ছাতা গুটিয়ে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে হেঁটে তাদের বাড়ির দিকে আসছে। রাস্তা সংক্ষেপ করে অনেক সময় ঐ আল পথেই ওরা যাতায়াত করে। লোকটা ঠিক সেই পঁয়ত্রিশ চল্লিশ বছর আগের মহাজন জেঠুর মতন। কিন্তু সেই মহাজন জেঠুতো অনেক দিন আগে মরে যাবার কথা। তবে ইনি কে হবেন? বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলনা। ফোঁকলা দাঁতে এক টুকরো হাসি ঝুলিয়ে লোকটা হাঁক পাড়ল – জামাইদাদা, আমি তুমার আসার খবর পেয়েই এলাম গো।”
    সদানন্দ চিনবার চেষ্টা করেও চিনতে পারলো না। লোকটা বুঝতে পারল আর বলল – চিনতে লাইরলেক? সেই যে মনোরমা, তুমার প্রেথম ইস্তিরি ছেল গো, মুই তার দাদাটো বটেক।”
    লোকটা সামনে দাঁড়ানো সদানন্দর বৌকে বলল – একটু জল দাও দিকিন বোনটো আমার। অনেক পথ হেঁটেই আসতে হয়েনছে।”
    সদানন্দ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। তার বৌ গিয়েছে জল আনতে। সে অচেনা লোকটাকে ঠিক চিনতে না পারলেও জিজ্ঞেস করল – তা দাদা, কী মনে করে ?”
  • মইনে করার কিছসু লাইগো। তুমার বৌটো মইরে গেলেও তুমার শাসটো বেঁইচে আছেক, বয়েস হবেক প্রায় পাঁচ কুড়ি, আসানসোলের বড় নারসিংহোমটাতে ভর্তিক আছে গো। কাঁড়ি কাড়িক টাংকা লাইগছেক। তুমি মুকে কিছু দিয়ে দাও, পরের মাসটোতে আমার দুই বিঘা ধানী জমি বেঁইচে শোধ দিয়ে দোব’ খন।”
    এর মধ্যে সদানন্দর বৌ হাতে জলের পাত্র আর দুখানা বিস্কুট নিয়ে এসে হাজির। সম্ভবত সবটাই শুনেছে। জল এগিয়ে দিয়ে বলল – হ্যাঁ দাদা কত লাগবে, বলুন আমায়”।
    ঝটিতি উত্তর – না বল্লেক আর নেই বল্লেক শুনবক নাই। অত বড় জায়গা কাম কইরে দশ বারো লাখ টাংকা পেয়েনছো। এক লাখ এই কদিনের জন্য দিলে মেয়েনদের বিয়া আটকাবেক লাই। ভাইলছো কী, ঘরে তুমার টাংকা রয়েনছে। আর আমি তো জমিনটো বেঁইচে শোধ দিয়ে দোব বলেইনছি।
    সদানন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই লোকটা ওর বৌকে বল্ল – আমার বোনটি ওকে বোঝাও না।”
    কে কাকে বোঝাবে। সারা জীবন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগারের ফসল রিটায়ারের টাকা তা একবার বের হলে আর ফেরত আসতে চায় না। ধাদকা রেল পাড়ের সুনীলকে দেখেছে সেন রেলের চাকরির শেষে সব টাকা তার কোন্ এক গাড়ি বাড়ি অলা আত্মীয় দোতলা তৈরী করার জন্য নিয়েছিল ফেরৎ দেবে বলে, কিন্তু সে লক্ষ্মী আর ফিরে আসে নি। সেই আত্মীয় আর বেশি দিন বাঁচেনি আর সুনীল আজকাল পাগল হয়ে স্কুলের সামনে বসে বসে বিড়বিড় করে কথা বলে, কাউকে চিনতে পারে না। বৌ আর সদানন্দ মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল।
  • কী দেখছো গো তোমরা ? মুই জোচ্চোর আছিনা। কথার দাম রাখতে জানি। এক লাখ টাংকা তুমাদের কাছকে কিছু লা।”
    সদানন্দর মনে পড়ল তার আগের শাশুড়ি তো বেশ কয়েক বছর আগেই মরে গেছে আর সঙ্গে সঙ্গে সে আগন্তুকের বগলদাবা ছাতাটা এক ঝটকায় টান দিয়ে নিয়ে সেটাই উঁচিয়ে মারমুখী হয়ে চেঁচিয়ে উঠল – শালা তুকে কিসছু দেবক লাই। বুড়িটো অনেক আগেই মইরে ভূত হইয়ে গেছেক, ভাগ শালা ভাগ।”
  • না, সদানন্দ আর ঠইকবেক না” বলতে বলতে ছাতাটা বুড়োর গায়ে ছুঁড়ে দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেলো।

2 thoughts on “ছোটগল্পঃ সদানন্দ – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী রাধু ( কলকাতা)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *