জীবন জীবনের জন্যে
সংগ্রামী লাহিড়ী
বাড়ীর হট্টগোল ছাপিয়ে জনের ফোনটা বেজে উঠলো।
- ইমার্জেন্সি নাইন ওয়ান ওয়ান কলিং, আ ম্যান ইজ থ্রেটেনিং তো কিল হিমসেল্ফ উইথ হিজ টু বেবিজ বাই জাম্পিং অফ দ্য করোনাডো ব্রিজ। প্লিজ রেসপন্ড ইমিজিয়েটলি।
কি সর্বনাশ! জন ঠিক তিন মিনিট সময় নিল নিজের পুলিশের ইউনিফর্ম পরতে। ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দেবে বললো না? সঙ্গে দুটো বাচ্চা? একশো ফুটের SWAT mission দড়িটা তো নিতেই হবে। লাফিয়ে উঠে বসেই সে গাড়ি চালিয়ে দিলো ব্রিজের দিকে। তীব্র সাইরেন আর লাল, নীল আলোয় সবাই পথ ছেড়ে দিচ্ছে। ঘন্টায় একশো মাইল গতিতে ছুটছে পুলিশের ইমার্জেন্সি রেসপন্ডার। ছুটছে সান দিয়েগো পুলিশের K9 অফিসার জন।
আজ তিন মাস পর লকডাউন উঠেছে, তার সান দিয়েগো পাড়ার ভেটেরান পার্কটা খুলেছে। যমজ বাচ্চাদুটোকে নিয়ে পার্কে গিয়েছিলো জন। বাড়িতে থেকে থেকে দুটো বাচ্চাই ঘ্যানঘ্যানে হয়ে গেছে। ওদের প্লেস্কুল বন্ধ, পাড়ার আর পাঁচটা পুঁচকের সঙ্গে মিলে খেলাধুলোও বন্ধ। হাঁপিয়ে উঠেছে বেচারীরা।
পার্কে গিয়ে আজ তারা মহাখুশি। দোলনায় দুলেছে, ট্রাম্পোলিনে লাফিয়েছে, সবুজ ঘাসে দৌড়ে বেড়িয়েছে। বাড়ির দিকে আর যেতেই চায় না।
সন্ধ্যে হতে দেরি হয় এখন, আটটার আগে তো অন্ধকারই হয়না। ডিনারের সময় হয়েছে, জন কতকটা জোর করেই ওদের নিয়ে বাড়ীমুখো হয়।
আর বাড়ী ঢুকে পর্যন্ত মিয়া আর রবার্ট জ্বালাতন করে মারছে।
এলেনা বাড়ীতেই আছে। পাঁচমাসের প্রেগন্যান্ট। ব্যাপার দেখে সে চোখ পাকিয়েছে, ধমকও দিয়েছে দুয়েকটা। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তারা পার্কে যাবে – ‘উই ওয়ানা গো দেয়ার’।
জনের পা গ্যাস প্যাডেল চাপছে প্রাণপণে। মাথার মধ্যে হাজার প্রশ্ন – কতটা দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তবে দুটো বাচ্চাকে নিয়ে মরণঝাঁপ দিতে দৌড়োনো যায়? সিঙ্গল ফাদার? পেরে উঠছিলো না আর? লকডাউনে চাকরি খুইয়েছে? এমন তো এখন ঘরে ঘরে। দুমুঠো খাবার জোগাড় করতে ফুড স্ট্যাম্প নিয়ে মানুষের অপেক্ষা। নিজের খিদের জ্বালা সহ্য করা যায়। কিন্তু সন্তানদের অভুক্ত রাখার জ্বালা যে বহুগুণ বেশি।
কে জানে লোকটার গায়ের রং কেমন? কালো মানুষ? নিজে এই জীবনে যা যা কিছুর মধ্যে দিয়ে গেছে, বাচ্চাদের তার থেকে বাঁচাতে চাইলো? একবার ভাবলো না প্রতিটি জীবন মূল্যবান?
হঠাৎ শিউরে উঠলো জন। চোখে কেবল ভাসছে রবার্ট আর মিয়ার মুখ। সেও কি কোনোদিন এমন অজানা অবস্থায় মিয়া আর রবার্টকে নিয়ে পার্কে যাওয়ার বদলে খাদের দিকে ছুটিয়ে দেবে গাড়ি?
লোকটার সঙ্গে যে বাচ্চাদুটো আছে! হে ঈশ্বর, জন যেন ঠিক সময়ে গিয়ে পৌঁছতে পারে।
ওই তো, ওই তো করোনাডো ব্রিজ, গাড়িটা দেখা যাচ্ছে, স্পিড লিমিটের অনেক ওপরে চলছে।
জন হুটার চালু করে দেয়, মাইক্রোফোনে বলতে থাকে – স্টপ, থামো, দাঁড়াও।
গাড়ি থামে না।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সামনে সানসেট ক্লিফ। গাড়িটা ঝাঁপ দিলো।
জন এক পলকের জন্যে চোখ বুজে ফেললো। পরক্ষণেই পার্ক করেছে।
দড়িটা কোমরে গলিয়ে, ক্লিফের পাথরে আটকে নিজেকে ছুঁড়ে দিলো নীচে। পৌঁছতেই হবে ওদের কাছে।
গাড়িটা প্রায় তিরিশ ফুট নিচে জলে গিয়ে পড়েছে। জন পৌঁছে গেছে গাড়িটার কাছাকাছি। লোকটার দুটো হাতে দুটো বাচ্চাকে ধরে আছে। জল ঢুকছে হু হু করে। একটা বাচ্চা নেতিয়ে আছে লোকটার হাতের ওপর। জন শিউরে উঠলো – তবে কি…
আবার চোখের সামনে মিয়া আর রবার্টের মুখ। জনের তালু শুকিয়ে ধু ধু মরুভূমি।
ওপরে আরও কয়েকজন ইমার্জেন্সি রেসপন্ডার এসে গেছে। জনের দড়িটা তারা আলগা করে আরো নিচে নামিয়ে দিলো। জন এবার পৌঁছে গেছে ওদের কাছে।
ভরসার এক হাত ছিনিয়ে নিলো নেতিয়ে পড়া বাচ্চাটাকে।
দেরি না করে রেসকিউ ব্রিদিং চালু করে দিলো জন। মুখের ভেতর দিয়ে জোরে হাওয়া ঢুকিয়ে লাংসে পৌঁছে দেওয়া। কয়েক সেকেন্ড পর পর।
অন্য বাচ্চাটা পরিত্রাহী কাঁদছে। ওপরে থেকে ঝোলানো দড়িতে বেঁধে তাকে উঠিয়ে দিলো আগে। নেতিয়ে পড়া বাচ্চাটা কাশলো এবার। পেরেছে! জন পেরেছে!
অ্যাম্বুলেন্স অপেক্ষা করছিলো ওপরে। বাচ্চা দুটোকে নিয়ে সোজা দৌড়োলো হাসপাতালের দিকে। সানসেট ক্লিফের পাথুরে দেওয়ালকে পিছনে রেখে জন এবার লোকটির সঙ্গে একা। দুই পিতা মুখোমুখি।
যুদ্ধ শেষ। এখন শুধু এয়ার-লিফটের জন্যে হেলিকপ্টারের অপেক্ষা। জীবনের সঙ্গে লড়াইয়ে মরণ হেরে গেছে।
অসাধারণ। আরো লেখা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।