গল্পঃ মূর্ছনা – তাবাস্সুম আরা

মূর্ছনা

শপিং মল থেকে বেরিয়েছি যখন, মল চত্ত্বর প্রায় ফাঁকা। নতুন এই মলটা যবে থেকে হয়েছে এলাকা আর এলাকাবাসীর হাবভাবই বদলে গেছে। আমারও সুবিধাই হয়েছে বেশ অনেকটা। বাড়ির এত কাছে প্রয়োজনের জিনিস গুলো পেয়ে যাওয়া তো চাট্টিখানিক কথা নয়!.. বেরিয়ে কিছুদূর এসেছি শুনলাম সিকিউরিটি গার্ড লাঠি ঠুকে কাকে যেন ‘হেই হেই’ করছে। ভাবলাম রাস্তার নেড়ি বুঝি। কিন্তু বয়স্ক গলা শুনে বুঝলাম নেড়ি নয়, মানুষ। পিছু ফিরে দেখি শতছিন্ন কাপড়চোপড় আর উস্কোখুস্কো চুলের এক বয়স্ক মহিলার সাথে সিকিউরিটি গার্ডের কিছু তর্ক – বিতর্ক চলছে। পাত্তা না দিয়ে চলেই যাচ্ছিলাম কিন্তু গার্ডের চরম হম্বিতম্বিতে পিছু ফিরতেই হল। গেলাম। গার্ডের কথায় যা বুঝলাম তা মোটামুটি এইরকম– গত কয়েকদিন ধরে মল বন্ধ হওয়ার পর এই দেশোয়ালি মহিলা ঠিক মেইন গেটের সামনে এসে রাতে ঘুমায়। সকালে ওর ফেলে যাওয়া নোংরা, এঁটোকাঁটা তাকেই সাফ করতে হয়। অতএব আজ লাঠি ঠুকে ওই আপদকে বিদেয় করেই ছাড়বে। মহিলার পাশে উবু হয়ে বসে বললাম, ” মা’জি… য়াঁহা ক্যাইসে সোতি হো? বারিশ হুই তো ভিগ যাওগি। ” নাছোড় মহিলা তবু মাথা নেড়ে বলে,” য়ঁহি, য়ঁহি, য়ঁহি সোনা হে…”। জেদ দেখে ভয় পেলাম, তবু নরম গলায় বললাম, ” কুছ দূর এক দরগাহ্ হে। ওঁয়াহা কিঁউ নেহি চলি যাতি মা’ জি? কিঁউ ডাঁট খা রাহি হো!…” বলল, ” ওঁয়াহা শেহনাই সুনাই নেহি দেতি… য়াঁহা দেতি হে। শেহনাই সুনতে সুনতে সো যাতি হুঁ। অচ্ছি নিন্দ আতি হে। ” আমি হতভম্বের মত শুনলাম। ভাবলাম ঠিক শুনছি তো? আবার জিজ্ঞেস করলাম,” ক্য়্যা? ক্য়্যা সুনাই দেতি হে?” মহিলা মুখের কাছে হাত নেড়ে বলল, ” শাদি নেহি কি হে ক্য়্যা? শাদি মে শেহনাই নেহি বজি থি? ” নিজের কান’কে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না। এই মানসিক ভারসাম্যহীন শতছিন্ন কাপড়চোপড় পরা দেশোয়ালি মহিলা রাতে এখানে সানাই শুনতে পায়? হাঁ করে বসে আছি মহিলা হঠাৎ ইশারা করে কান পাততে বলে , ” ও দেখো…. শেহনাই কি আওয়াজ… সুনাই দি?”….. সংসারের হাজারো চিন্তা, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, দু-তিনটে ই.এম.আই, ক্রেডিট কার্ড- ডেবিট কার্ডের ভিড় ঠেলে সেই দিব্য সানাই এর শব্দেতর তরঙ্গ আমার মস্তিষ্কে পৌঁছল না। তবু বললাম,” হাঁ… সুনাই দিয়া মা’জি। ” উঠে দাঁড়ালাম।মন্ত্রমুগ্ধের মত চলতে থাকলাম।
আরবিতে ‘বিসমিল্লাহ্’ শব্দের অর্থ বোধহয় ‘ঈশ্বরের নামে শুরু’। আর যা স্বয়ং “তাঁর” নামে শুরু…. তাকে শেষ করে কার সাধ্যি?

12 thoughts on “গল্পঃ মূর্ছনা – তাবাস্সুম আরা

  1. বাঃ। বেশ ভালো লেখাতো। সানাইয়ের সুর মূর্ছনায় ও সুমধুর আওয়াজ শুধু শিক্ষিতজনদেরই টানে না সমাজের চোখে নিতান্ত অভাজন‌ও পরম নিশ্চিন্তে যেখানে খুশি ঘুমিয়ে পড়তে পারে। একেবারে ঠিক কথা। লেখিকাকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ সম্পাদক মন্দিরাকেও সুন্দর রচনা নির্বাচনের জন্য।

  2. সানাই -এর সুর , বাঁশির সুর তাঁর কৃপা হলে সবসময় শুনতে পাওয়া যায়। ‘সখি ওই বুঝি বাঁশি বাজে। বনমাঝে কি মনমাঝে।’

  3. ভারতরত্ন উস্তাদ বিসমিল্লাহ খান এর ভিটে, যা কি না আমার মতে সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দিলেও কম হত…. সেখানে শপিং মল!…. ভাবতেও কষ্ট লাগে। ধিক!

  4. মন ছুঁয়ে গেল গল্পটা। কার মনের গভীরে যে কি চলে তা অন্য কেউ বোঝে না!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *