কবি পার্থ বসুঃ বাংলার প্রাণের কবি
অনিরুদ্ধ সুব্রত
“আঘাত করলে লাগে আমার
নই ঋষি তো
খইফোটানো গ্রীষ্মদহন
বৈরী শীতও
দাঁত ফোটালে আদুড় গায়ে
গা ঢাকা দিই—
দিতাম। এবার যুদ্ধে যাবো
কোমর বাঁধি।।”
‘যুদ্ধের কবিতা’ — ‘স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর’ কাব্য গ্রন্থ থেকে )
তবে কী যুদ্ধের টেলিফোন এলো ? কিন্তু সব যুদ্ধ তো এখানে, সেখানে শুধুই শান্তি আর স্তব্ধতা । যে মানুষটি মানবতার প্রবল যোদ্ধা, সকল সংকীর্ণ ভেদ, অহংকারের, ক্ষুদ্রতার বিরুদ্ধে একটানা যুদ্ধ করে গেছেন ; সংকল্পে হয়ে উঠেছেন এক বিশ্ব- বাঙালি, তাঁর যুদ্ধ সত্যিই থেমে যায় না । মানবতার স্তবগাথায় জীবনকে দৃঢ় প্রত্যয়ী রেখেও অমলিন মুখবন্ধে নিজেকে ঋষি বলতে চান না। নিয়মিত কবিতা চর্চা করে গেছেন গত শতকের সত্তরের দশক থেকে এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত । রক্ত মাংসের, পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের এক অকুতোভয় সত্যভাষী কবি হয়ে আছেন এই বাংলার শব্দে, ধ্বনিতে। তিনিই পার্থসারথি বসু, সদ্য প্রয়াত । মারণ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে মাত্র কয়েকটি দিনের ব্যবধানে এক প্রাণবন্ত সদা শান্ত বৈদগ্ধ্যের হলো আকস্মিক জীবনাবসান । আমরা হারালাম বলিষ্ঠ এক কবি, অভিভাবক তথা জীবন-ভাষ্য রচনার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকে।
ব্যক্তিগত যোগাযোগের সৌভাগ্য হয় নি, যতটুকু জেনেছি তাঁকে, আমার সামান্য লেখালিখির ফাঁকে । নিঃশব্দ, নিরহঙ্কার বাংলা ভাষা আর সাহিত্যের এক শান্ত সাধক পার্থ বসু। আদি বাস নৈহাটিতে হলেও কর্মসূত্রে হাওড়ার মানুষ ছিলেন ।দীর্ঘ কর্মজীবনে সামলেছেন ব্যাংকের দায়িত্বপূর্ণ পদ। ছাত্র জীবনে রসায়নে প্রেম, সৃজন-জীবনে তাঁর কাব্য ভাষা সাজিয়ে দিয়েছে রস,রূপ, গন্ধ, স্পর্শে । বাঙ্ময় হয়েছে বাঙালির অন্তর্গত বিবেক, সম্ভ্রম, বৈদগ্ধ।
কাব্য সংখ্যা দিয়ে কবিকে ছোঁয়ার মাত্রা বৃথা। বরং হেঁটে পৌঁছে যেতে হয়, প্রত্যেক সৃজনের গভীরে, আরও মর্মে। যাঁর কবিতা গ্রন্থের নামকরণ গুলো এক আশ্চর্য ভাবনার মোচড় দেয়— “শূকর পরাস্ত হোক” , “মুখ্য সমাচার পড়ছি” , “স্মৃতির সঙ্গে এই সহবাস ” অথবা ” কবিতা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর ” , “দিদিমণি শূন্য দিন ” , “ঢ্যামনা কবিতা গুচ্ছ ” বা “ব্যাঙ প্রথামত জিভটাকে উল্টে নেয়” প্রভৃতি । কবিতার বই-এর সংখ্যা গণনা রেখে বরং কবির দুটি একটি কবিতার আংশিক পাঠে যাই—
“অশনিসংকেত পড়ে একটি মেয়ের খুব খিদে পেয়েছিল।
সাহিত্যের ছাত্রী নয়,সাহিত্যের তত্ত্বে তথাকথিত দখল
হয়তো ছিল না, তাই অকপটে স্বীকার করেছে
অনুভব— সারল্যের কাছে আজও প্রাসঙ্গিক
বিভূতিভূষণ ।”
কবিতাঃ ‘পিতৃতর্পন’ ( তারাদাস বেন্দ্যোপাধ্যায়ের আলোচনা শুনে লেখা)
বিষয়ের গাম্ভীর্য ভেঙে, কাল প্রেক্ষিতের রূঢ় বাস্তবতায় তাকে ধরতে পারার এক সরস এবং গভীর সংবেদ রচনা কবির প্রকৃত নির্মাণ । তাই বিভূতিভূষণ পুত্র তারাদাস-এর আলোচনা থেকে পার্থ বসু পৌঁছে যান স্বতন্ত্র সংকেতে। সময় যেন নতুন করে পাঠ করে জীবনের পাঁচালী ।
আবার “বিবাহ প্রস্তাব” কবিতায় কবি দেশ কালের ছেদ, দ্বিধা, দ্বন্দ্বকে আর হৃদয়ের বিস্তীর্ণ দেশ ধারণার বৈপরীত্যে রচনা করেন এক মহাকাব্যিক উচ্চারণ—
“পরাজিত হব জানি, পরাজয় আমার নিয়তি ;
আমি ইতিহাস জানি
স্পার্টাকাস যে কথা জানতো না।
আমি জানি ক্রীটের পতন,
গুঁড়ো হয়ে গেছে কিভাবে
কার্থেজ
অথচ প্রস্তরীভূত কেবল বিজিত নয় বিজয়ীরও তেজ।
পাণ্ডব বর্জিত দেশে এই বঙ্গে পাথরও ছিল না
মায়াবী নদীর কোলে সাওঁতাল রমণী জন্ম দিয়েছিল
প্রপিতামহকে।” (কবিতাঃ ‘বিবাহ প্রস্তাব ‘ )
বাঙালি তার নিজস্ব ভাষা ,সংস্কৃতির, রীতি আঙ্গিকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে এটাই স্বাভাবিক । কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনের আগ্রাসন দীর্ঘ কাল শুধু অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক দখলে সাধ মিটিয়ে নেয় নি, ক্রমে হাত দিয়েছে ভাষা সংস্কৃতির সত্তায়। বিস্তীর্ণ বাংলার ভৌগোলিক এলাকা টুকরো টুকরো হয়েছে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় । যন্ত্রণা কিন্তু রয়ে গেছে হৃদয়ে হৃদয়ে ।
কবি পার্থসারথি বসু সেই মানুষের এক মানুষ— যে হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতেন। পরিচিত পরিমণ্ডলে দীর্ঘদিন বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির উপর বৈদেশিক যেমন, তেমনি প্রাদেশিক আগ্রাসন যথারীতি । কবি, ভাষাপ্রেমী পার্থ বসু বার বার সেই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার । কখনও মুক্ত কন্ঠে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন আঞ্চলিক, আদিবাসী ভাষা এবং সংস্কৃতি রক্ষার কঠিন দায় ও দায়িত্বের কথা। আলোচনা, সেমিনার, বক্তৃতা এবং দৃঢ় প্রত্যয়ী লেখায় বার বার উঠে এসেছে এই ভাষা-সৈনিকের কর্তব্য বোধ ।
আমরা সাধারণত খেয়াল রাখতে ভুলে যাই প্রতিদিনকার বাংলা তারিখ গণনা । আমরা ইংরেজি তারিখ গণনার অফিসিয়াল অভ্যাসের দাস। প্রায়ই ফেসবুকের ওয়ালে পার্থ বাবু রীতিমতো লিখে দিতেন—
” আজ ছাব্বিশে ভাদ্র, কৃষ্ণ দশমী শনিবার
চৌদ্দশ’ সাতাশ বঙ্গাব্দ
২৬ \ ০৫ \ ১৪২৭ বাংলা “
(পার্থসারথি বসু, ফেসবুক পেজ )
এই বাংলা দিন গণনা রীতির বিরল অভ্যাস সত্যিই ক’জন করতে পেরেছেন । যাঁর কর্মজীবন কেটেছে ব্যাংকের হিসাব অঙ্কের ইংরেজি রীতি পদ্ধতির ঘেরাটোপে । অথচ আদ্যন্ত বাংলা আর বাঙালির নিজস্ব রুচি, শ্লাঘা তাকে শুধু একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি করেনি, করেছে বাঙালি ঐতিহ্যের ধারক। কবি তো সামাজিক মানুষ, তাঁর হুঁশ কখনওই মৌলিক চেতনা থেকে বিন্দুমাত্র চ্যুত হয়নি। তাই কবিতায় তিনি যতই লিখুন নই ঋষি , আমরা দেখি তিনিই প্রকৃত এক বাংলার ভাষা সংস্কৃতি ধ্যানের ঋষি।
স্যোসাল মিডিয়া ওয়ালে জাতীয় আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ে তাঁর নিজস্ব মতামত সুস্পষ্ট এবং দৃঢ় ছিল আমৃত্যু । অতি সম্প্রতি এমনই একটি পোস্ট থেকে যৎসামান্য উল্লেখ করি— ” মোড়কে নাগরীলিপি হিন্দি আগ্রাসন । বাংলা না থাকলে বর্জন করুন । যতোটা সম্ভব । বাংলার জনবিন্যাস পরিকল্পিত ভাবে পাল্টে যাচ্ছে । অনেক দেরি হয়ে গেছে । বাংলার লবন উৎপাদন ও পোস্ত চাষের অধিকার ফেরত চাই। বাংলার খনিজে দিল্লির নয়,বাংলার অধিকার চাই ।” ( পার্থসারথি বসু, ফেসবুক পেজ)
সামাজিক শ্রেণি, বর্ণ,সম্প্রদায় বিভাজন তাঁর চরম অপছেন্দর। বিরক্ত হয়েছেন বারবার । কখনও মন্তব্য করেছেন সংক্ষেপে, স্বল্প কথায় । ব্যঙ্গ, শ্লেষে, সরসসতায়—
” শুদ্রকে নমঃশুদ্রে বিভাজনও একটি
ব্রাহ্মণ্যবাদী অপকৌশল। তারাও পৈতা চায় !পেলে।
বর্ণবাদ বিলুপ্ত হোক।”
( পার্থসারথি বসু, ফেসবুক পেজ)
এ সব শুধু বিচ্ছিন্ন কথার কথা নয়, মানবতাবাদী কবি হৃদয়ে উত্থিত ক্ষোভ, প্রতিবাদ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিন্দু বিন্দু ছড়িয়ে পড়েছে ভাষার অবয়বে । অর্থাৎ কবির মনন আর যাপন -এর মাঝে এতটুকু দ্বিচারিতার কোনও স্থান নেই।
কবির কবি- আত্মার যে প্রতিবাদী সত্তা, তার একটি উচ্চারণে যথেষ্ট স্পষ্ট—
“কে করেছে ? আজ সেই
কৈফিয়ৎ বুঝে নেওয়া চাই,
যেন গভীর প্রস্তুতি তাই
গ্রামেগঞ্জে তুফান সক্রিয়
আজকাল । তারা বরদাস্ত করবে না
আর কোন ভাসাভাসা কৌতুহল,
অপ্রয়োজনীয় উঁকিঝুঁকি
তার বুকে জ্বলছে
দুঃশাসনের রক্তপিপাসু
অনল। যেন ভাগ্যের দোহাই পেড়ে আর কোন
অপেক্ষা নয়, কবে ক্ষিপ্ত অশান্ত বাসুকী
মাথা নাড়লেই প্রলয় হবে—-
দুর্মর শপথে বাড়ে যে বধিবে।”
( কাব্যঃ ব্যাঙ প্রথামত জিভটাকে উল্টে নেয়)
ব্যক্তিগত জীবন-অভিজ্ঞতা, পুরাণ মহাকাব্যের ঋদ্ধ পাঠ, সময় আর মানবতায় দৃঢ় প্রত্যয় কবির মনোভূমি । ইতিহাসের ক্রমপরিবর্তিত গতিবিধি, রথচক্রের ধূলিধূসর পথ, সাধারণ ছোটো ছোটো স্বপ্ন-প্রবণ মানুষের জীবনে নিয়ত ঘটে যাওয়া আঘাত, পতন— কবির রচনা ক্ষেত্র। তবু প্রেম চিরন্তন, স্বদেশ, জন্মভূমির প্রতি আকাঙ্ক্ষা ভালবাসা । কখনও বাৎসল্য রসের উৎস্রোতে অধ্যাত্ম চেতনার স্ফূরণ। কখনও সেই আদি সভ্যতার অতীতদর্শী কবি—
” যেন কল্পনার ইজেল পাতলেই নামধাম
কিছু না জেনেই এমনকি অচেনা কোন বৃক্ষ
তার অকৃপণ ছায়ার সুষমা দেয়। অকুলীন
কিন্তু মনোরম কিছু ইচ্ছার আদর পায় টাকরায়
ভালো লাগা আস্বাদের লাজুক শেঁকুল,
এমনকি মনসার ঝোপে বুঝি কোন স্নেহের
বিছানা— ”
( কবিতাঃ ‘গ্রামে’ )
কবিতার পাশাপাশি পার্থসারথি বসু গদ্য রচনাতেও ছিলেন সাবলীল, আকর্ষণীয় । সম্প্রতি ‘অবেক্ষণে’র পাতায় পাশাপাশি কলম সতীর্থ ছিলাম। কিন্তু সে সৌভাগ্য দীর্ঘমেয়াদি হলো না । বয়সে পিতৃতুল্য হলেও এই নিঃশব্দ বন্ধুত্ব দীর্ঘদিন বেদনা জাগিয়ে রাখবে মনের গভীরে । মুখোমুখি কথা বিনিময়ের আশা আর কোনও দিনই মিটবে না। তবু এই শ্রদ্ধা নিবদন গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজো হয়ে যদি অনন্ত সমুদ্র পরিণতিতে মিশে যায়, সে-ই সুন্দর । জীবনে বহুমুখী সৃজনে পার্থ বসু এক বিশিষ্ট নাম হয়ে থাকবেন তাঁর অগণিত পাঠক,গুণমুগ্ধ হৃদয়ে ।
তবু বেঁচে থাকতে আরও সম্মান প্রয়োজন ছিল । কিন্তু কবির জীবনের ট্রাজেডি এই, সব কথা উত্থিত হয় মরণের পরে। পেয়েছেন বাংলাদেশ থেকে ‘শ্রেষ্ঠ বাঙালি পুরস্কার ‘। বিভিন্ন পত্র পত্রিকার সম্মানও পেয়েছেন, তবু তাঁর কবিতা, গদ্য চর্চার বিস্তৃত ভূবনে পাঠকদের অবাধ যাতায়াতই আসল সম্মান । আরও আরও আলোচনায় আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার স্বরূপ খুঁজে যেতে চাই দীর্ঘ দীর্ঘকাল। নব নব সত্তায় যত খুঁজে পাই তাঁকে, সেই তো অমরত্ব, সেই তো সৃষ্টিতে চির বেঁচে থাকা। স্বর্গীয় আত্মার তাতে অধিক শান্তি । —- অনিরুদ্ধ সুব্রত ।
অপূর্ব। সৃষ্টি র মধ্যে বেঁচে থাকবেন।
আপনিও অপূর্ব স্মৃতিচারণ করেছেন। কবি তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন । গভীর শ্রদ্ধা জানাই কবিকে ।
পার্থ বসু সম্বন্ধে অনেক তথ্য – লেখক অনিরুদ্ধ সুব্রত বাবুর বলিষ্ঠ কলমে সুন্দর করে বর্ণিত।
একজন কবিই পারেন আরেকজন কবিকে প্রকৃত মূল্যায়ন করতে। -কৌস্তভ বন্দ্যোপাধ্যায়
সুন্দর বিশ্লেষণ এবং স্মৃতি তর্পণ।
একজন কবিই পারেন আরেকজন কবিকে প্রকৃত মূল্যায়ন করতে। -কৌস্তভ বন্দ্যোপাধ্যায়