জীবন কথা : যে টেলিফোন … পার্থ বসু
রোগশয্যা থেকেই লিখছি। মহালয়া আসন্ন। আজ আগাম লিখি মহালয়ার কথা।
গল্পটি ১৯৯৮ সালের। ব্যাঙ্কে কর্তাভজা ছিলাম না। চাকরি পরীক্ষায় জীবনের লক্ষ্য লিখি নি চেয়ারম্যান হবো। প্রমোশন নেব পরের পর।
চল্লিশ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতায় বুঝেছি ভারতে সব চেয়ে বেশী মেধার অপচয় হয় ব্যাঙ্কেই। একটা ব্যাঙ্কের শাখায় ম্যানেজারি করতে ক্লাস এইটের বেশী বিদ্যে লাগে না। ফার্স্ট বয় হলে লাগে। ?
এখন তো রিজার্ভ ব্যাঙ্ক চালাতেও অর্থনীতি পড়তে হয় না।
বেশী বললে রাজনীতি হয়ে য়াবে। ইশারায় বুঝুন।
মা বাবা দুজনেই আমায় ছেড়ে গেছিলেন সাতানব্বই সালে। মা জুনে। ছয় মাসের ব্যবধানে ডিসেম্বরে বাবা।
ওই যে কর্তাভজা ছিলাম না! এমনকি অফিসার ইউনিয়নের নেকনজরে। তেল দিই নি কাউকেই। তাদের কলকাঠিতে দ্বিতীয় দফায় আবার বরাকে। আসাম লিখলাম। এখন জানি ওটা ঈশান বাংলা।
গৌহাটি পেলে রেলপথে অবরে সবরে চব্বিশ ঘন্টায় বাড়ি আসতে পারতাম। দেশভাগের আগে ঢাকা করিমগঞ্জ ছিল বারো ঘন্টার রাস্তা। অখণ্ড বাংলায় সরাসরি কম সময়ে আসা যেতো। এখন ব্যাঙ্ক না ডাকলে কলকাতায় যাওয়া নেই। এমনকি আঞ্চলিক অফিসও গৌহাটিতে আনা হয়েছে।
তখন আজকের মতো মোবাইল নেই। বাড়িতে ফোন এলো মা বাবার মৃত্যুর পর।
তর্পনের কথায় আসি। বাবা নিয়মিত বাড়িতে তর্পন করতেন। প্রয়াত পূর্বপুরুষ পূর্বমাতা, আত্মীয় অনাত্মীয়, শত্রুমিত্র, একনকি, সর্বজীব পশুপাখিকে জল দেয়াটি তর্ক নয় কবিতার বিষয়। বেদের কবিতা। বাবা মায়ের শ্রাদ্ধে যখন মন্ত্র পড়ছি
মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সৈন্ধব। স্তম্ভিত হয়েছি।
বাবাকে কিন্তু গঙ্গায় যেতে দেখি নি কখনো।
সাতানব্বইয়ে মায়ের তর্পন বাড়িতে করি নি। বাবা তখন মৃত্যুশয্যায়। কার কাছেই বা শিখবো?
বাবাকে তবু হসপাতালে পাঠিয়ে সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসা দিয়েছি পীয়ারলেস থেকে। শেষ কয়েক বছর চোখে দেখতেন না। ঝাপসা দেখতেন। মাইক্রোসার্জারি করিয়েছিলাম ডা এটিএম আলি হোসেনের বাড়িতে।ফল হয় নি!
তবু বাবা বাঁচতে চেয়েছিলেন। আমি তাঁর অন্ধের যষ্ঠী।আমার গর্বিত পিতা। মায়ের মৃত্যু তাঁকে ভেঙে দিল! মা কিন্তু নিজের রোগের কথা বলতেন না। মা জীবনে একটা স্যারিডনও খাননি। যশোর মাগুরার মেয়ে।অনেক টোটকা জানতেন। আমরা একচক্ষু হরিণের মতো বাবাকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। মায়ের দিকে নজর দিই নি।
মা গেছিলেন সত্তর বছরে। বাবা চুরাশিতে। বাবা একটু বেশী বয়সেই বিয়ে করেছিলেন। আমি বাবা মার চতুর্থ সন্তান। আগের দুই ভাই বাঁচে নি। তারপর আমার এক দিদি,আমি, আর আমার আরও তিনটি বোন।
বাবার সঙ্গে আমৃত্যু কথা বলেছি। কিন্তু মা জীবননাট্যের সেই চরিত্র যিনি সব কটি সংলাপ বলেই গেলেন না।তখন বাড়িতে টেলিফোন ছিল না। মাত্র দিন সাতেক আগেই দিদির বাড়ি ঘুরে এসেছি।
মায়ের আর কি বলার ছিল?
মা যাওয়ার পর স্বপ্নেও আসছেন। মৌন। আমিই বা কি বলতাম? কথার খেই হারিয়ে বিপর্যয়।
যে কথা বলছিলাম। মা দিদির বাড়িতে সেরিব্রাল অ্যাটাকে মারা যান। কোন চিকিৎসারও সুযোগ দেন নি।
তো শিলচরে এসে মনে হলো বাবা মা দুজনেই বিদেহ নগরে। তর্পন করলে যদি দেখা পাই। অনুভবে। কথা বলি?
শিলচরে আমার পাশের কোয়ার্টারে থাকতেন শিলচর দূরদর্শনের উচ্চপদে আসীন আমীর খানের ছাত্রী মালিনী মুখোপাধ্যায়ের মা মীরা মুখোপাধ্যায়।তাঁকে মাসীমা ডাকলাম। কবিতার আগ্রাসী পাঠক। আমার কবিতা তিনি পড়েছেন বললেন!
তর্পনের কথায় বললেন— তুমি কবি। কবিতায় তর্পন কর। কথা বলো। সেই আমার দেড় বছর পর মায়ের সাথে কথা। মায়ের টেলিফোন নং যদি মহাকাল জানান কথা হবে।
কবিতা দুটিই শিলচর দূরদর্শনে সারা ভারত কবিবসম্মেলনে পড়েছিলাম।
প্রথমে টেলিফোন পড়াবো।
তর্পনের পর লেখার অবস্থায় থাকবো না।
#
আজ মা দিবস।মা ১৯৯৭
টেলিফোন/ পার্থ বসু
আপনারা চলে যাওয়ার ক’দিন বাদে
টেলিফোন এসে গেছে আমাদের ঘরে।
খুশী হয়েছেন এ নতুন সংবাদে?
শীঘ্র জানান আমি কোন নম্বরে
ডায়াল করবো? মাঝে মাঝে কিছু কথা
দেখা নাই হোক ইচ্ছে তো হয় বলি।
একা থাকলেই অখন্ড নীরবতা
ঘিরে ধরে এসে, সময়ের হাতে বলি
একদিন বটে হব সকলেই জানি
তবু যোগাযোগ থাকবে না একেবারে
এ কেমন কথা? দূরভাষে কানাকানি
দেখা নাই হোক এটুকু তো হতে পারে?
যদি মহাকাল বিনীত আর্তি শোনে
কান পেতে আছি ইপ্সিত টেলিফোনে।
এখন সমগ্র বাংলাই আমার মা।আবহমান বাংলা মায়ের কোল থেকে যেন কখনও বঞ্চিত না হই মা দিবসে এই প্রার্থনা। আমৃত্যু যেন বাংলা মায়ের সন্তান গর্বিত বাঙালি হয়ে বাঁচি। জয় বাংলা মা। জয় বাংলা!
#
তর্পণ / পার্থ বসু
তোমার নাতনীর জন্য মণিপুরী মেখলা কিনেছি,
তোমার নাতির জন্য নাগাদের বাহারী জ্যাকেট।
ওরা দুজনেই পরবে, ভাই বোন আর ঠাকুমাও
মানে তুমি বেঁচে থাকলে ওরা তা তোমাকে পরাতোই।
তোমার বৌমার জন্য কি কিনেছি? জানতে চাও নাকি?
তুমি গেছ, সে এখন হয়ে গেছে ভীষণ সংসারী।
সে এখন চায়ে কম চিনি দেয়, লবন বিষয়ে
ডাক্তারের সতর্কতা মান্য করে কাঁটায় কাঁটায়।
সে এখন সব কিছুতে না না করে, কিনতে চায় না কিছু।
সে কেবল দেখতে চায় ছেলেমেয়ে ভালো থাকলো কিনা,
সে এখন আঁতকে ওঠে তার জন্য কোন উপহার
যদি একটু দাম দিয়ে কিনে ফেলি সে কেনে নিজেই।
খবর শুনলে তো? আজ মহালয়া, ভোরের শিশিরে ঝরছে তোমাদের স্নেহ।
পথে খুব ক্লান্তি হোল? তর্পণের জল দিলাম, খেও।।
আপনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন। ভীষন ভালো লাগলো। আগামী তে অপেক্ষা য় থাকবো।
খুব ভালো লাগল।
Mon chuye gelo lekhata pore
অসাধারণ লাগলো ।
ঈশ্বরের কৃপায় আপনি স্বপরিবারে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন।অসাধারণ লিখেছেন।
চারটি পর্বই অতুলনী। ভীষণ ভালো লেগেছে।
বহুপঠিত এই কবিতাটা দুটি যে ওর মৃত্যুর পর এভাবে আবার পড়তে হবে ভাবিনি।