আমার মা
নির্মাল্য বিশ্বাস
আজ আমি মায়ের কথা বলব। মা’র কথা তো আমি কাউকে বলিনি কোনদিন। মাকে নিয়ে কেন লিখিনি তাও আমার জানা নেই।চোখ বন্ধ করে এমনকি চোখ চেয়েও যে মুখটা ভেসে ওঠে সেটা একটা চব্বিশ- পঁচিশ বছর বয়সী তরুণীর, যে হয়তো এই যুগে জন্মালে ওই বয়সে কলেজ কিংবা ইউনিভার্সিটি করে হেসেখেলে বেড়াত। সেই তরুণীর মুখের সাথে কেউ বৈজয়ন্তীমালা আবার কেউ মধুবালার সাদৃশ্য খুঁজে পেত। মিল সত্যিই কতোটা ছিল সেটা আমি জানি না। আমি শুধু জানি সে ছিল এই দুই নায়িকার থেকে অনেক বেশি সুন্দরী। সে যাই হোক সেই তরুণীই ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে তুলে তার পাঁচ বছরের ছেলের মুখে টুথব্রাশ গুঁজে দিত। আর সেই ছোট্ট ছেলেটা ব্রাশ মুখে দিয়ে তার মা’র কাঁধে মাথা রেখে আবার ঘুমিয়ে পড়ত। ছোট্ট ছেলেটা জানত না ঘুমের মধ্যেই কিভাবে তার দাঁত মাজিয়ে দিত তার মা। তারপর খাইয়ে দাইয়ে টিফিন রেডি করে স্কুলে পাঠাত। সেইদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটাই আমি।দমদম পার্ক থেকে বরানগর রামকৃষ্ণ মিশন রাস্তাটা কম দূরের নয়। দু’ চাকা সাইকেলে চাপিয়ে আমাকে নিয়ে যেতে বাবার প্রায় এক ঘন্টা লেগে যেত। তাহলেই ভাবুন কোন ভোরবেলায় মা’কে উঠে সব কিছু রেডি করে আমাকে স্কুলে পাঠাতে হত। ছুটির সময় স্কুল থেকে নিয়ে আসত মা। প্রতিদিন কাচা ধবধবে সাদা জামা পরিয়ে স্কুল পাঠাত আর সেই জামা কালো চিটকুটটি করে আমি বাড়ি ফিরতাম। মা বলত – ‘স্কুলে কী চাষ করতে যাস?’ বলার সাথে সাথে পালিশও চলত পিঠে। মা’র কড়া শাসন আর চোখ রাঙানিকে যমের মত ভয় পেতাম। যা কিছু দুষ্টুমি সব মা’র চোখের আড়ালে। মেজাজ ঠিক থাকলে মা গল্প বলত – চিত্রগুপ্তের বিচিত্র খাতায় সব মানুষের পাপপুণ্যের হিসেব লেখা আছে। পূর্বজন্মে যে যত পাপ করবে পরজন্মে তার তত কঠিন কঠিন শাস্তি। মা’র কল্যাণেই সেই ছোট্ট বয়সে পূর্বজন্ম, ইহকাল, পরকাল নামক কঠিন কঠিন শব্দগুলোর অর্থ বুঝে গেছি।
গান ছিল মা’র সব থেকে প্রিয়। কেমন ছিল মা’র গানের গলা? একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। গানের কোন প্রতিযোগিতাতেই মা কখনো দ্বিতীয় হয়নি। একবার এক স্বনামধন্য গায়ক (নামটা বললাম না) বিচারক হয়ে এসেছিলেন। যে কোন কারণেই হোক তিনি চাইছিলেন না মা প্রথম হোক। এমন এমন সব প্রশ্ন করছিলেন যেগুলোর উত্তর দেওয়া সাধারণের কর্ম নয়। মা সব প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর দিয়েছিল। তখন সেই বিচারক এক তালের গান অন্য তালে গেয়ে দেখাতে বলেন। মা সেটাও করে দেখিয়ে প্রথম পুরস্কার জিতেছিল। আমার জন্মের আগেই রবীন্দ্রসঙ্গীত আর ক্লাসিকালে ফিফট ইয়ার কমপ্লিট করে ফেলেছিল। সবেতেই ফাস্ট ক্লাস ডিসটিংশান। এইচ.এম.ভি থেকে হেমন্ত মুখার্জির সাথে এলবাম করার প্রস্তাবও এসেছিল। সংসারের কাজ সামলাতে অসুবিধা হবে এই অজুহাতে মা’কে রেকর্ডিং করতে যেতে বারণ করা হয়। গান ছিল যার প্রাণ সেই মানুষটাই একদিন চরম অভিমানে গান ছেড়ে দিল। কার প্রতি অভিমানে, কিসের অভিমানে তা আমার জানা নেই। সে জানার বয়সটাও হয়নি তখন। পরে জেনেছি, পরে মানে অনেক পরে; জেনেছি মা গান করুক এটা মা’র শ্বশুর বাড়ির লোকেরা পছন্দ করত না। গান করলে সংসার সামলাবে কে? অদ্ভুত যুক্তি। অথচ আমি দেখতাম ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে আমাদের ছ’ জনের সংসারের সব কাজ মা একা হাতেই সামলাত। রান্না করা থেকে শুরু করে, ঘরদোর পরিষ্কার করা, আমাকে পড়ানো সব কাজই মা একা হাতেই করত। এমন গুছিয়ে পরিপাটি করে সংসার করতে আমি আর কাউকে দেখিনি। তবু সব যুক্তি, সব প্রতিরোধ সেদিন হার মেনেছিল এক ছেঁদো যুক্তির কাছে। বাবা অবশ্য চাইত মা গান করুক। কিন্তু বড়দের মুখের ওপর কিছু বলার ক্ষমতা ছিল না। তাই মা’র সাধের হারমোনিয়ামটা খাটের তলায় বসে ধুলোর সাথে বন্ধুত্ব পাতাল। তারপরেও মা গাইত, একাকী আনমনে কিংবা অনেক রাতে আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মা’র গলা দিয়ে বেরিয়ে আসত – ‘হাজার তারার আলোয় ভরা চোখের তারা তুই… স্বপ্ন দিয়ে সাজাই তোকে অশ্রু দিয়ে ধুই।’ সেটা গান ছিল না অশ্রু ছিল আমার জানা নেই। শুধু মনে আছে খোলা জানলার ফাঁক দিয়ে জোছনার মায়াবী আলো মা’র দু’গাল ভিজিয়ে দিত আর সেই আলো অন্ধকারে মা’র স্বপ্নগুলো জোছনার রঙে মাখামাখি হয়ে টুপটুপ করে আমার বালিশ বিছানা ভিজিয়ে দিত। ছোট্ট পাঁচ-ছ বছরের ছেলেটার চোখে তখন রাজ্যের ঘুম নেমে আসত। তার কচি চোখের পাতায় স্বপ্নরা খেলা করছে- মা গান গাইবে, আবার গান গাইবে।মা তার অধরা স্বপ্ন পূরণ করতে চাইত আমাকে দিয়ে। সব মা’ই সেটা চায়। কিন্তু মা’কে কি করে বোঝাই গান শিখতে আমার এতটুকু আগ্রহ নেই। আমার যাবতীয় আগ্রহ মা’র গান শোনায়। তবু মা’র প্রবল জোরাজুরিতে বছর চারেক গান শিখে থার্ড ইয়ার পরীক্ষাও দিই। কিন্তু বেশি দিন আমাকে শেখানো গেল না। আমার শুধু মনে হত আমি গান শিখলে মা’র আর গান শোনা হবে না। তার থেকে ভালো তবলা বাজানো। জোর করে মা’কে হারমোনিয়াম নিয়ে বসাতাম। তবলা ছিল না। কাঠের খাট কিংবা হারমোনিয়ামের ডালাটাকেই তবলা করে নিতাম। পরে তবলার প্রতি আগ্রহ দেখে মা আমাকে গান ছাড়িয়ে তবলার স্কুলে ভর্তি করে দেয়। কারোর সামনে মা গান করত না। গান না গেয়ে অদ্ভুত একটা কমপ্লেক্স তৈরি হয়ে গিয়েছিল মা’র মনে। তাই গান গাইতে বসলে দরজা জানলা বন্ধ করে মা গাইত। বদ্ধ ঘরের ভিতরেই চলত মা-ছেলের তবলা আর গানের যুগলবন্দি।বড় হবার সাথে সাথে আমার নিজস্ব চিন্তা ভাবনাগুলো একটু একটু করে সক্রিয় হতে শুরু করে। মায়ের আঁচল ছেড়ে বেরোনোর পর বুঝেছি ঈশ্বর বলে কারোর অস্তিত্ব নেই। আমি পাপ পুণ্য মানি, ইহকাল-পরকাল মানি; শুধু ঈশ্বর বলে কোন সৃষ্টিকর্তা আছেন এটাই মানতে পারি না। ঠাকুরের প্রসাদ দিতে এলে মা’র অলক্ষ্যে সেই প্রসাদ আমি কতবার ফেলে দিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। হোমের তাপ আঁচলে ভরে রেখে দিত মা। সেই আঁচলের তাপ আমার মাথায় ছোঁয়াতে এলে আমি অবজ্ঞাভরে মুখ সরিয়ে নিতাম। তবু মা নাছোড়। আমার প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করেই কোনরকমে সেই আঁচল আমার মাথায় ছুঁইয়ে দিত। মা’র সেই আঁচলে জড়ানো বিশ্বাসের তাপে আমার কতখানি পুণ্য অর্জন হত জানি না কিন্তু মা’কে অবজ্ঞা করে যে পাপ জমত সে পাপক্ষালনের ক্ষমতা পৃথিবীর কোন ঈশ্বরেরই ছিল না। কিন্তু কী করি বলুন তো? আমি তো মায়ের থেকে বড় ঈশ্বর আর একটাও দেখিনি। অন্য কাউকে ঈশ্বর মানি কী করে?
প্রতিটা সম্পর্কের মত মা’র সাথে আমার সম্পর্কের গ্রাফটাও বারবার ওঠানামা করেছে। মা’র সাথে সরাসরি সংঘাত শুরু হল যখন মা’কে এসে বললাম, ‘আমার পছন্দের পাত্রী আমি নিজেই ঠিক করেছি।’ মা শুনে বলল- ‘অসম্ভব,এ বিয়ে আমি মানতে পারব না। তুমি যখন ছোট ছিলে তখনই আমি একজনকে কথা দিয়েছি তার মেয়ের সাথেই তোমার বিয়ে দেব।’ আমি বললাম, ‘সেটা আমার জানার কথা নয়।এখনকার দিনে এত বছর আগে থেকে কেউ এরকম কথা দেয় নাকি? তাছাড়া আমিও তো একজনকে কথা দিয়েছি। তাকে ছেড়ে তোমার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করি কী করে?’ কথা রাখার দাম যে দু’জনের কাছেই বড্ড বেশি। এ ভাবে তিন বছর সম্পর্কের টানাপোড়েন চলল।কথাবার্তা বন্ধ, হলেও সেটা নিতান্তই দায়সারা। স্নায়ুযুদ্ধে একে অপরের পরীক্ষা নিচ্ছি যেন। অবশেষে কথা রাখা আর না রাখার যুদ্ধে ছেলেই জয়ী হল। ঘরের বউ হয়ে যে মানুষটা এল, দশ বছর সংসার করার পর তার উপলব্ধি -‘বাপি -মামণির (আমার বাবা- মা) থেকে আমি যে ভালবাসা পেয়েছি সে ভালবাসা আমি আমার বাবা মায়ের থেকেও পাইনি।’আমার সরকারি চাকরি নয়। পাঁচ-ছ বছর আগেও চাকরিতে কোন স্থিরতা ছিল না। একবার এই চাকরি ছাড়ছি, পরদিন অন্য চাকরি ধরছি। রোজগারপাতিও যা হত সেটা পাঁচজনের সংসারের পক্ষে খুবই কম। তবু মা সবকিছু এত সুন্দরভাবে ম্যানেজ করত যে অস্বাচ্ছন্দ্যগুলো সংসারের কারোরই চোখে পড়ত না। বেসরকারি চাকরি হলে যা হয়। সকাল আটটার মধ্যে কোনোরকমে নাকে মুখে দুটো গুঁজে অফিস ছোটা। মা তার মধ্যেই ভাত করে, টিফিন রেডি করে টিফিন বক্সটা ব্যাগের মধ্যে ভরে দিত।টিফিন দিতে এক মিনিট দেরি হলেই আমি ব্যাগ নিয়ে সোজা হাঁটা দিতাম। টিফিন না নিয়ে গেলে মা যে কতটা কষ্ট পায় সেটাও আমার অজানা নয়। হয়তো দুপুরে ঠিক মতো খাওয়াও হয় না মা’র। তবু মা’কে শাস্তি দেবার জন্য ইচ্ছা করেই আমি এমন করতাম। আমার ছেলেমানুষি যুক্তি- মা কেন টিফিন দিতে দেরি করবে? এদিকে তেজ দেখিয়ে তো টিফিন না নিয়ে অফিস চলে এসেছি। কিন্তু বাইরের খাবারও মুখে রোচে না আমার। মা’র হাতের রান্না যে অমৃত। সব থেকে অসুবিধা হয় যখন মায়েরা বাইরে বেড়াতে যায়। তখন শুধু মনে হয় মা কবে বাড়ি ফিরবে? ওদিকে বাডি ফিরে দেখি মা’র মুখ হাঁড়ি। দোষটা আমারই। তবু ‘সরি’ বলে মিটিয়ে নেবার কোন শখই আমার নেই। ভাঙব তবু মচকাব না। তাই কথাবার্তা বন্ধ থাকত দু’দিন। আসলে রাগ, জেদ, অভিমানগুলো অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ- প্রতঙ্গের মতো মা’র শরীর থেকে আমার শরীরে চলে এসেছে।আমার প্রতিটা জন্মদিন মা স্পেশাল করে তুলত। ছোটবেলায় আমার বন্ধু বান্ধবদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াত। একটু বড় হতে জন্মদিন পালনে আমার আপত্তি থাকায় আমার পছন্দের বিরিয়ানি- মাংস রেঁধে খাওয়াত। সাত সকালেই আমার হাতে তুলে দিত নতুন জামা। অথচ ভাবতে অবাক লাগে মা’র জন্মদিনগুলো কেমন নিঃশব্দে আসত আবার নিঃশব্দেই চলে যেত। কোন উপহার দেওয়া তো দূরের কথা মা’কে সামান্য জন্মদিনের উইশটুকুও করতাম না। কেন করতাম না তার উত্তরও আমার জানা নেই। হয়তো মনে হতো মা’র থেকে শুধু পাওয়াটাই আমার জন্মগত অধিকার। চল্লিশ বছর বয়সে মা’র জন্মদিন পালন করার কথা প্রথম অনুভব করি। সেবার কেক কেটে মা’কে গিফ্ট দিয়ে দারুণভাবে সেলিব্রেট করেছিলাম আমরা পাঁচজন। মা’র তখন ষাট বছর বয়স। কিছু কিছু ক্ষেত্রে উপলব্ধিগুলো এতো দেরিতে আসে কেন? তারপর থেকে অবশ্য প্রতি বছরই মা’র জন্মদিন পালন করে আমার কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করে চলেছি।
আগেই বলেছি আমি ঈশ্বর মানি না। তবে পাপ পুণ্য মানি, পরজন্মের অস্তিত্ব মানি। তবু ঈশ্বর বলে কারোর অস্তিত্ব যদি সত্যিই থেকে থাকে আর আমি ইহজন্মে একটাই মাত্র পুণ্যের কাজ করে থাকি আর তার পুরস্কার স্বরূপ আমাকে কেবলমাত্র একটিই জিনিস চাইতে বলা হয় তাহলে আমি চাইব প্রতিটা জন্মেই আমি যেন আমার মা’কে পাই।
❤️❤️🙂
মায়ের স্মৃতি চারণ করেছেন সুন্দর সাবলীল ভঙ্গিমায়। খুব ভাল।
খুব ভালো লাগলো
“মা” একটা অক্ষর, একটা শব্দ, একটা গোটা পৃথিবী।
খুব ভালো লাগলো
খুব ভালো লাগলো