জীবন কথাঃ শ্রী পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য সম্বন্ধে – ভূমিকা গোস্বামী

জীবন কথাঃ শ্রী পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য সম্বন্ধে – ভূমিকা গোস্বামী

একশো বছরের নিরোগ দেহ, আর তরুণ মনের মানুষ শ্রী পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য। এখনও শ্রীঅরবিন্দের ইংরেজী ইলিয়ান কাব্য বাংলায় কাব্য আকারে অনুবাদ করে চলেছেন। পঞ্চাশ বছর ধরে “সাহিত্য মেলা” পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন নিরলসভাবে। সম্প্রতি চোখের সমস্যার কারণে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র পত্রিকার দায়িত্ব সামলাচ্ছে।
কোন বিষাদে ডুবে যাওয়া, সংসার সমস্যায় জর্জরিত মানুষ তাঁর সংস্পর্শে এলে নতুন জীবন লাভ করে আলোর সন্ধান পায় – তিনি তাঁর জীবনে সম্ভূতি এবং অসম্ভূতি দুটো ডানায় ভর করে চলেছেন।বস্তু বাদ এবং ভাব বাদের এমন ব্যালেন্স খুব কম মানুষের মধ্যে দেখা যায়। যাঁদের থাকে তাঁরা অমর ও অমৃতের অধিকারী হন।
সেই অসম্ভব প্রাণবন্ত পজিটিভ মানুষ শ্রী পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য। সমস্ত খারাপের মধ্যেও ভাল কিছু দেখতে ও দেখাতে জানেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করেন মানুষের মধ্যে অসীম শক্তি নিহিত আছে সেই শক্তিকে প্রকাশ করাতে প্রাণপণ চেষ্টা করেন তিনি।
১৯২০ সালের ১০ই অক্টোবর। মহালয়া ছিল সেদিন। মৈমনসিংহের গৌরীপুরের রাজবাড়ীতে বেলা ৩ টে ১৮মিনিটে শঙ্খধ্বনি আর উলুধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত। বংশের প্রথম পুত্রসন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। কবি যতীন্দ্র প্রসাদ ভট্টাচার্য ও হেমপ্রভা দেবীর প্রথম সন্তান পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য। সবাই আদর করে ডাকে বাদল। ভয় ডর নেই। অত্যন্ত মেধাবী শিশুকে বাগে আনতে বাবা মা কাকা ঠাকুমা হিমসিম। লেখাপড়ার ভার পড়লো সেজকাকা নরেন্দ্র প্রসাদ ভট্টাচার্যের ওপর। তিনি ডাক্তার ছিলেন। অল্পদিনের মধ্যেই বর্ণপরিচয় আয়ত্ত করে ফেলে বাদল। স্কুলে ভর্তি হয়।
পূর্ণেন্দু প্রসাদের মেজ ঠাকুরদা মানে মৈমনসিংহ গৌরীপুর এস্টেটের রাজা ব্রজেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী জন্মসুত্রে তিনি রাজশাহি বলিহারের রজনী প্রসাদ ভট্টাচার্য। মৈমনসিং গৌরীপুরের রাণী নিঃসন্তান বিধবা হয়ে যাবার পর তিনি রাজসাহি বলিহারের দিদির পাঁচ ছেলের মধ্যে প্রথম দুই জনকে চেয়ে নেন। প্রথম জন রোহিনী প্রসাদ ভট্টাচার্য হলেন পূর্ণেন্দু প্রসাদের পিতামহ। দ্বিতীয় জন রজনী প্রসাদ ভট্টাচার্যকে মাসি দত্তক নিলেন। তিনিই রাজা ব্রজেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী। রোহিনী প্রসাদ ভট্টাচার্য হলেন সদর নায়েব। এঁদের জনক পিতা হরি প্রসাদ ভট্টাচার্য বেনারসের গৌরীপুর হাউসে থাকতেন। পূর্ণেন্দু প্রসাদের পিতা – কবি যতীন্দ্র প্রসাদ পিতামহের কাছে বেনারসে থাকতেন এবং অ্যানি বেসান্ত স্কুলে পড়তেন। একবার গৌরীপুরের যোগেন চক্রবর্তী কাশিতে গিয়ে একরাত্রি বাস করে সিলেটে গিয়ে নিজের তৈরি বোমা ফেটে নিজেই মারা যান। সেই সুত্র ধরে কবি যতীন্দ্র প্রসাদকে পুলিশী জেরার মুখে পড়তে হয়েছিল। লেলিনের মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখেও একবার কবিকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছিল।
এদিকে ব্রজেন্দ্র কিশোরকে সায়েস্তা করার জন্য মুসলমান প্রজাদের দিয়ে তাঁর কাছারি লুট করিয়েছিল ইংরেজ প্রশাসক। সেই তথ্য প্রমাণ দিয়ে ক্রাউন ভার্সাস গৌরীপুর এস্টেট মামলা প্রিভিকাউন্সিল পর্যন্ত গড়ায়। শেষ পর্যন্ত গৌরীপুর জয়ী হয়।
শ্রী অরবিন্দ সহ ভারত মাতার শৃঙ্খল মোচনের সাধনায় যাঁরা নিজেকে সঁপেছিলেন তাঁরা ঠিক করলেন –ইংরেজ সরকারের গোলাম তৈরীর বিশ্ববিদ্যালয়ের পালটা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গড়বেন। শ্রী অরবিন্দ ব্রজেন্দ্র কিশোরের কাছ থেকে সেই সময়ে পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছিলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য।
পূর্ণেন্দু প্রসাদের মামার বাড়ি মালদহ কলিগ্রামে।তাঁরা ছিলেন অদ্বৈত প্রভুর বংশধর। গোস্বামী পরিবার। ১৯২৮ সাল। পূর্ণেন্দু প্রসাদের মাসির বিয়ে। কলকাতার পার্ক সার্কাসে তখন নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন। এদিকে পূর্ণেন্দুর মামারা মাসিকে কলকাতায় এনে বিয়ে দিচ্ছেন। মৈমনসিং গৌরীপুর থেকে পূর্ণেন্দুও এসেছে বাবা মা- র সাথে। সেই বিয়ে বাড়িতে ছোট্ট পূর্ণেন্দু মামাদের তর্ক বিতর্কে বুঝতে পারে– সুভাষবাবু সেই অধিবেশনে দাবী করেন ইংরেজ খপ্পর থেকে ভারতকে পুরোপুরি মুক্ত করার সংকল্প ঘোষণা করবেন। গান্ধীজি তা ঠেকিয়ে রেখেছেন। গান্ধীজি ইংরেজ কর্তাদের সঙ্গে একবার দরবার করার জন্য একবছর সময় চেয়েছেন। পূর্ণেন্দুর বড়মামা কৃষ্ণ সরোজ গোস্বামী গান্ধীর পক্ষে। মেজমামা কৃষ্ণ প্রবোধ ও সেজমামা কৃষ্ণ লাবণ্য সুভাষের পক্ষে। সেজমামা তো অস্ত্র আইনে বহরমপুর জেলেও ছিলেন। মামাদের তর্ক বিতর্কে ছোট্ট পূর্ণেন্দুর মনে হয় মেজমামা সেজমামাই ঠিক। এদিকে বড়মামার এককথা গান্ধীজি ভুল করেন নি। এখনো আমরা স্বাধীন হবার যোগ্য হই নি। তাইতো অরবিন্দ ঘোষ হাল ছেড়ে যোগী হয়ে পন্ডিচেরী চলে গেছেন।
বিয়ে মিটে যেতেই বাড়ি ফিরে স্কুল ছুটির পর কালিবাড়ির কাছে স্বাস্থ্যসংঘতে ভর্তি হয় বালক পূর্ণেন্দু প্রসাদ। ব্যায়াম লাঠিখেলা পাঠাগার সবই সেখানে আছে। ক্রমশ ও জানতে পারে ১৯২৮ সালে পার্কসার্কাসের কংগ্রেসের সম্মিলনে যাঁরা গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ক্ষুদিরাম পন্থীরা সম্মেলনের আড়ালে বাঙালি , পাঞ্জাবী, মারাঠি সবাই একজোট হয়ে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি গঠন করেছেন। ১৯২৯ সালের কংগ্রেসের অধিবেশনে পূর্ণ স্বাধীনতার সংকল্প নেওয়া হয়। তার পরের বছর ৩০ সালের এপ্রিলে গান্ধীজি ইংরেজের আইন ভেঙে লবন তৈরীর ডাক দিলেন। পাশাপাশি সেই সপ্তাহেই সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুট করে জালালাবাদ পাহাড় থেকে গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আগেই ভগ‍ৎ সিহের ফাঁসি হয়ে যাওয়ায় তাঁর অনুগামীরা পশ্চিম ভারতে এবং তিলকের অনুগামীরা মহারাষ্ট্রে গেরিলা হাঙ্গামা শুরু করে। তখন পূর্ণেন্দু দশ বছরের। বিপ্লবী দলে শপথ নিয়ে দলভুক্ত হওয়ার সুযোগ এলো। গোপন চিঠিপত্র ও যন্ত্রপাতি চালাচালি ছাড়া বড় কোন দায়িত্ব পেল না। স্বাস্থ্যসংঘতে তখন তিনটে দল মিলিত ছিল। যিনি কুচকাওয়াজ করাতেন তিনি যুগান্তর দলের। যিনি লাঠিখেলা শেখাতেন তিনি অনুশীলন দলের। যিনি পাঠচক্রে পৃথিবীর ইতিহাস শেখাতেন তিনি মুক্তিসংঘের।
এদিকে এগারোয় পা দিতেই পৈতে । পৈতের পর একাধারে চলতে থাকে স্কুলের পড়াশোনা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের পাঠ। সহপাঠীদের সাথে পরিকল্পনা করে বিভিন্ন জায়গায় গোপনে বিপ্লবী ঘাঁটি তৈরী করতে থাকে পূর্ণেন্দু।
১৯৩৬ সালে ম্যাট্রিক পাশ করে মৈমনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে ইন্টার মিডিয়েটে ভর্তি হলেন পূর্ণেন্দু। রাজনৈতিক আন্দোলনে দলের কাজের চাপ এবং ১৯৪১ – এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ওপর মৈমনসিং শহরের মধ্যে অন্তরীণ আদেশ জারি হয়। সেই কারণে দু বছর পড়াশোনা পন্ড হয়। বি -এ পরীক্ষার টেস্টের পর ই তিনি গ্রেপ্তার হলেন। জেলে থেকেই ১৯৪২ সালে বি-এ পাশ করেন। তার অনেক পরে ১৯৫৬- তে প্রাইভেটে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম-এ পাশ করেন।তখন তিনি স্ট্যাটিসটিক্যাল ইন্সট্রিটিউট-এ কর্মরত।
কলেজে পড়ার সময় থেকেই তিনি সাহিত্যচর্চাও করতেন। কলেজ ম্যাগাজিনের সম্পাদক তখন তিনি। তাঁর সহপাঠী ছিলেন নলিনী কান্ত গুপ্তের ছেলে সমীর কান্ত গুপ্ত। একবার সমীর কান্ত তার বাবার লেখা “চেতনার অবতরণ” বইটি পূর্ণেন্দু প্রসাদকে পড়তে দিয়েছিলেন। বই টি পড়ার পর তিনি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে নলিনী কান্ত গুপ্তের “মধুছন্দার মন্ত্রমালা” ভাষ্য গ্রন্থ সংগ্রহ করলেন। জানলেন যুগ্ম দেবতা মিত্রাবরুণকে। যিনি আমাদের সীমায় মিত্র এবং অসীমে বরুণ। তাঁর হৃদয় পদ্মের আর একটি পাঁপড়ি খুলে গেল। শুরু হল আধ্যাত্মিক চেতনা।
এরপর অনেক রাজনৈতিক সংকট এসেছে। পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে একখান থেকে আর একখানে। ১৯৪৫ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথাবার্তা শুরু হওয়ায় ধর পাকড় বন্ধ হয়। তখন তিনি মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। দেশভাগের পর কলকাতায় এসে ডঃ প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষের দৈনিক লোকসেবক পত্রিকায় সহ সম্পাদক পদে চাকরি করেন। পাশাপাশি বিভা সেনের ( দেশনেতা সতীন সেনের ভাইজী ) প্রকাশিত মাসিক সৃজনী পত্রিকার সম্পাদনাও করেন। অবশ্য এর জন্য কোন অর্থ পেতেন না।
এদিকে শ্রী অরবিন্দ ঘোষের ভাই বারিন্দ্র ঘোষ দৈনিক বসুমতীর সম্পাদক। কিছুদিন যাবৎ চোখে দেখছেন না। সুরেন্দ্র মোহন ঘোষ ( একদা অখণ্ড বঙ্গের কংগ্রেস সভাপতি তথা মৈমনসিংহ জেলার সভাপতিও ছিলেন ) ডেকে পাঠালেন। বারীন ঘোষের সচিব পদের জন্য প্রস্তাব দিলেন। সানন্দে রাজি হলেন পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য।
তারপর স্ট্যাটিসটিক্যাল ইন্সটিটিউটে চাকরি। প্রফেসর মহলানবীশের সান্নিধ্য। প্রফেসর নিজে রাশি বিজ্ঞান শিখিয়ে পূর্ণেন্দু প্রসাদকে ফিল্ড অফিসার পদে নিয়োগ করেন। ধীরে ধীরে চাকরির উন্নতি হতে থাকে। ভাষাতত্ত্বের প্রতি অগাধ দখল তখন তাঁর। প্রফসরের সেক্রেটারি পদ। পরে মিসেস মহলানবীশের সেক্রেটারি পদে চাকরি করেন। ১৯৫২ সালে চাকুরিরত অবস্থায় পন্ডিচেরীতে নলিনী কান্ত গুপ্তকে চিঠি লিখে মধুছন্দার মন্ত্রমালার বেদ মন্ত্রগুলির বাংলায় গদ্যানুবাদের অনুমতি চেয়েছিলেন। অনুমতি পেয়েছিলেন। প্রবর্তক পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে সেগুলি প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর নলিনী কান্ত গুপ্তের উপদেশ অনুসারে পাঠ মন্দিরে বসে কপালী শাস্ত্রীর বেদভাষ্য পাঠ করার সুযোগ হয়েছিল। তাঁরই উৎসাহে শ্রী অরবিন্দের সাবিত্রী অনুবাদ শুরু করেন পূর্ণেন্দু প্রসাদ। কলেজ জীবনে শ্রদ্ধেয় নলিনী কান্ত গুপ্তের যে গ্রন্থ পড়ে আধ্যাত্মিক বীজ বোনা হয়েছিল ধীরে ধীরে সেই ভক্তিলতা বৃদ্ধি পেতে থাকলো। পঙ্গু ভক্তি নয়, জ্ঞান মিশ্রিত ভক্তি। জীবনে অনেক দুঃসময় এসেছে কিন্তু তাঁর জীবন দেবতা তাঁকে বারবার ফুরায়ে ফেলে আবার ভরে দিয়েছেন কানায় কানায়। স্বাধীনতার আগেই প্রাণবসন্ত কাব্য গ্রন্থ বেরিয়েছিল। তখন ছিল ১৯৪৬ সাল। কলকাতার বৈঠকখানা মেসে থাকেন। হাতে টাকা পয়সা নেই। পুজোয় বাড়িতে যেতে হবে। মা ডেকেছেন। কি করবেন ভাবছেন। এমন সময় ঘরের এক কোণে সদ্য প্রকাশিত প্রাণবসন্ত কবিতার বইগুলোর দিকে চোখ পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু বই দুহাতে নিয়ে রাস্তায় চলে এলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই বই বিক্রি করে সেই টাকায় মায়ের শাড়ি, ভাইবোনদের জামা কাপড় কিনে মৈমনসিং চলে গেলেন। এমন করেই ভাগ্য দেবতা তাঁকে পরীক্ষা করেছেন বারবার।
মায়ের অভাব আজও তাঁকে কষ্ট দেয়। ১৯৬৭ সালে হঠাৎ করেই মাকে হারান তিনি। পরিবারে কোন কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হলে দেখতে যান। ভাবেন তাঁর মা হয়তো তাঁকে দেখতে আবার এসেছেন। কানে কানে বলেন – মাগো , তুমি কি এসেছ তোমার বাদলকে দেখতে ?
১৯৫৪ সালে বিয়ে করলেন। কৃষ্ণনগরের বিজয় প্রসাদ ভট্টাচার্যের মেয়ে কবিতা দেবীকে। তিনটি সন্তানের জনক হলেন। একটি কন্যা ও দুটি পুত্র সন্তান। একদিকে চাকরি অন্যদিকে লেখালেখি। তা সত্ত্বেও সংসারের প্রতি কখনও অবহেলা করেন নি। ভাইবোনদের লেখাপড়া গান শেখানো সবকিছু করেছেন আনন্দের সাথে।ছেলেমেয়েদেরও স্নান করানো, খাওয়ানো, লেখাপড়া শেখানো, গান শেখানো, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, ভাল সিনেমা এলে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া- খুব আনন্দের সাথে করতেন। নাতি নাতনিদের সাথে তাঁর সম্পর্ক একেবারে বন্ধুর মতো। দিনেরপর দিন তাঁর জ্ঞানের আলো ভরে দিয়েছেন ও দিচ্ছেন তাদের মধ্যে। এর জন্য কখনও ক্লান্ত বোধ করেন না। এরই মধ্যে একটার পর একটা বই বেরতে লাগল। তৃতীয় নয়ন ১৯৫৬। সয়ম্বর ১৯৬০। কাব্য নাটক মঞ্চের জন্য ১৯৬৫। পিতরিপ্রীতিমাপন্নে ১৯৬৭। বাছাই কবিতা ১৯৮৫। স্বর্গমর্ত্য পুরান ১৯৯৬। জয়দেবের ধারাপাত ১৯৯৭। শিবাজীর ধারাপাত ১৯৯৭।মহাভারতী ১৯৯৯। শ্রীঅরবিন্দের মহাকাব্য সাবিত্রী অনুসরণ ২০০৬। বেদচর্চা ২০০৭। দুর্গা সনাতনী দেবী ২০০৮। গীতিনাট্য-মহাভারতের কথা অমৃত সমান ২০০৯। গীতা মন্দিরের চাবি ২০১০। ইত্যাদি ১৮টি বই প্রকাশিত হল। পাশাপাশি “সাহিত্য মেলা”র সম্পাদনা। “ওয়ার্ল্ড ইউনিয়ন” এর সম্পাদনা। এছাড়া বিভিন্ন মিটিং সভা সমিতিতে ভাষণ দেওয়াও চলছে। কোন সভায় পাঁচজন বক্তা থাকলে শেষে তাঁর নাম থাকে। শ্রোতারা বসে থাকেন তাঁর মূল্যবান বক্তব্য শুনবেন বলে। তরুণ-তরুণী থেকে সববয়সের শ্রোতা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর ভাষণ শোনেন। ভাষণের শেষে সে আরেক দৃশ্য। সবাই তাঁকে ঘিরে ধরে প্রশ্ন করতে থাকে। ঠিকানা নিতে থাকে। তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ।বলিষ্ঠ বক্তব্য।জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শ্রোতাকে আকৃষ্ট করে। মুগ্ধ করে। সমৃদ্ধকরে আজও।
বোলপুর কেন্দুলিতে, জয়দেবের ভিটের কাছে , জয়দেবের টানে, অজয় নদীর পাশে ছ কাটা জমিতে বাড়ি করেছিলেন তিনি। ফুল ফলে ঘেরা সেই বাড়িতে কলকাতা থেকে মাঝেমাঝেই গিয়ে বাস করতেন। ডঃ অজিত কুমার দাসকে জয়দেবের জন্মস্থান যে কেন্দুলিতেই ছিল তার সমস্ত প্রমাণ দিয়ে সাহায্য করেন । অজিতবাবু পূর্ণেন্দুবাবুর তত্ত্বাবধানেই ডক্টরেট পান। বয়সের কারণে যাতায়াত করতে কষ্ট হওয়ায় ২০০৯ সালে কেন্দুলির বাড়ি বিক্রি করে দেন পূর্ণেন্দু প্রসাদ।

বোলপুরের তিলুটিয়া গ্রামের কথা না বললেই নয়। তিলুটিয়া গ্রামে একবার হিন্দু মুশলমানের দাঙ্গা হয়েছিল। হিন্দুরা ছিল সেখানে অত্যাচারিত। মুশলমানদের একাংশ হিন্দুদের পাশে এসে দাঁড়ায়।দু পক্ষেরই হতাহত হয়। পুলিশ সকলকেই গ্রেফতার করে।বিচারে অনেকে ছাড়া পেলেও দলপতি এনামুল হক সহ কয়েকজনের জেল হয়। যেদিন তাঁরা জেল থেকে মুক্ত হলেন সেদিন বিকেলে শ্রী পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্যের বরানগরে ১০/১ ঘোষ পাড়া লেনের বাসা বাড়ীতে ওরা আসে। প্রায় ৪০ কি ৪২ জন। চার তলায় ছাদের পাশে দু কামরার ফ্ল্যাট ছিল।ওঁরা স্নান খাওয়া করে সেই ছাদেই রাতে ঘুমিয়ে পরের দিন সকালে তিলুটিয়া ফিরে গিয়েছিল।ওঁরা একটা সম্প্রদায় গড়ে আশ্রম করেছিল।এখনও আছে।ওদের কারো নামের উপাধি নেই। প্রত্যেকের বাংলা নাম করণ হয়েছিল। দলপতি এনামুল হকের নাম শুদ্রোত্তম।হিন্দু মুশলমানের সম্প্রীতির এমন মধুর মিলনে পূর্ণেন্দু প্রসাদ তাদের সাথে সবসময় ছিলেন এবং আছেন।


শ্রী পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য বহু সংগঠন করেছেন। তার যথাযথ কল্যাণ করে, উন্নতি করে যখন তারা নিজেরাই চলতে পারছে তখন তার থেকে বেরিয়েও এসেছেন। এই অনাশক্তি, ত্যাগ সাধারণ মানুষ ভাবতেও পারবে না। তিনি এমন বারবার করেছেন।
তাঁর মেধার অসাধারণ তিক্ষ্ণতা, চিন্তা চেতনার তারুণ্য, খাওয়া পরায় বাহুল্য বর্জিত, সব থেকে বড় তাঁর শিশুর মতো সরল মন-তাঁকে একাধারে অতুল ঐশ্বর্য মন্ডিত ও মাধুর্য মন্ডিত করেছে। তাই তিনি বিশিষ্ঠ।
জীবনে অনেক সংবর্ধনা , অনেক পুরস্কার তিনি পেয়েছেন ও পাচ্ছেন। “অখিল ভারতীয় ভাষা সাহিত্য সম্মেলন” থেকে “ভারত ভাষা ভূষণ” উপাধি। শ্রী অরবিন্দ ভবন থেকে “শ্রীঅরবিন্দ পুরস্কার”(২০১৯)। স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে তাম্রপত্র পেয়েছেন। ২০১৯ এ বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলন থেকে বাংলাদেশে তাঁর শততম জন্মদিন পালিত হয় অত্যন্ত সমারোহে। এমন ব্যক্তিত্বকে বাবা হিসেবে, গুরু হিসেবে পেয়ে আমি ধন্য।

15 thoughts on “জীবন কথাঃ শ্রী পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য সম্বন্ধে – ভূমিকা গোস্বামী

    1. ভীষণ তথ্য সমৃদ্ধ লেখা। খুব ভালো লাগলো। এমন মানুষের সান্নিধ্য পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপা।

    1. অসাধারণ জীবন কাহিনী । মুগ্ধ হয়ে পড়লাম ।

    2. আমার ক’দিন আগেই ওনার কথা মনে হচ্ছিল।
      ভালো আছেন তো।
      জেনে আনন্দ হলো উনি শত বর্ষেও সজীব।এবং সৃজনশীল।
      ওনার দীর্ঘায়ু কামনা করি নিজের স্বার্থে,জাতির স্বার্থে,বাঙালির স্বার্থে।

      বাংলা লিপির পরিবর্তে নাগরী লিপি চেয়েছিলেন এমন একটি প্রচার ছিল একসময়।এখন তা নেই বিশ্বাস করি।ওনার অবদান নিয়ে আমার সীমাহীন অজ্ঞতা এই প্রতিবেদন পড়ে কিছুটা হলেও দূর হলো।
      ওনার সম্পর্কে আমি আননকাননে
      একটি বিরূপ মন্তব্যও করে বসেছিলাম।মন্দিরা ভুলটি ধরিয়ে দেন।আমি অকপটে আমার ভ্রান্তি সলজ্জে কবুল করি।
      মানুষটি অভিভাবকের মতো মাথার উপর থাকুন আরও বহুদিন।
      করোনা কাটলে যদি দেখা পাই পা ছুঁয়ে প্রণাম জানাবো।

  1. বাবার মুখে শোনা কথা এবং আমার অভিজ্ঞতা এই লেখার উপকরণ। আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।

  2. যোগেন চক্রবর্তীকে নিয়ে লেখা আগে একটা পড়েছি, স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। এটাও খুব সুন্দর তথ্যসমৃদ্ধ লেখা।

  3. অসম্ভব তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। খুব ভালো লাগলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *