মুক্তগদ্যঃ পা জামা – আ লো ক ম ণ্ড ল

পা-জামাটা ছিঁড়েছে। ইঁদুরে কেটেছে কিংবা আরশোলাতে অথবা কোথাও খোঁচা লেগে ছিঁড়েছে দেখতে পাচ্ছি। তবে এটা নিশ্চিত ইচ্ছে করে ছিঁড়িনি। ছিঁড়েছে কিন্তু এটা সত্য নয়, এটা বাস্তব। আসল সত্য হোল পা-জামা ছেঁড়ে।
যা কিছু তৈরি বা সৃষ্টি সবই নষ্ট হয় বা ধ্বংস হয়। তবে পা-জামার স্মৃতি থেকে যায়।লাল রঙের হলে বেশি দিন থাকে, নীল হলে ঝাপসা, সাদা হলে কম দিন থাকে । সাধারণত পা-জামা সাদা রঙেরই হয়।এটা মিথ।
কে পরেছিল, কতদিন পরেছিল, প’রে কোথায় কোথায় গিয়েছিল সে সব কথা কিছুদিন মনে থাকলেও কার দোকান থেকে কেনা হয়েছিল একদমই মনে থাকে না।কারণ সেখানে বিনিময়ে থাকে অর্থ।অর্থই বিস্মৃতির মূল। তথ্যটি সর্বজন ও সর্বকালের জন্য সত্য তা বলা যায় না।গায়ে গতরে খেটে যে অর্থ উপার্জন তা যদি কেউ কেড়ে নেয় বা চুরি করে তা কিন্তু বহুদিন থেকে যায় মনে। আসলে মন প্রাণ দিয়ে সেটা সঞ্চয় হয়। তাই হৃদয় দিয়ে যা দেখা হয়,মনে হয় তা বহুদিনই থেকে যায়, মনে।
মন এমন এক বিষয়, যা দেখা যায় না,অনুভব করা যায়।মন কতদিন কাকে ধরে রাখবে সেটা মনের উপরই নির্ভর করে এবং তা ম্যান-টু-ম্যান ভ্যারি করে।এই ধরুন, আমি এখনও মনে মনে ভেসে যাই সেই বাস্তবে- ৪২ জন সহপাঠী সহপাঠিনীর মাঝে বসে আছি, স্যার ক্লাস নিচ্ছেন সামনের বেঞ্চিতে, আমার চোখ কিন্তু পড়ে আছে সেই শ্যমলাবরণা ডাগর চোখের দিকে।তার সেই টোল-পড়া গালে চিবুকে ছোট্ট তিল আমাকে এক অপার্থিব জগতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমার কলম থেমে গেছে,আমি ভেসে চলেছি সেই সবুজ ঘাসে ঢাকা ক্যানালের পাড়ে।ছুটে যাচ্ছি পানের বুরুজ ছাড়িয়ে স্কুলের ফুটবল মাঠের একাকী লম্বা বেল গাছটার তলায়।লাজুক চোখে তাকিয়ে আছে শ্যামল বরণা আমি চোখ নিচু করে হাত বাড়িয়ে দিলাম, ‘ও একটি খামে মোড়া চিঠি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েই দে দৌড়..। বুক কেঁপে উঠল,পা টলমল করছে,কী করব, কী বলব ভেবে না পেয়ে চিঠিটি পা-জামার পকেটে নিয়ে সে কি দৌড়! ঘরে গিয়ে একেবারে পড়ার টেবিলে বসে লোকেশ চক্রবর্তীর মোটা ভূগোল বইয়ের ভেতরে রেখে আরও কিছু বই চাপা দিয়ে তবেই নিস্তার,একটা স্বস্তি! তবু মন আনচান করছে কখন সন্ধে হবে, কখন হ্যারিকেন জ্বলে উঠবে! রাত ঠিক ন’টা খাওয়া দাওয়ার পর সবাই যখন বিছানায় আমি আমার পড়ার টেবিলে বসে একটি একটি অন্য বই গুলি সন্তর্পণে নামিয়ে,হ্যারিকেনের আলো কিছুটা কমিয়ে সেই মোটা ঢাউস ভূগোল বইটি খুলে বের করলাম, সেই অমূল্য সম্পদ! আহা,কী সুগন্ধ খামটির গায়ে,কী অপার রহস্য খামবন্দি! সারা শরীরে গান বেজে উঠল।ঝমঝম বৃষ্টি। হাত কাঁপছে, একবার এদিক-ওদিক দেখে নিচ্ছি ভয়ে ভয়ে, পাছে কেউ জানতে পারে! না,না,অলি অমন করে নয়, আরও ধীরে ধীরে খোল! খুলেছি হাত কাঁপছ, পালস রেট বেড়ে যাচ্ছে। বুকের ধড়ফড়ানি চেপে, ‘জয় মা দুগ্গা’- বলে ফোল্ড খুলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল সবুজ কালিতে লেখা… আহা! আমি যেন সেই ১৭ বয়সী কিশোর এই ৬৮ তে সেই একই অনুভব, বুক কাঁপছে, অদ্ভুত এক আনন্দের তাল বেজে উঠল সারা মনে।
এটাই সত্যি। বাকি সব অতীত ঘটনা।অতীত বাস্তব।
পা-জামা ছিঁড়ুক তবু সেই পা-জামা-পাঞ্জাবি পরা দিনগুলি।খাদির তৈরি।দুরন্ত তরুণ। ইনকিলাবি সাহসে ভর করে আমরা করব জয় নিশ্চয়ই একদিন ‘ ওহ , ডিপ ইন মাই হার্ট উই ডু বিলিভ উই স্যাল ওভারকাম সাম ডেয়জ..। কারণ সত্য আমাদের সাথী, সত্যি সত্যিই সাহসী করে তুলেছিল।তিনটি তরুণ এক সিগারেটে টান দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছি দাঙ্গা বিধ্বস্ত ইদগামহল্লায় পুণর্বাসনে। পিছু টান নেই,অকুতোভয়। গলার শিরা ফুলিয়ে বলেছি,ধর্ম কখনও উন্নতির পথ তৈরি করে না,মানুষের মেহনত তৈরি করে পথ – বেঁচে থাকার, ভালোবাসার। দাঙ্গা হিংসা আগুনকে আরও উজ্জীবিত করে আরও অমানবিক করে তোলে। তার বিরুদ্ধে বুকচিতেয়ে দাঁড়িয়ে আমরা ক’জন নতুন মানুষ।সেই সাহসী প্রাণবন্ত সময় গুলি এখনও জলপূর্ণ পুকুরে পাকুড় ছায়ার মতো শৈত্য অনুভবে মনকে স্নিগ্ধ করে।
জামা শব্দটি বাংলার শব্দ ভান্ডারে ছিল না,এটি ফারসী ভাষা থেকে এসেছে। মেঘল আমলে দক্ষিণ এশিয়ায় এক ধরনের লম্বা কোট কে জামা বলত,তা ছিল কোমরের কাছে কিছটা চাপা, অনেকটা ফ্রকের মতো।বাঙালীরা জামা সাধারণত পরত না,ইংরেজ আমলে বাবু সম্প্রদায় প্রথম আমদানি করল। কিন্ত পা-জামা মানে, পায়ের জামা পুরোপুরি ফারসী পোশাক তবে কালেকালে বিবর্তিত হয়েছে তার চেহারা। বর্তমান প্রজন্মতে পাজামাও ছোট হয়ে বারমুডাতে আটকে গেছে।একটু বৃদ্ধ বয়সীরা এখনও পা-জামা পরে।নেতা মন্ত্রীরা জনসভায়, ভোটের সময় এমনকি নাটক থেটারে পাজামা পরে কিছু চরিত্র।সেই পা-জামা যখন ছিঁড়ে যায় তখন তাকে অন্য নানা কাজে ব্যবহার করা হয়। হোক, তবু পা-জামা পাঞ্জাবিতে সেই তরুণ তুর্কী বিকেলের পড়ন্ত রোদে অশোক গাছের তলায় সাইকেলে স্ট্যান্ড দিয়ে যখন সেই মানুষীর কাছে গিয়ে দাঁড়াত আর তাঁতের শাড়ি সারা গায়ে জড়িয়ে চুল এলোমেলো করে দরজার সামনে এসে হাসিমুখে যখন বলত, ‘আসুন!’ ঠিক সেই মুহূর্তে সে যে কী রোমান্টিক সিন তৈরি হোত তা কেবল পাশাপাশি প্রতিবেশীরাই দেখত আর হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরত সমবয়সী প্রতিবেশিনীর দল। মানুষী ভাবত, আহা, কত্ত বড় কবি কিংবা কত্ত বড় আদর্শবাদী নেতা! যখন ঘনিষ্ঠতা বাড়ল, যখন ঘরের ভেতরে প্রবেশ হোল অবাধ,যখন বিকেলে চায়ের আগে পুকুর থেকে ধরে আনা টাটকা মাছ ভাজা এল আলাদা প্লেটে ঠিক তখনই এরকম একদিন সমুদ্র সৈকতে পা-জামা পরে জলে নেমে পড়ার সে যে কী বিপর্যস্ত অবস্থা হয়েছিল! লজ্জা! লজ্জা! লজ্জা! সেদিনের সেই তরুণ তুর্কীর অসহায় লাজুক চেহারা দেখে মানুষীটি মুচকি হেসে হঠাৎ বলেছিল,” ঐ দেখুন ঢেউ আসছে..” আর আরও তাড়াতাড়ি করে সৈকতে ছুটে আসতে গিয়ে ভেজা পা-জামাতে আটকে একেবার চিৎপটাং! সেদিনের তরুন তুর্কীর,লজ্জা ধরে রাখা দায় হয়ে পড়েছিল।

2 thoughts on “মুক্তগদ্যঃ পা জামা – আ লো ক ম ণ্ড ল

  1. খুব ভাল লাগল।দারুণ লেখা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *