নীরা আর্য, অগোচরে থেকে যাওয়া এক বীরাঙ্গনা
পার্থ রায়
আমরা জানি, আমাদের দেশের স্বাধীনতার জন্য সুদীর্ঘ কাল ধরে চলা বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে হাজার হাজার মানুষ শহীদ হয়েছেন অথবা বৃটিশ শাসকদের অবর্ণনীয় অত্যাচার সহ্য করেছেন। দেশপ্রেমিক, নেতা এবং শহীদদের মধ্যে কেউ কেউ কিংবদন্তী হয়ে আছেন। আমরা নানা ভাবে তাঁদের স্মরণ করি। আবার অনেকে আছেন যাঁদের বীরত্ব এবং আত্মত্যাগের কথা দেশবাসীর অগোচরে থেকে গেছে।
এরকমই এক বীরাঙ্গনা নারী হলেন নীরা আর্য, পরবর্তীকালে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু তাঁকে আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম মহিলা গুপ্তচর হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। উত্তরপ্রদেশের এক ধনী ব্যবসায়ী শেঠ চজুমলের মেয়ে নীরা জন্মেছিলেন ১৯০২ সালের ৫ই মার্চ। পিতার ইচ্ছায় শিক্ষালাভের জন্য নীরা ও তাঁর ভাই বসন্ত কলকাতায় আসেন। সেখানে স্কুলে পড়ার সময় নীরা স্বাধীনতা আন্দোলন বিশেষ করে সর্বজন শ্রদ্ধেয় এবং প্রিয় নেতা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বের প্রতি আকৃষ্ট হন। স্কুল শিক্ষা অন্তে নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজের ঝাঁসি বাহিনীর একজন সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন। নীরা এবং বার্মার মেয়ে সরস্বতীর ওপর দায়িত্ব ছিল ইংরেজ অফিসারদের এবং ইংরেজ মিলিটারি ক্যাম্পের ওপর নজর রাখার। এই দুজন পুরুষের ছদ্মবেশে খবর সংগ্রহ করে নেতাজীকে দিতেন।
নীরার ব্যবসায়ী পিতা প্রমাদ গুনলেন। তিনি ইংরেজদের সাথে সংঘাতে যেতে চান না। ফলে এক সিআইডি ইনস্পেক্টর শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাসের সাথে নীরার বিয়ে দিলেন। বিয়ের অনতিবিলম্ব পরে ওঁর স্বামী যখন স্ত্রীর কর্মকান্ডের কথা জানতে পারেন, দাম্পত্য জীবনে চরম সংঘাত শুরু হল। নীরার মধ্যে ছিল এক অদম্য জেদ। দেশের হিতের জন্য নিবেদিত প্রাণ এক নারী। স্বামী এবং ইংরেজ পুলিশের বারংবার হুঁশিয়ারি স্বত্বেও তিনি পিছু হটেননি।
ইতিমধ্যে নীরার স্বামীর ওপর দায়িত্ব পড়ল সুভাষচন্দ্রকে হত্যা করার। স্ত্রীকে অনুসরণ করে শ্রীকান্ত যখন সুভাষচন্দ্রকে গুলি করতে যাবেন, নীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে পরপর ছুরিকাঘাতে স্বামীকে হত্যা করেন। নীরার সাহসিকতার জন্য সুভাষচন্দ্রর প্রাণ রক্ষা পেল। ইংরেজ পুলিশ নীরাকে বন্দী করে আন্দামান নিকোবর জেলে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে ওঁর ওপর অকথ্য, অবর্ণনীয় অত্যাচার চলত। কিন্তু নীরার মুখ থেকে সুভাষচন্দ্র সম্মন্ধে একটি কথাও বের করতে পারেনি অত্যাচারী ইংরেজরা। এমনই এক অত্যাচার চলাকালীন নীরা বলেন, “জানতে চাও নেতাজী কোথায় আছেন?”
ইংরেজ অফিসার ভাবেন নীরা অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে এবার সব উগড়ে দেবেন। আশান্বিত হয়ে বলেন, “বলো, বলো, উনি কোথায় আছেন। যদি বলো তোমাকে ছেড়ে দেব”
ধীর, শান্ত কণ্ঠে নীরা নিজের বুকের দিকে দেখিয়ে বলেন, “নেতাজী এখানে আমার হৃদয়ে আছেন”।
ক্রোধে অগ্নিশর্মা ইংরেজ অফিসারের হুকুমে কামার ডেকে আনা হল। কয়েকজন পুলিশ নীরাকে চেপে ধরলে কামারের অগ্নি শলাকা দিয়ে নীরার বাম স্তন কেটে ফেলা হল। তাও একটা কথাও বের করতে পারেনি।
তারপর একদিন দেশ স্বাধীন হল। নীরা আর্য মুক্তি পেলেন। কথিত আছে শেষ জীবনে এই মহীয়সী বীর নারী ফুল বিক্রি করে হায়দেরাবাদের ফলকনামা এলাকায় এক কুঁড়েঘরে জীবন অতিবাহিত করতেন। ১৯৯৮ সালের ২৬শে জুলাই চারমিনারের কাছে ওসমানিয়া হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বীরাঙ্গনা নীরা আর্য।
দুর্ভাগ্য আমাদের স্কুল, কলেজের ইতিহাস বইতে এমন বীরাঙ্গনা নারীদের বীরত্ব গাঁথা স্থান পায় না। এটুকুই সান্ত্বনার যে সুপরিচিতা কনড় চিত্র পরিচালিকা রূপা আয়ার এই বীরাঙ্গনা নারীকে নিয়ে বায়োপিক তৈরি করতে চলেছেন।
(গুগল থেকে তথ্য সূত্র নিয়ে নিজস্ব ভাষায় লেখা)