মুক্তগদ্যঃ পয়লা বৈশাখ হাল হকিকত – মধুপর্ণা বসু

বাংলার নববর্ষ ছিল বাঙালি সব পরিবারে একটা আশা আনন্দের দিন। আমাদের দাদুর ছিল চালের ব্যবসা,কলকাতার খিদিরপুর অঞ্চলে। তাই হালখাতা করার চল ছিল তখন।তখন আমার দশ পার হয়ে গেছে। রেজ্জাক মিঞার কাছে তৈরী হত পয়লা বৈশাখের নতুন ফ্রক, হালকা ফুলেল ছাপায় বুকে ফ্রিল। শুধু তাই নয় দিদি আর আমার নতুন জামাই সাথে টেপ ফ্রক ইজের অবধি একেবারে আনকোরা নতুনের উচ্ছাস মাখা। সে ছিল আমাদের বিংশ শতকের নববর্ষ। আমাদের দু মহলা বাড়ির তিন দালানে নববর্ষের আগে চুনের পোঁচ পড়ত একবার। মা, ছোটমা, মেজমার জন্যেও আসতো তাঁতের শাড়ি। বাবু, কাকাদের জন্যে ফতুয়া পাজামা। ঠাকুরদার চালের ব্যবসা থাকলেও তার তিন ছেলে কেউই সে ব্যবসা রাখেনি, সবাই সওদাগরি অফিসে ঢুকে পড়ে এবং বিয়ে’থা করে সংসারী হয়। আমাদের ছিল একান্নবর্তী পরিবার, সতেরো জনের পাত পড়তো দুবেলা। বাড়ির উঠোনের মাঝে সিমেন্টের ওপর ছিল একটা লাল পদ্মফুল আঁকা, আর মা পয়লা বৈশাখের দিন বঁটি নিয়ে বসতো চার কেজির কাতলার মুড়ো ধর আলাদা করতে। খিদিরপুরের দোকান থেকে আসতো বেহারি গোমস্তা ভুকোলের ভেট, দাদুর জন্যে। বস্তা চাল, কাঁদি কাঁদি কলা, গ্রীষ্মের প্রথম আম, আর ইয়া পেল্লাই এঁচোড়। চিঙড়ি মাছ দিয়ে জম্পেশ করে রান্না, মাছের মাথা দিয়ে মুগডাল, লম্বা ডাঁটি অলা বেগুন ভাজা, কাতলার কালিয়া, সাথে দাদুর প্রিয় ক্ষীর আর আমের অম্বল। নববর্ষের দ্বিপ্রাহরিক ভোজন এমনই ছিল ছোট বেলায়, তারপর এই নাতনীদের সুবাদে মাছের সাথে শুরু হল খাসির মাংস। বিকেলে বাবু কাকাদের বন্ধুরা ভিড় জমালে ছাদে একপ্রস্ত ঘুড়ির প্যাঁচ ছিল অব্যর্থ, আর মা কাকিরা জোগান দিত চা, আলুর চপ, বেগুনি। আবার কোন বছর স্পেশাল মাংসের ঘুগনি।
আমাদের জন্য নতুন জামা পড়ে হুটোপুটিই ছিল এক অনাবিল আনন্দের। স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরোনো নববর্ষ ছিল পাটভাঙা হলুদ তাঁতের শাড়িতে নিজেকে বেশ নায়িকা স্বপ্নে খেয়ালী করে সান্ধ্য জলসায় বাংলা গানে বিভোর, দূরদর্শনের পর্দায় পুরাতনী আড্ডায় বাঙালি নস্টালজিক স্মৃতিতে গর্বিত হয়ে ওঠার একটা ক্ল্যাসিক্যাল যুগ। রামকুমার চাটুয্যের পুরাতনী টপ্পা গান, পঙ্কজ সাহার অতুলনীয় সঞ্চালনায় বাঙালির বর্ষবরণ। ক্রমশ চলে এলো কালীঘাট মন্দিরের আশেপাশে হালখাতা পুজো, রসধারার মিষ্টি দই, পাঁঠার মাংসের নাক-ভোজন। যুগের রকেট গতিতে তারপরেই এসেছে ৬, বালিগঞ্জ প্লেস, আহেলি, ভজহরি মান্না, তেরো পার্বনের আদবকেতা, বাঙালী হয়েছে রেস্তোরাঁ মুখী। বাংলাদেশী ঢাকাই জামদানী, গিলে করা পাঞ্জাবী পরিহিত ধোপদুরস্ত বাবু বিবিরা হলেন আধা সাহেবিয়ানায় মুহ্যমান। নববর্ষের সেকাল তার আভিজাত্য নিয়ে যতই সঙ্কটে থাকুক না কেন, ধনী বাঙালীরা বাড়ির হেঁসেলের পাট চুকিয়ে হয়ে পরেছেন রেডিমেড রসনা তৃপ্তির পক্ষপাতি। সেই সাথে দোকান দপ্তরের সাবেকিচলনও এখন আধুনিকতার পোশাকে প্রসাধন বদলে ভীষণ রকম ছাঁটকাট সংক্ষিপ্ত। এখন মা ঠাকুমার হাতের বোঁদে, নিমকি, গজা, বাদ দিয়ে ঢুকে পড়েছে দোকানের সরভাজা, গুঁজিয়া, জলভরা, উজ্জলার চানাচুর। বিকেলে দোকানে দোকানে হালখাতায় কোকাকোলা খেয়ে মিষ্টির বাক্স কদাচিৎ আসে। তবুও গ্রীষ্ম বরণের সাজসজ্জায় নববর্ষের দিনটা যতটা অনাবিল আনন্দ আর গৌরবের ছিল, হাল ফ্যাশানের পয়লা বৈশাখ তার কৌলিন্য খুইয়ে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ হয়ে ওঠার পথে বেশ কিছুটা এগিয়েছে বলতেই পারি। সেকালের বাংলা বর্ষবরণ ছিল এক উৎসব, আনন্দের, কোলাকুলির জিহ্বা তৃপ্তির, একালের নববর্ষ ভারি পকেটে রেস্তোরাঁ মুখী হয়ে উঠলেও মিলনের আশ্বাস আর কুশল বিনিময়ে থাকুক চিরকাল মনের এমনই কাছাকাছি থাকুক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *