বাংলা সাহিত্যের উত্তমকুমার:সমরেশ বসু
রবীন বসু
তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের উত্তমকুমার। জনপ্রিয়তা ও স্টারডমে উত্তমকুমার যেমন বাঙালির ম্যাটিনি আইডল ছিলেন, ছিলেন লক্ষ বাঙালি ললনার হৃদয়হরণকারী স্বপ্নের রাজপুত্র, তেমনই সাহিত্যিক সমরেশ বসু ছিলেন বাংলা কথাসাহিত্যের উত্তুঙ্গ জনপ্রিয় এক লেখক। বাঙালি পাঠক-ললনাদের প্রিয় অচিনবাবু। অমৃত-বিষে এই দুই জীবনশিল্পীর জীবন যেন অনেকটা মিলেমিশে যায়। প্রথম দিকে সাফল্য না এলেও পরবর্তীতে দু’জনেই সাফল্যের চূড়া স্পর্শ করেছিলেন। কিন্তু এই সাফল্য নিরঙ্কুশ অনায়াসসাধ্য ছিল না। ছিল আয়াসসাধ্য এক কঠিন লড়াই, অধ্যবসায় আর অসম্ভব মানসিক জোরের ফল। দু’ জনেই জানতেন নিজের সাফল্যের ভিত নিজেকেই বানাতে হবে। তার জন্য যেমন একদিকে নিজের পরিবার-পরিজনের কাছে দায়িত্বশীল ও বিশ্বস্ত থাকতে হবে, তেমনই নিজের শিল্পীসত্তার সঙ্গে কোনো কম্প্রমাইজ করা চলবে না। ব্যক্তিগত জীবনে নানান ঘটনা -দুর্ঘটনা, আনন্দ-শোক, আস্থা-অনস্থা পেরিয়ে অম্লমধুর এক বিরল জীবনসত্যের সন্ধান পেয়েছিলেন। সেই সত্য তাঁদের শিল্পীসত্তাতে আগুন ধরিয়েছিল। ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তা, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ আর প্রতিভার জোরে একজন অভিনয় শিল্পে মহানায়ক হলেন, অন্যজন বাংলা সাহিত্য তথা ভারতীয় সাহিত্যের চির- স্মরণীয় কালের রাখাল। তাঁর বাঁশির সুরে আমরা যে শুধু মোহিত হয়েছি তাই নয়, অমৃত -বিষে মানবজীবনকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করেছি। তাঁর সাহিত্যের কুশিলব— দীনদরিদ্র শ্রমজীবী জনমজুর মৎস্যজীবী তাঁতশিল্পী— সর্বোপরি সংগ্রামী মানুষ। বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাঁর জীবন কেটেছে। চল্লিশের দশকের শেষ দিকে ‘আদাব’ (পরিচয়: ১৯৪৬) গল্প দিয়ে তাঁর সাহিত্যে প্রবেশ। তবে তাঁর প্রথম লেখা উপন্যাস ‘নয়নপুরের মাটি’ (১৯৪৬), জেলে বসে লিখেছেন ‘উত্তরঙ্গ’ তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস (১৯৫১)। সমরেশ বসুর আগে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে তিন বন্দ্যোপাধ্যায় ততদিনে বাংলা উপন্যাসে নিজেদের আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। তারাশঙ্কর দেখিয়েছেন সমাজে শ্রেণীর সঙ্কট, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়েছেন ব্যক্তির সঙ্কট আর বিভূতিভূষণ বলেছেন বিশ্ব প্রকৃতি ও মানুষের অনুভূতির কথা। কিন্তু সমরেশ বসুর উপন্যাসে আমরা পেলাম সময়ের সঙ্কট। চল্লিশের দশকে বাঙালি জীবনে এসেছিল ভয়াবহ সঙ্কট। আর্থিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সেই সঙ্কট খুব কাছ থেকে লেখক সমরেশ উপলব্ধি করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ১৯৩৯, শেষ হয় ১৯৪৫। ৪২-এর আগস্ট আন্দোলন, ৪৩-এর মন্বন্তর ও ৪৬-এর দাঙ্গা এর পর ৪৭-এর দ্বিখণ্ডিত স্বাধীনতা। বিপুল উদ্বাস্তু স্রোত, তাদের পুনর্বাসন ও বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী মূল্যবৃদ্ধি, কালোবাজারি, মালিকের অধিক মুনাফার লোভ, শ্রমিক ছাঁটাই, বেকারত্ব— বাঙালির অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনকে চুর চুর করে ভেঙে দিল। ৪৩-এর দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে গ্রাম বাংলা উজাড় হয়ে গেল। তার উপর জমিদার ও মধ্যস্বত্ব ভোগীদের আগ্রাসনে নিরন্ন কৃষকেরা বাস্তুহারা হয়ে শহরের ফুটপাতে আশ্রয় নিল। এই পরিস্থিতি এব়ং পটভূমিতে লিখতে এসে সমরেশ বসু দুঃসহ এই সময়কে অগ্রাহ্য করতে পারলেন না। কাপড়ের কল, চটকল, লোহা-ইস্পাত কারখানা, কয়লাখনি, ডক শ্রমিকদের মধ্যে ছাঁটাইকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল, তা তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। তিনি আস্তে আস্তে কমিউনিস্ট ভাবধারায় প্রভাবিত হন।
ছোটবেলা থেকেই সমরেশের মধ্যে ছিল বহু প্রতিভা। তিনি ভাল গান গাইতেন, অভিনয় করতে পারতেন, ছবি আঁকতেন, সুন্দর বাঁশি বাজাতেন। ঘুরে বেড়াতে ভালবাসতেন আর প্রচুর বই পড়তেন। প্রথাগত পড়াশোনায় তেমন মন ছিল না। স্কুলের ক্লাসে প্রায়ই ফেল করতেন। ক্লাস না করে পথের পাশে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিতেন ও সিগারেট খেতেন। সেই সময় তাঁর সঙ্গী ছিল জেলে মেথরদের ছেলেরা। তরুণ ও বখাটে রিকশাওয়ালা থেকে বয়সে বড় নানান পেশার মানুষজনের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। ঢাকা থেকে এসে নৈহাটিতে তাঁর বড়দাদা মন্মথনাথ বসুর বাড়িতে থাকতেন। কিন্তু পরীক্ষায় অকৃতকার্য ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্য দাদা বিরক্ত হয়ে তাঁকে আবার ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। সেখানে কাপড়ের কলে ট্রেনি হিসেবে কাজে যোগ দেন। কিন্তু বোহেমিয়ান সমরেশ প্রায়ই কারখানা থেকে বেরিয়ে যেতেন। নদীর পাড়, পুরনো ঘিঞ্জি গলিতে ঘুরে বেড়াতেন। কখনো আবার চলে যেতেন কুষ্ঠরোগীদের ক্যাম্পে। আসলে তখন থেকেই সমরেশের মধ্যে জীবনকে দেখার এক অদ্ভুত কৌতূহল ও আগ্রহ জন্মে ছিল । যা পরবর্তী কালে তাঁর লেখক সত্তাকে পরিপুষ্ট করেছে।
এরপর স্বাধীনতা পূর্ববতী গুজব রাজনৈতিক অস্থিরতা আর দেশভাগের আবহে সমরেশ আবার নৈহাটি ফিরে এসে স্কুলে ভর্তি হলেন। যখন দশম শ্রেণীতে পড়েন, তখন একবার ম্যালেরিয়া ও জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। দুস্থ দাদা মন্মথনাথ ভায়ের এই বোহেমিয়ান স্বভাবে বিরক্ত হতাশ হয়ে এই সময় কিছুটা উদাসীন হয়ে পড়েন। সমরেশ বিনা চিকিৎসায় ক্রমশ মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ছিলেন। খবর পেয়ে স্কুল বন্ধু দেবশঙ্কর মুখার্জি এসে বন্ধুকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যায়। বাড়িতে ছিল তার বিবাহ বিচ্ছিন্না বড়দিদি গৌরী। তিনি সমরেশের থেকে বয়সে তিন-চার বছরের বড় ছিলেন। সেই দিদির সেবাযত্নে অসুস্থ সমরেশ আস্তে আস্তে কিছুটা সুস্থ হলেন। তবে সম্পূর্ণ না। ডাক্তারের পরামর্শে এই গৌরী নিজের সোনার গয়না বিক্রি করে ভাইয়ের বন্ধু সমরেশকে উত্তর প্রদেশের গাজিপুরে নিয়ে গেলেন ভাল চিকিৎসার জন্য। সমরেশ সুস্থ হয়ে ফিরে এল নৈহাটিতে। ইতিমধ্যে দুই অসম বয়সী তরুণ -তরুণী পরস্পরকে মন দিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু গৌরী ছিল রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারের আইনত বিচ্ছেদ না-হওয়া একটি তরুণী মেয়ে। তাদের এই প্রেমের কোনো সামাজিক পরিণতি নেই জেনে তারা নৈহাটি থেকে পালিয়ে জগদ্দল ও শ্যামনগরের মাঝে আতপুরে বস্তিতে এক মিস্ত্রীর বাড়ির ছোট এক চিলতে বারান্দা সহ একখানা ঘর ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন। রোজগারহীন সমরেশ তখন সম্পূর্ণ বেকার। দারুণ অভাব আর অনটনের মধ্যে তাদের দাম্পত্য জীবন শুরু হল। বাধ্য হয়ে তিনি জগদ্দল চটকলের সাহেবদের কোয়ার্টারে কোয়ার্টারে ডিম সবজি ফেরি সহ আরো অনেক ছোটখাটো কাজ করেন। তাতেও সপ্তাহে স্বামী-স্ত্রীকে দু’-তিন দিন উপোষ থাকতে হত। কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে ১৯৪২-এ তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় কমিউনিস্ট নেতা সত্যপ্রসন্ন দাশগুপ্তের। এই আলাপের ফলে তরুণ সমরেশ কমিউনিস্ট পার্টির কাছাকাছি আসেন । সত্যপ্রসন্ন তাঁকে জগদ্দল চটকল এলাকায় সংগঠনের কিছু দায়িত্ব দেন। তাঁরই সুপারিশে ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরিতে ইন্সপেক্টর অফ স্মল আর্মস-এর ড্রয়িং অফিসে চাকরি পান। এতে সংসারে কিছুটা সুরাহা এল বটে, তবে সমরেশ আস্তে আস্তে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন। সভা-সমিতি, আলাপ-আলোচনা, বই পড়া ও সংস্কৃতি-চর্চার মধ্য দিয়ে নিজেকে শিক্ষিত করে তুলতে লাগলেন। ‘উদয়ন’ নামে একটি হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা সমরেশের জীবনে এক নতুন বাঁক নিয়ে এল। এই সময় ১৯৪৪-এ একই সঙ্গে তিনি ও গৌরীদেবী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। সমরেশ বসুর লেখক জীবনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অবদান অনস্বীকার্য। তিনি নিজেই তাঁর লেখায় সে কথা স্বীকার করেছেন। “কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসার পরেই আমার চারপাশের জগৎ ও মানুষ সম্পর্কে দৃষ্টি সজাগ হয়। আমার অভিজ্ঞতার প্রসার ঘটে।” কিন্তু এই সময় অকস্মাৎ এক বোমা বিস্ফোরণে ওঁনার রাজনৈতিক গুরু সত্যপ্রসন্ন নিহত হন। এই ঘটনা যে পার্টির অন্তঃকলহের ফল, পার্টির মধ্যে ক্ষমতা দখল করার লড়াই, তা তিনি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন। তাই স্থানীয় পার্টি নেতাদের প্রতি তিনি যে শুধু বিতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন তা নয়, সোচ্চার প্রতিবাদও করেছিলেন।
১৯৪৯-এ কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষণা হলে সমরেশ গ্রেপ্তার হন। জেলে বসে চাকরি চলে যাওয়ার নোটিশ পেলেন। দিশেহারা সমরেশ ১৯৫১-তে জেলে বসেই স্থির করে ফেলেন তাঁর জীবনের লক্ষ্য। রাজনীতি না, তিনি এবার সাহিত্য রচনায় নিজেকে নিয়োজিত করবেন। সমরেশ যখন জেলে ছিলেন, সেই সময় গৌরীদেবী অনেক চেষ্টা চরিত্র করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে ১৫০ টাকা মাসিক সাহায্য জোগাড় করেন। এ বিষয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়ের মহানুভবতাকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। জেলে বসে লিখে ফেললেন ‘উত্তরঙ্গ’ উপন্যাস। এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস হলেও একুশ বছর বয়সে লেখা ‘নয়নপুরের মাটি’ তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে সমরেশ ঠিক করলেন তিনি লেখাকেই পেশা হিসেবে নেবেন। কতটা দুঃসাহস আর মনের জোর থাকলে তবে সেই সঙ্কটাপন্ন সাংসারিক অবস্থায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়! অবশ্য তখন গৌরী দেবী তাঁর পাশে ছায়ার মতো এসে দাঁড়ান। তিনি ভরসা দেন, মনে সাহস জোগান। নিজে সকাল বিকেল গানের টিউশনি করে, রাতে পোষাক সেলাই করে সংসার নির্বাহের ভার নিজের কাঁধে তুলে নেন। ছেলেমেয়েদের মানুষ করেন। স্ত্রীর কাছ থেকে এই নির্ভরতা ও প্রশ্রয় পেয়ে সমরেশ পুরোপুরি লেখায় আত্মনিয়োগ করেন। একে একে লিখলেন— নয়নপুরের মাটি, বিটি রোডের ধারে, শ্রীমতী কাফে, গঙ্গা, বাঘিনী, ত্রিধারা, তিন ভুবনের পারে, টানাপোড়েন মহাকালের রথের ঘোড়া শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে-এর মতো কালজয়ী সব উপন্যাস। ১৯৬৫-তে লেখেন ‘বিবর’ উপন্যাস। এরপর প্রকাশিত হয় প্রজাপতি, পাতক ও স্বীকারোক্তি উপন্যাস। এই তিনটি উপন্যাস ঘিরে এক সময় বাংলা সাহিত্যে তোলপাড় হয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে তৎকালীন নগর জীবনের মৌখিক চলতি স্ল্যাং ভাষায় লেখা অবক্ষয়িত সময়ের এক বিশ্বস্ত দলিল। ১৯৬৭-তে প্রকাশিত এই ‘প্রজাপতি’ উপন্যাসকে অশ্লীলতার দায়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তার বিরুদ্ধে সেই সময় আদালতে বহু লেখক বুদ্ধিজীবী ও পত্রিকা সম্পাদকরা নিজেদের অভিমত জানান। তারা বেশির ভাগ সমরেশ বসুর পক্ষে মত দেন। স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু মহাভারত রামায়ণ ও বিভিন্ন বিদেশী সাহিত্য থেকে উদাহরণ সহযোগে এই অশ্লীলতা অভিযোগের বিরোধিতা করেন। এবং পরিশেষে আদালতের রায়ে উপন্যাস এবং তার লেখক সম্পূর্ণ অভিযোগমুক্ত হন। সমরেশ বসু তাঁর প্রতিটি উপন্যাসে কাহিনী চরিত্র ও আঙ্গিক নিয়ে নতুন নতুন পরীক্ষা করেছেন। প্রতি ক্ষেত্রেই তিনি সফল হয়েছেন, পাঠক চিত্ত যেমন জয় করেছিলেন, তেমনই সমালোচকদেরও অকুণ্ঠ প্রশংসা পেয়েছেন। আপোষহীন এই লেখক সারাজীবন সত্যের সন্ধান করে গেছেন। নিজের বিচার বুদ্ধি ও বিশ্লেষণ দিয়ে তিনি উপন্যাসের কাঠামো গড়েছেন। সেখানে আমরা তাঁর এক প্রত্যয়ী লেখক সত্তাকে দেখতে পাই।
আগেই বলেছি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়ে ও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে সেই অস্থির সময়ের বাস্তব অভিজ্ঞতাকেই তিনি প্রথমদিকের উপন্যাসে ভাষারূপ দিয়েছেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের জীবন সংগ্রাম অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে তাঁর রচনায় উল্লেখিত হয়েছে। পরবর্তীতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তিনিও মানবজীবনের যৌনতাকে সাহিত্যে অসঙ্কোচে সুপ্রকট করেছেন। জীবন এক ব্যাপক বিস্ময়। মুগ্ধতার সঙ্গে তিনি তাকে অনুসরণ করেছিলেন, বিশ্লেষণ করেছিলেন আবার নির্লিপ্ত ও নিরপেক্ষ ভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। তাঁর উপন্যাস এক জীবনসত্য। নানান দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত ও শ্রমজীবী মানুষের জীবনের উপর আলো ফেলেছেন। সেই আলোয় আমরা পাঠক হিসেবে তৎকালীন সমাজজীবনকে পরিষ্কার দেখতে পাই। আবার তাঁর সাহিত্যের আর একটি দ্বিতীয় অভিমুখ আছে, যা তাঁর নগরকেন্দ্রিক উপন্যাসগুলোর বিষয়। উত্তাল সত্তর দশক, তার পরবর্তী কালে কলকাতা ও মফস্বল শহরকে কেন্দ্র করে যে গুন্ডারাজ, ওয়াগান ব্রেকিং, খুন, রাজনৈতিক ভণ্ডামী, গুপ্তহত্যা, তোলাবাজি, তার সাথে পুলিশি অত্যাচার ও দমননীতি —সবই নিখুঁত ভাবে তাঁর সাহিত্যে এসেছে। যেন ফটোগ্রাফি। সে হিসেবে তিনি একজন বস্তুনিষ্ঠ সময় ও সমাজ সচেতন ঔপন্যাসিক ছিলেন।
আর এক জায়গায় উত্তমকুমার ও সমরেশ বসুর মিল আছে। দু’জনে ছিলেন আদ্যোপান্ত প্রেমিক মানুষ। প্রেমের জন্য আকুল হয়েছেন, হয়েছেন রক্তাক্ত। প্রচলিত-সমাজধারণা ও আবেষ্টনের কাঠামো ভেঙে দু’জনেই নিজস্ব প্রেমকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে বলি, কিংবদন্তি দুই অভিনেতা ও সাহিত্যিকের প্রথমা স্ত্রীর নামেও কিন্তু মিল ছিল। গৌরী দেবী। দু’জনেই তাঁদের প্রেমে ও সাংসারিক দায়িত্বে ছিলেন বিশ্বস্ত অটল। নিজেদের অনেক কিছু ত্যাগ করে, কষ্ট স্বীকার করে তাঁরা লড়াকু তরুণ দুই স্বামীকে শিল্প সৃষ্টিতে নিরঙ্কুশ উৎসাহ দিয়েছেন। যাতে তাঁরা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে বিখ্যাত হতে পারে।
খ্যাতির পিছনে অপবাদ রাহুর মতো তাড়া করেছে ক্রমাগত দু’জনকেই। তবু এই দ্বন্দ্ব ও বিরহ থেকে রসদ নিয়ে এক না-ধরা প্রেমের পিছনে ছুটেছেন তাঁরা। তাঁদের শিল্পীসত্তা দ্বি-খণ্ডিত হয়েছে। জীবনের হলাহল কণ্ঠে ধারণ করে হয়েছেন নীলকণ্ঠ।
আবার দুই জীবনশিল্পীর জীবনের পরিণতিও অনেকটা এক। নিত্যদিনের কাজের চাপ, মানসিক যন্ত্রণা, শরীরের প্রতি উদাসীনতায় হৃদরোগে আক্রান্ত হন বার বার। শেষ পরিণতি মৃত্যু। নিজেকে সর্বভারতীয় স্তরের অভিনেতা প্রমাণ করতে উত্তমকুমার মুম্বাই পাড়ি দিয়ছিলেন। নিজের প্রযোজনায় বানাতে গিয়েছিলেন হিন্দী ও বাংলা ডবল ভার্সান ছবি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, গোপন ষড়যন্ত্র ও বিশ্বস্ত মানুষজনের অসহযোগিতায় তিনি ব্যর্থ হন। বহু টাকায় নির্মিত তাঁর ছবি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে। কার্যত, বিপুল টাকার দেনা মাথায় নিয়ে তিনি ফিরে আসেন কলকাতায়। ভগ্ন হৃদয়ে অসম্ভব মানসিক কষ্টের মধ্যেও দেনা পরিশোধ করতে যা ছবি পেয়েছেন হাতে সব নিয়েছেন। অমানুষিক সেই পরিশ্রম, তার উপর পারিবারিক সমস্যা তাঁকে জর্জরিত করেছিল। ভার সহ্য করতে পারলেন না, শুটিং ফ্লোরেই হার্ট অ্যাটাক হল। ১৯৮০, ২৪ জুলাই চিরনিদ্রায় চলে গেলেন ২৫০-এর বেশি ছবির কিংবদন্তি অভিনেতা অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়, বা আমাদের মহানায়ক উত্তম কুমার।
সমরেশ বসু বস্তুনিষ্ঠ কথাসাহিত্যিক হলেও তাঁর দ্বিতীয় সত্তা ছিল কালকূট। সেখানে তিনি একজন স্বপ্নদর্শী প্রেমিক মানুষ। যেন নির্লিপ্ত সন্ন্যাসী। বিশ্বাস করতেন, প্রেম হল মানুষের জীবনের চালিকাশক্তি। খানাখন্দে ভরা জীবন আবর্তে যেন আলোর উৎস। ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’, ‘কোথায় পাবো তারে’-এর মতো ক্লাসিক উপন্যাস আমাদের উপহার দিয়েছেন। সেখানে আপাত শান্ত ভদ্র জীবনের অন্তরালে কত দুঃখ-বেদনা, শঠতা-প্রতারণা, বঞ্চনা ও প্রাপ্তির ইতিকথা লুকিয়ে আছে, তা তিনি আমাদের দেখিয়েছেন। আমরা মুগ্ধ হয়েছি। হতাশাগ্রস্ত মানুষও জীবনকে ভালবাসতে শিখেছে।
১৯৮৭ তে ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশ শুরু হয় সমরেশ বসুর সারা জীবনের সাহিত্য সৃষ্টির সেরা ফসল ‘দেখি নাই ফিরে’। আত্মমগ্ন সন্ন্যাসী চিত্রশিল্পী ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজের রৌদ্রদগ্ধ জীবন অবলম্বনে সোনার অক্ষরে লেখা এই উপন্যাস। সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যে অনিঃশেষ সংগ্রাম আর সফলতার অপর নাম রামকিঙ্কর। জীবননিষ্ঠ রূপনিষ্ঠ এই শিল্পী সুনাম দুর্নাম উভয়কেই বক্ষে ধারণ করে শিল্প সৃষ্টি করেছেন। ঠিক সমরেশ যেমন করেছেন। দীর্ঘ প্রায় এক দশকের অক্লান্ত অন্বেষণ, পরিশ্রম পড়াশোনা ও বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তিনি এই ধ্রুপদী জীবন উপন্যসের বীজ বপন করেন। নিজের উত্তুঙ্গ আকাঙ্ক্ষা, তীক্ষ্ণ মেধা অনুভব শক্তির গাঢ়তা ও ঐশ্বরিক প্রতিভায় সমরেশ মৃত্যুর আগে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসটি লিখলেন। দুঃখের বিষয় উপন্যাস শেষ করতে পারেননি। অসমাপ্ত এই উপন্যাসটিই শুধু যদি লিখতেন তিনি, তাহলেও বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে থাকতেন।
সমরেশের প্রথম পর্বের উপন্যাসে ছিল গোষ্ঠী ও সমাজ-মানুষের সংগ্রামের কথা। দ্বিতীয় পর্বের উপন্যাসে ছিল মধ্যবিত্ত নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের প্রতিদিনের জীবন সংগ্রাম , উচ্চবিত্ত শ্রেণীর যৌনতা ও ভ্রষ্টাচারী জীবনের স্পষ্ট ছবি। তৃতীয় পর্বের উপন্যাসে ছিল শিকল ছেঁড়ার গান। রাজনৈতিক নেতাদের ভণ্ডামিকে তিনি ঘৃণা করেছেন কিন্তু রাজনীতিকে নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন উপযুক্ত রাজনৈতিক চেতনাই মানুষকে প্রকৃত শিক্ষিত করে তোলে। আর একজন প্রকৃত শিক্ষিত ও বোধসম্পন্ন মানুষই পারে প্রতিকূলতা থেকে নিজেকে উন্নীত করতে। তাই একদিন সমাজের রক্তচক্ষু ও অনুশাসন থেকে বাঁচতে যে তরুণ সমরেশ রাতের অন্ধকারে নিজ বাসভূমি নৈহাটি ছেড়েছিলেন, সেই সমরেশ একদিন জনপ্রিয় লেখক সমরেশ বসু হয়ে নৈহাটি ফিরে এলেন। এবং আপামর মানুষ সাগ্রহে তাঁকে বরণ করে নিল।
নিবন্ধ শুরু করেছিলাম, যে উত্তমকুমারকে নিয়ে, তিনি অকাল প্রয়াত হয়েছিলেন। সমরেশ বসুও ‘দেখি নাই ফিরে’ লিখতে গিয়ে নিজের শরীরের উপর যথেষ্ট চাপ নিয়েছিলেন, ফলে তিনি সময়ের অনেক আগেই চলে গেলেন। তবু দু’জনেই যেন ম্যাটিনি আইডল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমাদের যুবক বয়সে, চায়ের দোকানে, পাড়ার ঠেকে, কফি হাউসে সর্বত্র লেখক সমরেশ বসুকে নিয়ে আলোচনা হত। তাঁর উপন্যাসের কথা উঠে আসত। তাঁর নায়কের মুখের ভাষায় আমাদের সময়কার লেখকদের মুখের ভাষা মিলে যেত।”
তাহলে বুঝতে পারছেন, আমার এই নিবন্ধের নাম কেন রাখলাম, বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের উত্তমকুমার হলেন সমরেশ বসু।
••
আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই সম্পাদকমণ্ডলীকে।