গল্পঃ টান – ভূমিকা গোস্বামী

দরজায় খটখট আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল মোনালিসার। ভাবল– এতরাতে কে এল ? বাপি এসেছে নাকি ? রাতে তো সমীর থাকে। ওই তো সামলায়।বাপি কীভাবে আসবে।
বাইরে উল্টো পাল্টা পাগলা হাওয়া। মোনালিসার মনেও নানা কথার ঝড়। ওর সাথে রক্তের সম্পর্ক বিহীন সেই অশীতিপর মানুষটা – সময় নেই গময় নেই চলে আসেন , রোগা , লম্বা, ফর্সা চেহারার – আধ ময়লা ধুতি পাঞ্জাবীতে। দুপুরে রোদে ঘামতে ঘামতে এসে ডাকেন – “মোনা , একটু জল দে।”
হাত ধরে ঘরে এনে সোফায় বসিয়ে ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে , ছুটে রান্নাঘরে চলে আসে ও।এক গ্লাস দ ই এর সরবত করে এনে দেয়। ঢকঢক করে সরবতটা খেয়ে নেন পিপাসার্ত মানুষটা। তারপর বলেন –”তিস্তা এসেছে ? ওকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। একটু খুঁজে দিবি মা ? কোথায় যে গেল ?”মোনালিসা চুপ করে থাকে। কী বলবে ভেবে পায় না….

  • “বাপি, ভাত খেয়েছো ?”
  • চুপ করে মাথা নিচু করে বসে থাকেন ।শুনতে পেয়েছেন কী না বুঝতে পারে না মোনালিসা।
    মোনালিসা তেল মাখিয়ে বলে – যাও তো স্নানটা করে এসো। আমারও খুব খিদে পেয়েছে।
    পরিমলের তোলা ধুতি পাঞ্জাবী পরিয়ে, সুন্দর করে সাজিয়ে খেতে দিয়ে নিজেও পাশে বসে খেতে খেতে দুনিয়ার গল্প । কখনো উনি ছোটবেলার গল্প বলতে বলতে হেসে কুটিপাটি হতেন, তো কখনো ওঁর ছাত্রছাত্রীদের গল্প বলতে বলতে যেন কোথায় হারিয়ে যেতেন। বেশীরভাগ সময় তিস্তা এই বলে, তিস্তা সেই বলে। তিস্তার এটা পছন্দ তিস্তার সেটা পছন্দ। বলতে বলতেই হঠাৎ বলে উঠেন –”আচ্ছা, তিস্তা কোথায় ? ওকে দেখেছিস ? কোথায় যে গেল !”
    প্রফেসর বিনোদ বিহারী চক্রবর্তী। সাহিত্যের স্টুডেন্টদের অতি প্রিয় বি বি সি। এই জনপ্রিয়তা একদিন ওঁর যশের শিখর ছুঁয়েছিল। পঞ্চাশ বছর আগে সুদর্শন বিনোদ বিহারীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন তখন তিস্তা চৌধুরী। ইতিহাসের শিক্ষিকা । কলেজে জয়েন করার দিন থেকেই বিনোদ বিহারীর সঙ্গে আলাপ। পরিণত শিক্ষিত দুটি নারী পুরুষ কাছাকাছি আসতে সময় লাগেনি বেশী। পিতৃমাতৃহীন মেসে থাকা বিনোদ বিহারীর ঘর হলো। ঘরণী হলো। একটা ছেলেও হল। রঙিন দিনগুলো কাটতে লাগল স্বপ্নের মতো। এরমধ্যেই বেশ কয়েকটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। মানুষ ওঁর লেখার প্রেমে পাগল। সকলের অব্যক্ত মনের কথা যেন বিনোদ বিহারীর কলমে। দেশে কী বিদেশে সভা সমিতিতে ওঁকে একবার দেখার জন্য মানুষের যেন ঢল নামতো।
    ছেলে বিশ্বম্ভর , স্কুল কলেজের পড়া শেষ করে তখন সবে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। মধ্যকলকাতায় বেশ বড়সড় একটা ফ্ল্যাট হয়েছে ওদের। তিস্তা ওর মনের মাধুরী দিয়ে প্রতিদিই ওদের স্বপ্নের নীড় সাজিয়ে চলেছে। ছুটির দিনে ওদের বন্ধু বান্ধবরা আসেন। সারাদিন গল্প গান খাওয়া দাওয়া চলে। যাঁরা আসেন সকলেই একবাক্যে স্বীকার করে তিস্তার রুচিবোধের।বিনোদ বিহারীর ব্যাস্ততা তো ছিল ই। কলেজের অবসরের পর আরও ব্যাস্ততা যেন বেড়ে গেল। প্রায় দিন বাড়ির বাইরেই থাকেন। নানা রাজ্যে শুধু না, বছরে বেশ কয়েকবার বিদেশেও যান।
    তিস্তা হঠাৎ খেয়াল করলেন- স্বামীর উদাসীনতা শুধু যে ব্যস্ততার কারণে তা বোধহয় না। সবসময় যেন মগ্ন রয়েছেন কোনো ধ্যানে। কতদিন বিনোদ তাঁকে আদর করেন নি। এমনকি সযত্নে তিস্তার স্পর্শও এড়িয়ে চলছেন । প্রথম প্রথম ভেবেছেন বয়স হয়েছে, এখনও কি আগের মতো বৌ নেওটা হয়ে থাকবেন নাকি ? দিন যেতে থাকলো নদীর স্রোতের মতো।
    মাঝে মাঝেই গভীর রাতে ফোন নিয়ে ব্যালকনিতে চলে যান বিনোদ বিহারী। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেন । প্রায় দিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় তিস্তার। দেখতে পান সব। প্রশ্ন করলেও সঠিক উত্তর পান না। ধীরে ধীরে সন্দেহ দানা বাঁধে। তবু যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। তিরিশ বছরের দাম্পত্যে কখনও কোন স্খলন তো দেখেন নি মানুষটার !
    তিস্তা সদ্য রিটায়ার করেছে। এদিকে কলকাতার বাইরে কোচবিহারে একটি কবিতা সম্মেলনের নিমন্ত্রণ পেয়েছেন বিনোদ বিহারী। আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মহাকবি কালিদাসকে স্মরণ করে অনুষ্ঠান। কর্তৃপক্ষ গাড়ি পাঠাবেন সকাল ছ’টায়। সুটকেস গোছাচ্ছেন বিনোদ বিহারী। তিস্তা বললেন – কোথায় যাবে ?
    ধুতি পাঞ্জাবী সুটকেসে ভরতে ভরতে তিস্তার দিকে না তাকিয়েই বললেন ― কোচবিহার।
  • “আমিও যাব”। আদুরে গলায় বললেন তিস্তা। – “তুমি থাকবে না। সারাদিন একা একা….”
    কথা শেষ করার আগেই বিনোদ বললেন – “মাত্র তো তিনটে দিন। অনেকগুলো সভা করতে হবে এরমধ্যে। তোমার বাতের ব্যথা । এত ধকল সইবে না। তাছাড়া ওখানে কবি সাহিত্যিকদের নিমন্ত্রণ। তোমার ভাল লাগবে না। শুধু শুধু বোর হবে।”
    ― “কেন কবিতা শুনতে আমারও ভাল লাগে। তোমার কবিতার প্রথম শ্রোতা তো আমিই ছিলাম একসময় তাই না ? না, আমি একা একা এতবড় বাড়িতে থাকতে পারবো না। আমিও যাব তোমার সঙ্গে ব্যাস্।”বলেই তিস্তা নিজেও সুটকেস গোছাতে চলে গেলেন।
    ― “আরে, ওখানে গিয়েও তো তোমাকে সেই একাই থাকতে হবে হোটেলের ঘরে।” পিছুপিছু গিয়ে…. বিরক্ত কণ্ঠে বলেন বিনোদ বিহারী।
    ― “আমি যাব বলেছি তো।” কঠিন গলায় বললেন তিস্তা।
    গাড়ি মাইল পাঁচেক যেতেই ওখান থেকে উঠল অপালা মিত্র। তিস্তার দিকে জায়গা থাকা সত্বেও ঘুরে গিয়ে বিনোদ বিহারীর কোল ঘেঁষে বসল মেয়েটা। কবিতা লেখে। ইদানিং বেশ কয়েকটি নামী অনামী পত্র পত্রিকায় ওর কবিতা প্রকাশিতও হয়েছে। বিভিন্ন সাহিত্য সভা সমিতিতেও ডাক পাচ্ছে।
    ওখানে গিয়েই ওঁর সন্দেহটা যে অমূলক নয় বুঝতে অসুবিধা হল না তিস্তার। স্ত্রীরা বোধহয় স্বামীর মন পড়তে সিদ্ধহস্ত। অপালাকে দেখে , ওর হাবভাবে সব বুঝে গেলেন। তাহলে,এই সেই মহিলা যার সাথে দিনে রাতে অনেকটা সময় ফোনে ব্যাস্ত থাকেন আজকাল বিনোদ বিহারী ! মাঝরাতেও এর ই ফোন এলে বিছানা ছেড়ে ব্যালকনিতে চলে যান !
    বছর পঁয়তাল্লিশের ডিভোর্সি অপালা মিত্র পূর্ণ যুবতী।স্লিভলেস ব্লাউজ । চড়া মেকআপ। স্লিম লম্বাটে ফর্সা । কালো শিফনের শাড়িতে অপালার শরীরের খাঁজ গুলো বড্ড বেশি প্রকট যেন ।
    পরের দিন সাহিত্য সভায় তিস্তা গেলেন সঙ্গে। হোটেলে ফিরতে ফিরতে দশটা বেজে গেল। ডিনার সেরে প্রেসারের ওষুধ খেলেন। কিন্তু ঘুমের ওষুধ টা আজ খেলেন না। বিনোদ বিহারী বললেন ― সব ওষুধ ঠিকঠাক খেয়েছো তো ? ঘুমের ওষুধ ?
    ওষুধের কৌটো আটকাতে আটকাতে তিস্তা বললেন ―” হুঁ।”
    টিউবলাইট নিভিয়ে বেড লাইট জ্বালিয়ে শুয়ে পড়েছেন ওঁরা। সারা ঘর নীল আলোয় স্বপ্নময়। কতদিন পর ওঁরা একসাথে বাড়ির বাইরে কোথাও ঘুরতে এসেছেন। বিনোদের এই ভাবলেশহীন চেহারাটা তিস্তার অচেনা । বিনোদ পিছন ফিরে শুয়ে আছেন। তিস্তা বাঁ হাতটা বিনোদের পিঠের ওপর রাখে। এ কি ! এ কেমন স্পর্শ ! আরষ্ট হয়ে আছে ও! একি তার সেই বিনোদ! কয়েক সেকেন্ড পর ধীরে ধীরে হাতটা নামিয়ে দেয় বিনোদ সামনে না ফিরেই।
    বালিশে ঠোঁট চেপে কান্নার উচ্ছ্বাস রোধ করেন তিস্তা। আষাঢ়ের প্রথম দিনে বাইরে মেঘ ভাঙা বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ। চোখ বুজে চুপচাপ শুয়ে আছেন তিস্তা ঘুমের ভান করে। প্রায় ঘন্টাখানেক পর তিস্তা দেখল সাইলেন্স মোডে রাখা বিনোদের ফোনটা কেঁপে কেঁপে উঠল। বিনোদ ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে ফোনটা হাতে নিয়ে পা টিপে টিপে দরজার দিকে এগোলেন। দরজার ছিটকিনি সন্তর্পণে খুলে বাইরে গেলেন। আস্তে করে দরজা চেপে ভিজিয়ে দিলেন। তিস্তার বুঝতে বাকি রইল না বিনোদ এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন। পাশের ঘরটাই অপালার।মাঝখানে সিঁড়ি।সামনে লম্বা ব্যালকনি। তিস্তা বিছানা থেকে নেমে বাঁ দিকের পাল্লাটা চাপতেই নিঃশব্দে দরজাটা ফাঁক হয়ে গেল। মুখটা অল্প বের করেই ব্যালকনির আলোয় স্পষ্ট দেখলেন, বিনোদ অপালার রুমের সামনে।পরদিন খুব ভোরেই ক্যাব বুক করে একাই ফিরে এসেছিলেন তিস্তা। তখন বিনোদ তিস্তার পাশের বালিশে মাথা রেখে গভীর ঘুমে।
    সেইদিনই বাড়ি ছেড়েছিলেন তিস্তা। কৌশিকীর ফ্ল্যাটটা দুজনের থাকার পক্ষে যথেষ্ট।
    ষাটোর্ধ দুই বান্ধবী । এক স্কুল। এক কলেজ। এক ইউনিভার্সিটি। এক সাবজেক্ট। একই সময়ে রিটায়ারমেন্ট। তবে দুজনের কর্মভূমি পৃথক। তিস্তার বিয়ে সন্তান ভরা সংসারের ব্যস্ততাতেও অবিবাহিত কৌশিকীর সাথে বন্ধুত্ব কমেনি। বিনোদের অতি ব্যস্ততা, তিস্তার একাকীত্ব ওদের আরও বোধহয় নিবিড় করেছে। বিনোদ বাড়িতে না থাকলে, কৌশিকীকে ফোন করে বলেন তিস্তা – “জানিস তো আমি একা থাকতে পারি না। প্লিজ এখানে থাক না ক’দিন।”
    তিস্তার সন্দেহের কথা জানিয়েছিলেন কৌশিকীকে। কৌশিকী বলেছিলেন ― “আর একটু অবজার্ভ কর। চোখে চোখে রাখ। এই বয়সের সলভেন্ট পুরুষকে ফাঁদে ফ্যালে একধরনের মেয়ে। সর্বশান্ত করে ছেড়ে দেয়।”
    কৌশিকীর কথাতেই ও এবার জোর করে বিনোদের সঙ্গে গিয়েছিলেন। কিন্তু মোহগ্রস্ত বিনোদকে বোঝালেও তো বুঝবে না। পরকীয়ার অমোঘ টান । কি করবে এখন তিস্তা ! আকাশ পাতাল ভাবতে ডাবতে কৌশিকীর ফ্ল্যাট এসে গেল।
    বিকেলে বিনোদ বাড়ি ফিরে তিস্তাকে দেখতে পেলেন না। ভেবেছিলেন বাড়িতেই দেখতে পাবেন। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলেন তিস্তাকে। ওপারে রিং হচ্ছে। তিস্তা ফোন তুলতেই যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব নিয়ে বিনোদ বললেন – কি হল তিস্তা ? তুমি কোথায় ?
    ― এতক্ষণে আমার কথা মনে পড়েছে ?
    স্বাভাবিক স্বরে বিনোদ বললেন ― আচ্ছা কি কথা বলছো বলতো ? তোমাকে মনে পড়বে না ? এক একা চলে এলে কেন ?
    ― ও, জান না তাই না ? এত ভাল অভিনয় করতে পার সেটা তো জানা ছিল না। কাল রাতে আমি স-ব দেখেছি বিনোদ! ছিঃ বিনোদ ! ছিঃ !
    ফোনটা কেটে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিস্তা। এমন দিন কখনও আসতে পারে দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি তিস্তা। আরও চমক বাকী ছিল। পরের দিন ব্যাঙ্কে টাকা তুলতে গিয়ে দেখলেন ওর আর বিনোদের জয়েন্ট এ্যাকাউন্টে একটাও টাকা নেই। ওঁদের দুটো এ্যাকাউন্ট। দুটোই জয়েন্ট। একটাতে বিনোদের পেনশন জমা পড়ে। একটাতে তিস্তার। তিস্তার এ্যাকাউন্টের টাকা তোলাই হত না। প্রায় পাঁচ লাখ টাকা ছিল। কৌশিকী সাথে না থাকলে যে কি হত সেদিন তিস্তার ! ব্যাঙ্কের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়েছিলেন তিস্তা। চোখে মুখে জলের ছিটা দিয়ে, জল খাইয়ে একটু সুস্থ করে বাড়ি ফিরিয়ে এনেছিলেন কৌশিকী। তারপর বিনোদকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলেন,এত টাকা কোথায় কীভাবে খরচ করেছেন বিনোদ। বিনোদ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন প্রথমে। কৌশিকীর জেরার চাপে বলেছেন –” বন্ধুর বিপদে ধার দিয়েছি। প্লিজ,তিস্তাকে বোঝাও,বাড়ি ফিরতে বল কৌশিকী । ওতো ফোন ধরছে না। আমি কাল সকালে তোমার বাড়ি যাব। গিয়ে ওকে নিয়ে আসবো। ” পরের দিন সকালে বিনোদ এসেছিলেন। কিন্তু তিস্তা তখন অনেক দূরে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সেই রাতেই সদ্য কেনা ঘুমের ওষুধের শিশি শেষ করে অসীম ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে।
    তিস্তা শারীরিক ভাবে অসুস্থ ছিলেন। থাইরয়েড, সুগার, প্রেসার ছিল নিত্যসঙ্গী। কিন্তু মনের জোর এতই প্রবল ছিল যে সবসময় ওকে প্রাণবন্ত লাগত।এই ঘটনার পর থেকে মানসিক ভাবে একেবারে ভেঙে পড়লেন, কোন কথা বলতেন না। পুরোপুরি বিষাদগ্রস্থতায়া ডুবে গিয়েছিলেন। কৌশিকী জোর করে টিভির ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালে, টিভির দিকে তাকিয়ে থাকতেন তিস্তা, ভাবলেশহীন চোখে।
    বিশ্বম্ভর এলো দুদিন পর। একই সাথে মায়ের সৎকার আর বাবাকে মেনটাল হসপিটালে এ্যাডমিট করতে হল ওকে। পাশের বাড়ির মোনালিসা ছিল ওই হসপিটালের নার্স। মোনালিসাই ব্যবস্থা করে ভর্তি করিয়েছিল। বিশ্বম্ভর মোনার হাত ধরে বলেছিল – মোনাদি,আমাদের এখানে নিজের বলতে কেউ নেই। বাপিকে তোমার কাছে রেখে গেলাম। তুমি দেখ। রোজ তোমাকে ফোন করবো, বাপির খবর নেব। টাকা পয়সা যা লাগবে তোমার এ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেব।
    দেখতে দেখতে দুটো বছর পার হয়েছে। মোনার বিয়ে হয়েছে। বিশ্বম্ভরও বিয়ে করেছে এক বিদেশী মেয়েকে। ডাক্তারবাবুদের কথায় বিনোদ বিহারী সুস্থ। ওঁদের পরামর্শ ছিল,এখন বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ওঁর সাথে কথা বলতে হবে। ধীরে ধীরে স্মৃতি ফিরিয়ে এনে ওঁর স্ত্রী যে মৃত আর কখনও ফিরবে না জানাতে হবে। হসপিটাল থেকে ওকে এই ডিউটিটাই দেয়া হয়েছিল। বাড়িতে থেকেই এই কাজটা করতো মোনালিসা। সবসময় ডাক্তারদের ফোনে আপডেট দিত। পাশাপাশি বিশ্বম্ভরকেও।
    আবারও দরজায় খটখট আওয়াজ। ঘুমন্ত পরিমলকে ডাকে মোনালিসা। তারপর দরজার আই হোল তুলে দেখে সমীর দাড়িয়ে আছে। এত রাতে সমীরকে দেখে অজানা আশংকায় বুক কেঁপে ওঠে ওর। দরজা খুলতেই সমীর বলে – দিদি, শিগগিরই চলুন, ডাক্তার বাবু এসেছেন আপনাকে ডাকছেন।
    এতটা দিন ডিউটি করতে করতে কখন মানুষটা ওর ছোটবেলায় হারানো বাবার জায়গা নিয়ে ফেলেছিলেন।
    বিনোদ বিহারীর ফ্ল্যাট এখন লোকে লোকারণ্য। টেবিলের ওপর কাঁচের গ্লাস দিয়ে চাপা দেওয়া একটি চিরকুট। তাতে লেখা – “তিস্তা আমি তোমার কাছে আসছি।”

One thought on “গল্পঃ টান – ভূমিকা গোস্বামী

  1. অসাধারণ গল্পের বুনট…..খুব ভালো লাগলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *