বয় ফ্রেন্ড
দেবাংশু সরকার
শান্তাদি আমাদের পাড়ায় থাকেন। অনেক দিনের পুরানো বাসিন্দা। শান্তাদির স্বামী অবশ্য বাড়িতে থাকেন না। তার বদলীর চাকরি। তিনি বেঙ্গল পুলিশে উচ্চপদে কর্মরত। সেইজন্য কখনো শিলিগুড়ি, কখনো মালদহ, কখনো মেদিনীপুরে থাকতে হয়। তিন চার মাস অন্তর বাড়িতে আসেন। কয়েক দিন বাড়িতে থেকে আবার কর্মস্থলে ফিরে যান। শ্বশুর, শাশুড়ি, ছেলেকে নিয়ে শান্তাদি বাড়িতে থাকেন। সংসারের যাবতীয় দায় দায়িত্ব নিজের হাতে সামলান। সেইসঙ্গে সামলান তার স্কুলের দায়িত্ব। শান্তাদি হাই স্কুলের শিক্ষিকা। খুব গম্ভীর মানুষ। বলতে গেলে খুব রাগী। স্কুলে শান্তাদির দাপটে বাঘে গরুতে একঘাটে জল খায়। এক সময়ে শান্তাদি প্রচুর টিউশনি করতেন। এখন অনেক কমিয়ে দিয়েছেন। এখন সন্ধ্যার পর মাত্র পাঁচজন একাদশ শ্রেণীর ছাত্রীকে পড়ান।
শান্তাদির ছেলে শুভ কলেজে পড়ে। খুব ভালো পড়াশোনাতে। ছোটো থেকে সে কোনোদিন প্রাইভেট টিউশন নেয় নি। বরাবরই সে তার মায়ের কাছে পড়াশোনা করেছে। শান্তাদি খুব ভালোভাবে ছেলেকে মানুষ করছেন। শুভ যাতে বদ সঙ্গে না পড়ে সেদিকে শান্তাদি কড়া নজর রাখেন। শুভও সব সময়ে মায়ের কথা মেনে চলে। খুব মনোযোগী ছাত্র শুভ। সব সময়ে পড়াশোনা নিয়ে থাকে। শুভকে দেখতে যেমন সুন্দর, তার ব্যবহারও তেমন মিষ্টি। সব সময়ে মুখে হাসি লেগে আছে। খুব মিশুকে ছেলে শুভ। তবে মিশুকে হলে কি হবে, তার বন্ধু বান্ধবের সংখ্যা নিতান্তই কম। কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গেই তার মেলামেশা। এর বাইরে তার আর কোনো বন্ধু নেই। আজ বান্ধবীরতো কোনো প্রশ্নই নেই। শান্তাদি শুভকে বারে বারে সতর্ক করেন যেন রাস্তাঘাটে কোনো মেয়ের সঙ্গে সে কথা না বলে। রাস্তাঘাটে অনেক ছেলেধরা মেয়ে ঘুরে বেড়ায়, শুভর মত ভালো ছেলেদের দেখতে পেলেই ঘাড় মটকায়। শুভও সর্বদা মাতৃ আজ্ঞা পালন করে। রাস্তায় কোনো মেয়ে শুভর দিকে তাকালে, শুভ ছিটকে দশ হাত দুরে সরে যায়।
ইদানিং সন্ধ্যার সময়ে শান্তাদিকে বিভিন্ন দোকানে কেনাকাটা করতে দেখা যাচ্ছে। সচরাচর স্কুল থেকে ফেরার পথে শান্তাদি কেনাকাটা সেরে বাড়ি ফেরেন। তারপর আর বাড়ি থেকে বের হন না। সন্ধ্যার সময়েতো শান্তাদি তার ছাত্রীদের পড়ান! তাহলে হঠাৎ এই পরিবর্তন কেন? অবাক হয়ে একদিন জীজ্ঞাসা করলাম, “দিদি, আপনার ছাত্রীদের কি এখন ছুটি দিয়েছেন?”
- “না, না, ছুটি দিইনি, একেবারে ছাড়িয়ে দিয়েছি সবকটাকে।
- “সেকি কেন?”
- “কেন আবার! মেয়েগুলো সব লেখা পড়ায় অষ্টরম্ভা, খালি আমার ছেলের দিকে নজর!”
- “ওরা কি আপনার ছেলেকে কোনো কুপ্রস্তাব দিয়েছে?”
- “অতটা বাড়াবাড়ি করেনি। তবে খুব খারাপ কাজ করেছে।”
- “কি করেছে?”
- “আমার মোবাইল ফোনের হোয়াটস অ্যাপে আমার ফটো সরিয়ে আমার ছেলের ফটো দিয়েছিলাম। ব্যাস…।”
- “ব্যাস! কি ব্যাস?”
- “দেখি দশ মিনিটের মধ্যে আমার ফোনে পাঁচটা ‘হাই’ চলে এসেছে! সেইজন্য সবকটাকে ছাড়িয়ে দিয়েছি। আর কোনো মেয়েকে ঘরে ঢোকাবো না।”
তারপর জল অনেক দুর গড়িয়েছে। ছাত্রীরা দফায় দফায় ভুল স্বীকার করেছে। ক্ষমা চেয়েছে। কিন্তু শান্তাদি তার মত পাল্টাতে রাজী নন। ছাত্রীদের অভিভাবকরাও বারে বারে এসেছেন, অনুনয়, বিনয় করেছেন। কিন্তু বরফ গলেনি। বেশ সমস্যায় পড়ে গেছে ছাত্রীরা, এমনকি তার অভিভাবকরা। সামনেই পরীক্ষা। অন্য কোনো দিদিমণিও পরীক্ষার মুখে নতুন ছাত্রীদের পড়াতে চাইছেন না। এখন কোথায় যাবে? কার কাছে পড়বে? কিছুই ভেবে পাচ্ছে না এই পাঁচজন ছাত্রী।
কিছুদিন পরে দিয়াকে দেখছি আবার শান্তাদির বাড়ি পড়তে যাচ্ছে! দিয়া আমাদের পাড়ার মেয়ে। আমাকে ভালোভাবেই চেনে, ডেকে জীজ্ঞাসা করলাম, “তুই কি শান্তাদির বাড়িতে পড়তে যাচ্ছিস?” - “হ্যাঁ, আমি একা পড়ি। আন্টি আর কাউকে পড়ান না।”
- “কি করে ম্যানেজ করলি?”
- “আমি কিছু করিনি। একদিন জয়ের সঙ্গে ঘুরতে যাচ্ছিলাম। জয় মানে…ইয়ে…মানে…।”
- “বুঝতে পেরেছি। জয় হলো তোর বয় ফ্রেন্ড। ইয়ে মানে, ইয়ে মানে না করে তারপর কি হলো বল?”
- “একদিন জয়ের সঙ্গে ঘুরতে যাচ্ছিলাম। আন্টির সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। পরের দিন আন্টি ফোন করে জানতে চাইলেন ছেলেটা কে? সব কিছু খুলে বললাম। তারপর আন্টি আমাকে আবার পড়তে আসতে বললেন।”
- “বুঝলাম তুই হলি শান্তাদির নিরাপদ কাস্টোমার। তোর বন্ধুরা এখন কার কাছে পড়ছে?”
- “কারো কাছে পড়ছে না। ওরা এখন হন্যে হয়ে বয় ফ্রেন্ড খুঁজছে।”