মুক্তগদ্যঃ আমার শহরে পৌষের গুনগুন – মধুপর্ণা বসু

এখন কলকাতার শীত ভীষণ দামী। কালেভদ্রে কপালে থাকে সেই সক্কাল বেলা, লেপের তলা থেকে উঠতে গায়ে জ্বর আসা আলস্য প্রেম।বোনরা মিলে মুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরোলে বলা,এই দ্যাখ, তামুকে দুচারটে টান দিলাম। চারিদিক কুয়াশার চাদরে ঢাকা,পাশের কারখানায় সকাল নটার সাইরেন বেজে উঠল। চলচল!ডিউটি শুরু। শুয়ে শুয়ে শুনতে পাওয়া গভীর রাতে পাড়ার খ্রিস্টান পরিবারের ঘরে ঘরে বড়দিনের ক্রিসমাস ক্যারেল গাইতে আসা চার্চের মিশনারীরা, আমরা দক্ষিণ দালানের জানলা থেকে শুনতাম ঘুমন্ত চোখে।
হোসেন’শা পার্কের ভিজে ঘাসে শিরশিরানি, টুপটাপ পদ্মপাতায় শিশির।একটু রোদের দেখা পেলেই বাঁদর টুপি মাথায় পাড়ার দাদু কনকনে ঠান্ডায় মোড়ের দোকানে মাদার ডেয়ারির প্যাকেট অথবা গরম কচুরি জিলিপী কিনতে আসত।আমাদের দক্ষিণ বারান্দায় যখন সারি সারি জানলা দিয়ে মিঠেকড়া রোদ লাল চকচকে সিমেন্টে পড়তো, এক একটা রোদেলা জানলার রোদ মেখে আমরা ছয় বোন, পিঠে পিঠ দিয়ে বসে কমলালেবু ছাড়িয়ে খেতাম আর দুষ্টুমি করে খোসা গুলো এর ওর চোখের কাছে চিপে দিতাম, চোখ জ্বালা করতো .. সেটাই ছিল মজা।রান্নাঘর গন্ধে বিভোর হতো পিঁয়াজকলি দিয়ে ছোট ট্যাংরা মাছের ঝাল, সাদা ফুলকপির বাটিচচ্চরি আর ফুলকো লুচিতে। রাতে প্রায়ই অনেক রকম শীতের সবজি দিয়ে ঘন মুসুর ডাল বেগুন পোড়া আর ম্যান্ডেটারি শেষ পাতে খেজুর গুড়ের সুজির পায়েস, আহা! মনটা কেঁদে হুহু করে উঠল।গিরিশ একরকম ছোট্ট গুড়ের কড়া পাকের গুলি সন্দেশ বানায়, তখন ২ টাকা পিস ছিল। মুঠো ভরে খেতাম। মনে আছে ছোটবেলায় ডিসেম্বরে রাজস্থান ভ্রমণে আমি আর মিঠু রাতের ট্রেনে চুপিচুপি খেয়ে ফেলেছিলাম এক বাক্স জয়নগরের মোয়া।ব্যাস, সকাল বেলা আর কেউ পেলনা তার ভাগ!
শীতের শহরে শিশিরে ভিজে ট্রামলাইন, মাঠে মাঠে ফুটবল আর ক্রিকেট প্র‍্যাক্টিস, লেকের জলে রোদের ঝিলমিল উৎসাহী মর্নিং ওয়াকারদের সোয়েটার জ্যাকেটের কোলাকুলিতে বেশ গরম হয়ে ওঠে। ভিক্টোরিয়ার পরীর পেলব শরীরের হাতছানি তো একদিন চিড়িয়াখানায় চড়ুইভাতি ডিম পাঁউরুটি টিফিনকেক।আমাদের বাড়ি চিরিয়াখানার কাছে বলে ছোট বেলায় অনেক রাতে নিস্তব্ধতা ঘুচিয়ে বাঘের ডাক শুনতে পেতাম। শনি-রবিবার মানেই ঘুরে বেরানো মেলার মাঠে আর বাবুর সাথে গড়ের মাঠে ঘুড়ির প্যাঁচ দেখতে যাওয়া…
শীত ছুঁয়ে যায় মনের কুঠুরিতে, রুক্ষ অসজ্জিত পাহাড়ের মাটিরঙ বুকে, ছাদ বাগানের রঙিন পিটুনিয়া, কসমস,জারবেরা,গোলাপি কাগুজে বোগেনভিলিয়াকে লিখে দিয়ে আসি নীরব শুভেচ্ছা। নিঃশব্দ রোমন্থন অদৃশ্য ছবি হয়ে ডিসেম্বরে পার্ক স্ট্রিট,বো ব্যারেকে, সাউথ সিটি,কোয়াস্ট মলে সিটি সেন্টারের জ্বলজ্বল জমকে চকমকি পাথরে ঠিকরে পড়ে।
আমিও ভেসে যাই মুহূর্তের ভাসানে, ধোঁয়া ওঠা ক্যাপুচিনো, রকমারী ককটেলে, সান্তাবুড়োর ওয়েলকাম বার্তা যৌবন প্রৌঢ়ত্ব তফাৎ ঘুচিয়ে টেকনিক্যালি আপগ্রেড করে তোলে আমার সচেতন সত্ত্বাকে।
শীতের আমেজ এইসব আদরের স্মৃতিতে মুখর।নেই, নেই যেন কি এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক,মনের চিন্তাহীন জড়িয়ে পড়া।শুধু স্মৃতিতে সব নড়েচড়ে,বেঁচে থাকে।থাকবেও যতো দিন না এই প্রদীপের সলতেটা নিভে যাচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *