অণুগল্পঃ প্রেম পূজা মাধবীলতা – পার্থ রায়

“ভাল আছ?”

পাড়ার পুজোতে অষ্টমীর অঞ্জলি দিয়ে চপ্পল জোড়া সবে পায়ে গলিয়েছি। এক সময়ের অতি কাঙ্খিতা সেই কণ্ঠস্বরে চমকে পিছু ফিরি। মাধবীলতা! আমার প্রথম প্রেম। সুখের মেদে ঈষৎ পৃথুলা। চোখের নিচে ক্লান্তির কালি দৈহিক স্বচ্ছলতার সাথে বেমানান। সুখেরও কি ক্লান্তি থাকে? সাথে থাকা স্ত্রী কী বুঝল কে জানে, বলল, “কথা বলে এসো। আমি এগুচ্ছি”।


আশির দশক। মুঠোফোন, অন্তর্জাল, ফেসবুক শব্দগুলো ভ্রূণস্থ হয়নি। আমি তখন সুরেন্দ্রনাথে দ্বিতীয় বর্ষে। ও ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউশন। বন্ধুর বোন। পুজোর ছুটির আগে কলেজে শেষ দিন। ট্রেনের গোলমাল। একসাথে ফিরেছিলাম। ক্রমশ আলাপচারিতা গড়িয়ে পরিণতি পেয়েছে প্রেমের প্রলাপে। সেবছর পুজো কবিতার মতো সুন্দর। বসুশ্রী সিনেমা হলে প্রথম হাতে হাত। রেস্তোরাঁর ঘেরাটোপের প্রথম ভীরু চুমু পরবর্তীতে পরিপক্ক হয়েছে ঢাকুরিয়া লেকে। এক পুজোতে টিউশনের টাকা দিয়ে এক জোড়া ইমিটেশনের দুল।

কলেজ শেষে চাকুরির পরীক্ষা দিয়ে চলেছি। বামুন বাড়ি এই সম্পর্ক মানেনি। তায় আবার বেকার। ছবি বিশ্বাস, কমল মিত্রদের সাদা কালো সিনেমার মতো শোনাচ্ছে? শোনাক, সত্যিটা তো চিরকাল সত্যিই থাকে। পরে আমি যখন ব্যারাকপুরে পুলিশের ট্রেনিং নিচ্ছি, এক সন্ধ্যায় মাধবীলতা অর্থবান ব্যবসায়ীর ঘরণী। আত্মহত্যার কথা ভাবিনি তবে রক্তক্ষরণ বন্ধ হতে অনেকদিন লেগেছিল। সময় শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক। তাই মুভ অন করতে পেরেছিলাম।


স্মৃতির সমুদ্র-গভীর স্তর ভেদ করে ভেসে উঠল ওর সেই সময়ে অন্তর চিরে দেওয়া অধৈর্য চিৎকার “কতো যুগ অপেক্ষা করতে হবে তোমার চাকরি পাওয়ার জন্য! বাড়িতে এক ধনী বিজনেসম্যান ছেলের সাথে কথা অনেকটা এগিয়ে গেছে। তাছাড়া আমাদের বাড়িতে লোয়ার কাস্টে……”। বুকের ভেতর শোণিতের ফল্গু ধারার অস্তিত্ব নিয়ে অস্ফুটে বলেছিলাম, “থামলে কেন? ভয় পাচ্ছ যদি জানতে চাই সব জেনে শুনেও লোয়ার কাস্টের বেকার ছেলের সাথে এতদিন যা ছিল সেটা কি তাহলে প্রেম প্রেম খেলা? আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। আসি”। বিয়ের পরে একবার যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল। রাগে সাড়া দেইনি।
আজ সাড়া দিলাম। “হ্যাঁ ভাল আছি কিন্তু তোমাকে এত ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন?”। শুনে হাসল। বড় করুণ সে হাসি।

“যে মায়ের একমাত্র ছেলে ড্রাগে আসক্ত, তার মুখে ক্লান্তি থাকবে না তো কি থাকবে?

মনঘরের অন্দরে উঁকি দিয়ে সেই পুরনো ক্রোধের খোঁজ করলাম। কান খাড়া করলাম যদি ভিতর থেকে কেউ বলে ওঠে “বেশ হয়েছে! বড়লোক বাড়ি শুনে চলে গিয়েছিলে। কর্মফল তো ভোগ করতেই হবে”। নাহ! কোথাও শোনা গেল না সেই পুরনো ক্ষত চিহ্নের আর্তনাদ! শুনতে পেলাম না বুকের ভিতর থেকে আসা কোন শ্লেষাত্মক প্রতিক্রিয়া। উল্টে কষ্ট হচ্ছে। আশ্চর্য! কষ্ট হচ্ছে কেন? আমার তো খুশি হবার কথা। তাহলে কি এখনও?

যাবার আগে বলল, “খুব মিষ্টি হয়েছে তোমার বউ। খুব ভাল লাগল আমার সাথে কথা বললে। আসি। ভাল থেকো”। মাথা নাড়লাম। চোখের কোনে জল নিয়ে ক্লান্ত পায়ে ফিরে যাচ্ছে আমার প্রথম প্রেম। বলতে চাইলাম “তুমিও ভাল থেকো মাধবীলতা”। বলিনি। বললে মিথ্যা বলা হত। বাস্তবে ও তো ভাল নেই। মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। অন্তর উজাড় করে কেউ বলল, “ভাল করে দাও ওর সন্তানকে। ওকে ভাল রেখ, মা। কষ্ট দিও না ওকে”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *