জীবন-জরায়ু জাত
অনিরুদ্ধ সুব্রত
১
অনাবৃষ্টির বিরুদ্ধে, নিঃশব্দে
প্রকাশ করল, নতুন কয়েকটি পাতা
বৃক্ষ শরীরে লেপ্টে থাকা
আগাছা যে লতাটি
সূর্য তাকে দেখেনি কি,
বারংবার ঝঞ্ঝায় বিপন্ন মেঘ
হতে পারে নি— সুসংবদ্ধ, আচ্ছন্ন
দূর দিগন্তে চুপে গেছে
বজ্র-অহংকার, ম্লান
ধানক্ষেত আরও ধীর
পাতার গভীর থেকে
কোনো শিশির নিঃস্ব রাতে
টেনে তুলে এনেছে তো
একটি নিষিক্ত ফলবতী গান,
এরপরও কি বলবে—
কবিতা জীবন নয়
জীবনের সমান্তরাল সাধ, নির্মাণ…
২
সারারাত মৃতের মতো অসাড়
যার পায়ে ধরে, ভিক্ষা করে
জীবন ফেরে না হাতে
অথবা যোদ্ধা-ক্ষোভ
নীরব, প্রতিহত হয়ে
সূর্য ওঠার আগে— লিখে ফেলে
আগুন হয়ে ওঠা আঙুলের তাপ
শুধু তার কয়েকটি মাত্র
অর্জিত শব্দের ধ্বনির আঘাত
পাথরের মতো কোনো
চির স্তব্ধ দরজার ওপর
ইলোরার চিত্র সম্ভারের
চেয়ে আরও তীক্ষ্ণতর
শরের দাগ, হবে না কি সে কথা
জীবনের থেকে গাঢ় আরও
এক জীবনের লেখা কবিতার
৩
যত ফিরে এসে, পুরনোকে টেনে
ঝেড়ে পুছে, কুয়াশা মুছে
বাড়ানো হাত
ধরতে চেয়েছে কৌণিক রোদ
ছত্রাক শিকড়ের স্যাতসেতে
শুকিয়ে উঠুক একবার
ক্ষয়িষ্ণু যৌবন থেকে
শেষ যতটুক নিংড়ে আনা
হতাশ-হত জল
শুষে শুষে নিতে নিতে
ঝুর ঝুর ভেঙে পড়েছে
ফাটা স্ফটিক-বিশ্বাস
সমস্ত গৌন করে যে সাধনা
শান্ত রেখেছিল মৌনে আশ্রয়
নেয় নি সে মহার্ঘ রোদ
সরে গেছে ততবার
সারি থেকে সুন্দর, আর
বিপ্রতীপ আধার
কী কথা ধার নিয়ে বলি তাকে
সেও কি হয়নি বলা
কবিতা উত্তীর্ণ জীবনের…
৪
কবিতা লেখাই হয় নি
তুচ্ছ জীবনের চেয়ে অধিক
কিচ্ছু কবিতা ছিল না কখনও
যে কথা বলল, বাক-রহিত
যে কান্না কেঁদে ফেলল, দুর্বল
নিষেধে যে তাকিয়ে থাকল
কালো দেয়ালের দিকে নিস্পলক
এ সব তাদেরই বিকার,
বৃষ্টিহীন দুপুরের দাউ দাউ
পোড়া ফসলের শব ভর্তি মাঠ
স্বপ্ন-সৌধ দানার কাহিনী
দেখেছিল যত বিনিদ্র রজনী
এই প্রলাপ সেই ছন্দের
নষ্ট আনন্দের ধিক্কার
প্রতি পংক্তির অবয়বে
প্রতি প্রতি বার,
সবটুকু জীবন, সবটুকু রক্তের
কিছু তার অপর্যাপ্ত
জেগে থাকা জীবনের
কোথাও অস্তিত্ব ছিল না তো
স্বতন্ত্র, একটি নিপাট কবিতার
একটি নিরবচ্ছিন্ন সু-দেহ
শিল্পের, সুভাষিত সুখকর—
অগম্য, অবান্তর
ঠিক ততবার
প্রয়োজন ছিল এই
জীবনের মতো কবিতার…
৫
জীবনকে বলার এ বদভ্যাস
খিদে পিপাসায় চিৎকার
রুদ্র ও রূপকে নির্বাক
ক্ষরণের ফোঁটায় ফোঁটায়
ভিজে ওঠা যত নিঃসহায়
তা-ই তাবড় যথার্থ শব্দহীন
কেবল চেষ্টা
কৃস্র, অর্জন, ক্রম অর্জন
আমাকে আমি’র স্বগত
অনন্ত বলাবলি
ক্রমশ মৃত্যুর ধারাবিবরণ
ধীর ফিসফিসিয়ে যত হার
ফের ফিরিয়ে নেওয়া
ভাঙা ও ব্যর্থ তলোয়ার
ধ্বনি গাম্ভির্য ভরা নকল বক্তৃতা
আত্ম-সান্ত্বনা মাখা গান
সমস্ত শ্বাস নাভিদেশে ধরে
স্পন্দনহীন বুকের সমাচার
এর চেয়ে অধিক কবিতা কী
এর চেয়ে অধোগামী কবিতা কী
এর চেয়ে কৌতুক
নিয়ত জড়ানো কৌশল
জীবনের সমান্তরাল
অবাস্তব, কোনো কবিতার…
৬
জীবন আশ্রয় নিতে চেয়েছে
ছেঁড়া ত্রিপলের কবিতায়
পাখি বা পশুর মতো যদি
নীড় অথবা গুহা হয়ে ওঠে,
দাবানল বা তুষার ঝড়ের দিনে
সমুদ্র সুনামি সৈকত ছেড়ে
বুকের রক্ত ক্ষরণ দেখার
গোপন আস্তানা গড়ে তোলা
এক কবিতার জগৎ
সব বেদখলীর ওপর
চরম দখল, জাপটে ধরার
আসলে আপন কান্নার
নিজেকে ক্ষত করার
নিহত কবিতার ওপর
নতুন কবিতার এক জীবন,
বড় ওতোপ্রোত আখড়া, ঘর
শরীরের কাছে শব সাধনার
শবের কাছে স্তব্ধতার
আর জীবনের কাছে
জীবনকে ব্যবচ্ছেদ করে
মন ও হৃদপিন্ড স্বতন্ত্র যে
সে সত্য প্রতিষ্ঠার
জীবনেই জীবনোত্তীর্ণ কবিতার..
৭
স্বেদ ও স্বার্থের স্বরলিপি
ভুলে ভর্তি ছন্দের ভিতর
নির্লঙ্কার পদ সমাহারে
বারে বারে যে তাড়না
আত্মঘাতী হয়ে ওঠার
অথবা সারারাত সন্ধানে
কেটেছে যে শ্রেষ্ঠ পংক্তি
তার, তারই সঙ্গে জীবনের
প্রতিটি হার, পাশা, দাবা
কুস্তি ও অস্বস্তি সূচক ব্যবহার
নষ্ট নালায় নেমেছে যখন
সব মিলে মিশে একাকার,
জীবনে কবিতার মূর্তি নির্মাণ
প্রতি সূক্ষ্ম নির্মাণে যাপনের
মাখা কাদা, লালা ও অশ্রু
ভিজিয়ে ছেনে ছেনে চিৎকার
অথবা যা হবার নয়
আংশিক বা ঘন ঘন ভেঙে যায়
খসে খসে পড়ে
ব্যর্থ বৃষ্টি, অব্যর্থ ঝড়ে
তারই নির্মম লেখচিত্র এঁকে
জীবন জড়িয়ে নগ্ন ভাবে
চুপ তা-ই, কবিতার দেহ হয়ে থেকে
৮
বারবার চৌখোশ জীবনের
চৌকো দেয়ালে স্বপ্ন-ক্রীড়ার লাথি
অথবা শূন্য জেনেও
আপন অক্ষে নিরপেক্ষতার ফাঁকি
দিয়ে কি হয়নি দেখা
জীবন-স্বতন্ত্র, সমান্তরাল
সরে দাঁড়িয়ে, কবিতা কি সত্যি একা,
কখনও সৌখিন করে
বহুদূর থেকে যারা লেখে
যারা নেশা করে আছে
বাকপটুতার সুভাষিত সোমরসে
তারা তারকার মতো খুঁজেছে
আকাশে নক্ষত্র জীবন সাধ,
আমার কবিতা তারই বরবাদ
সে শুধু থেকেছে শুয়ে
অসহ জীবনের উলঙ্গ শরীরে
ক্লেদ,চর্মে মিশে
যা জীবন, তা-ই দীর্ঘ ছন্নছাড়া
চির অসমাপ্ত, বিচ্ছিন্ন
ব্যর্থ কাব্যপোন্যাসের ধারা
নষ্ট জীবনের সঙ্গে এই
নষ্ট সঙ্গমে ভূমিষ্ঠ যে কথা
কবিতার নামে বেওয়ারিশ
তাই জীবনের নামে গাঁথা..
৯
যতবার হাত ধুয়ে হাত ছুঁই
যতবার কাগজ কলম
প্রণাম করে মাথার ওপর থুই
বুকে নেমে আসে
ঠোঁটে এসে ওঠে ভিটেহীন
সততার কী আছে জানি না তো
সত্তা রোজই অর্বাচীন
খেলেছে যাপন প্রান্ত থেকে
মধ্য রাজ্য, রাজ-পথ
সরিসৃপের শক্তি খুঁজেও
হেয় এ হিলহিলে শরীর
ভোরের স্বপ্ন মিথ্যে করে
দু’হাত পেতেছি আশান্বিত সন্ধেয়
কবি কেমন হয়– সে কি গাছ
গাছের মতোই শিকড় ও শাখা
এই-ই তার পার্থিব বিস্ময়,
বৃষ্টি ও অপমান দুই-ই ঝরঝর
ভিজেছি অসীম রাত
একটি সে চূর্ণী নদীর পার
অথচ নিছক, সকল অন্ধকার
জীবন-কবিতা বিফল নির্ভর…
১০
আস্তো একটি কবিতা নয়
সারাজীবন শব্দের নষ্ট সঞ্চয়
একটি ইলিউশন, অমাবশ্যার মিথেন
চেরা মাটির ছেঁড়া প্রান্তর
নদী এখানে হারানো ধারা
ফুলিয়ে তোলে, করে বন্যার অভিনয়,
কবিতার হাতে লুকোনো চাবুক
কবিতা প্রেত, অশরীরী সহবাস
পূর্ব জন্মের পেতল-সিঁড়িতে
যা কিছু ভূত, যা সব হুতাশ,
তবুও, তবুও বারংবার
জীবনের সমস্ত পরাজয়, হার
গলগল ঢেলে দিয়ে গরল
প্রতি পলে পলে কান্নার অভিঘাত
কবিতার জন্য ভিখারি, নিঃস্ব
বাউল ও বেপরোয়া, বিঘ্ন
অসংলগ্ন করে তোলা
জীবন-সাধন বেদী
রক্ত মাখানো ভাতই কবিতা-জীবন
কবিতার ধ্বনিতে মুখরিত এই মুখ
ধষ্ট জীবন, আত্ম-ক্ষত, ভুল সমস্ত
যা অনুপুঙ্খ জীবনেরই চিৎকার..