মূল গল্প : পহলা ঝূঠ
লেখক : রাজেন্দ্র যাদব
ভাষান্তর : প্রথম মিথ্যে – স্বপন নাগ
মিথ্যে সমাজেরই দান। সেই সমাজের সঙ্গে বাচ্চাদের প্রথম পরিচয় হয় মা-বাবার মাধ্যমে। প্রথম মিথ্যে কবে বলেছি, মনে পড়ে না। আজও মনে নেই, শেষ মিথ্যেই বা কোনটা ছিল ! আরে হ্যাঁ, মনে পড়েছে – একেবারে ঢিলেঢালা পোশাকে সজ্জিত এক এলেবেলে বুড়োকে সেদিন খুব সরলতায় বলেছিলাম, ‘কী ব্যাপার ! আজ তো বেশ ধোপদুরস্ত লাগছে আপনাকে। তা নওজোয়ান সেজে কোথায় ঘোরা হচ্ছে… ?’ ব্যস্, এত খুশি হল যে চোখেমুখেই তা স্পষ্ট, যেন বয়স থেকে তার দশ দশটা বছর কমে গেছে। যদি বলেন, তাহলে বলব, এ কোন মিথ্যে ছিল না। আমি শুধু সত্যকে আড়াল করেছিলাম মাত্র।তবে ‘প্রথম মিথ্যে’ বলতে যা মনে পড়ছে, তা অবশ্য এতটা আনন্দদায়ক ছিল না। আগ্রায় আমাদের বাড়ির নিচে বাজারে বেশ কিছু দোকান ছিল। সেগুলোর মধ্যে মহারাজ নামে একজন বুড়ো ছিল, সে তামাক বেচত। তার অর্ধেক দোকান ছিল কবিরাজি জিনিসের, বাকি অর্ধেক তামাক। উল্টোনো গান্ধিটুপির মত খোলে সে সর্বদাই কিছু না কিছু কুটত, গুঁড়ো করত। তার সঙ্গে আরক আর কী কী সব মেশাত। কখনো আবার হাওয়ায় তামাকের ঝাঁজের সঙ্গে গুড় ও আরও কিছু মিশিয়ে ছোট-বড় পিরামিড বানিয়ে রাখত। সেগুলোকে বলত পিণ্ডি। ছোট পিণ্ডি এক আনা, বড় আট আনা বা এক টাকা।একটা মেয়ে ছিল তার। মেয়েটার ফর্সা মুখে হালকা বসন্তের দাগ। সে আমারই বয়েসী, বছর আষ্টেকের। সবাই তাকে মহারাজের শান্তি বলে ডাকত। শুধু শান্তি কেউ বলত না। মহারাজ কবিরাজি সামলালে শান্তিকে সামলাতে হত তামাক। যতদূর মনে পড়ছে, আর কেউ ছিল না ওদের সংসারে। সারাদিন আমাদের সাথেই খেলাধুলো করত শান্তি। মাঝেমাঝেই মহারাজ এসে দু’চার থাপ্পর কষিয়ে তাকে টেনে নিয়ে বসিয়ে দিত দোকানে। মনে আছে, আমাদের সঙ্গেই ইস্কুলে যেত সে। দু’দুটো দোকান সত্ত্বেও খুব ভালো অবস্থা ছিল না মহারাজের। আমরা যখন ঘর থেকে রোজ এক আনা পেতাম, শান্তির জুটত মাত্র এক পয়সা। সেসময়ের এক পয়সা মানে আজকের দিনে প্রায় এক টাকার সমান।একদিন মহারাজ আমাদের দুজনের ওপর দোকানের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে কোথাও গিয়েছিল কোন একটা কাজে। আমি দেখলাম, যে টাটে বসত মহারাজ, তার নিচে একটা এক আনার অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে। শান্তি সম্ভবত দেখতে পায়নি, সে তখন তামাকের পিণ্ডি গোনায় ব্যস্ত। চুপিচুপি এক আনাটাকে হাত দিয়ে আড়াল করি। ভাবতে থাকি, কী করে তুলে নেওয়া যায় , যাতে শান্তি টেরও না-পায় ! বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস শুরু হয়ে গেছে। খুব সাবধানে প্রথমে এক আনাকে মুঠোয় নিই, তারপর একদম নিষ্পাপ মুখ করে ধীরে সেটিকে পকেটে চালান করে দিই।তারপর সেখান থেকে কীভাবে কেটে পড়া যায়, ভেবে বেশ সংকটে পড়ি… এটাই আমার জীবনের প্রথম ‘বড় চুরি’, ফলে ভয়ও লাগছিল খুব। বাইরে থেকে কেউ এক আনাটি দেখে না ফেলে ! সময় দুপুরের শেষদিক। সকালে হলে বলে দিতাম, রোজদিনের। কিন্তু সকালের এক আনা এখনো বেঁচে আছে, কেউ বিশ্বাস করবে না। মনে মনে আশা জাগছে, মহারাজ আসার আগেই দু’চারটে পিণ্ডি তো বিক্রি হয়েই যাবে, তখন আর এই এক আনার কথা কারো মনে থাকবে না। এমন নিদারুণ সংকটে কোন অছিলাতেই উঠে দাঁড়াবার হিম্মতও হচ্ছে না।চালাকি করে ভূমিকা করি, ‘কালাকাঁদ খাবি, শান্তি ?”পয়সা কোথায় ?”আরে যখন আসছিলাম, বাজারে এক আনা কুড়িয়ে পেয়েছি।”কই দেখা !’আমি দেখালাম। দেখে চকচক করে উঠল ওর দুটো চোখ। ‘যা, নিয়ে আয়। বাবা এসে গেলে আমাকে মারবে, আমি যাব না।’মনে হল, চুরির অপবাদ যেন নেমে গেল। নিজের মিথ্যের ওপরই বিশ্বাস করেছিলাম যে সত্যি সত্যিই এক আনাটাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পেয়েছি। ‘আসছি’ বলেই এক দৌড়ে মিষ্টির দোকান। লোভ এসে গেল, প্রায় সমস্ত কালাকাঁদই খেয়ে ফেললাম। সামান্য কিছু বাঁচিয়ে ফিরে এসে দেখি সে এক দৃশ্য ! শান্তির চুলের ঝুঁটি একহাতে ধরে চাবুক দিয়ে পেটাতে পেটাতে ক্রুদ্ধ মহারাজ বলেই চলেছে, ‘বল্, বল্ কোথায় এক আনা ?’ চিৎকার করে কাঁদছিল শান্তি, ‘জানি না, বিদ্যের দিব্যি, আমি জানি না।’হকচকিয়ে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকি, এখান থেকে কেটে পড়াই ভালো। শান্তি কেঁদেই চলেছে, ‘আমি সত্যি জানি না বাবা।’ মহারাজ তখনই আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, ‘সত্যি করে বলো তো, তুমি নাওনি তো…’গলার স্বরে অত্যন্ত স্বাভাবিকতা এনে আমি জবাব দিই, ‘তখন তো আমি চলে গেছিলাম।’ ভেতরে ভেতরে কিন্তু খুব ভয় হচ্ছিল। এক আনাটার কথা শেষ অব্দি শান্তি বলে দেবে না তো !শান্তি বলেনি। কিন্তু বাজারেরই একটা লোক খবরটা দিল যে একটু আগেই আমাকে মিষ্টির দোকানে দাঁড়িয়ে কালাকাঁদ খেতে দেখেছে। আমি চুপচাপ মুঠোয় ধরেরাখা কালাকাঁদের ঠোঙাটা মাটিতে ফেলে দিই আর কাঁদতে কাঁদতে উপরে উঠে আসি। কাঁদতে কাঁদতেই বাড়িতে নালিশ করি,’ মহারাজ মিথ্যে মিথ্যে আমাকে চুরির অপবাদ দিচ্ছে। আমি এক আনা চুরি করিনি, বিশ্বাস করো…’ রাগে গজগজ করতে করতে মহারাজ দোকানের দিকে তাকাল। আবারও উন্মত্তের মত শান্তির পিঠে উপর্যুপরি চাবুক চালাতে লাগল।সেদিন মহারাজ শান্তিকে এত মেরেছিল যে টানা দুটো দিন সে হেঁচকি তুলে কেঁদে কাটিয়েছে। শান্তির মা ছিল না, মহারাজের একমাত্র মেয়ে সে। আমি ঘরে ফিরে সত্যি সত্যিই কাঁদতে শুরু করি। প্রতিবার মনে হচ্ছিল, সত্যিটা স্বীকার করে নিই আর স্বীকার করে শান্তিকে বাঁচিয়ে দিই। এত সময় ধরে মার খেতে খেতে হতভাগী শেষমেশ আমার নামই না বলে বসে !সেই মহারাজ আর এখন কোথায় ! কতবার কল্পনায় হাসতে হাসতে শান্তিকে বলবার চেষ্টা করেছি,’সেদিন সেই এক আনাটা আমিই চুরি করেছিলাম শান্তি…’শান্তি গম্ভীর হয়ে জবাব দিত, ‘জানি তো আমি।”তাহলে বললি না কেন ?’ততক্ষণে অদৃশ্য হয়ে যেত শান্তি। আমি কিন্তু এখনও বিশ্বাস করি, উত্তর ঠিক পাব।হ্যাঁ, শান্তির পিঠে সেদিনের চাবুকের আছড়ে পড়ার যন্ত্রণা আমি আজও আমার নিজের শরীরে অনুভব করি, প্রতিদিন।
•••••••••••••••••••••••••••
রাজেন্দ্র যাদব : সংক্ষিপ্ত পরিচিতি উত্তর প্রদেশের আগ্রায় ১৯২৯ সালের ২৮ আগষ্ট রাজেন্দ্র যাদব জন্মগ্রহণ করেন। রাজেন্দ্র যাদব এমন একটি নাম, যেখানে তাঁকে বাদ দিয়ে হিন্দি গদ্যসাহিত্যের আলোচনা কখনোই সম্পূর্ণ হতে পারে না। তিনি উপন্যাসের পাশাপাশি অজস্র ছোটগল্পও লিখেছেন। ‘নঈ কহানি’ হিন্দি গদ্যসাহিত্য আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন তিনি। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘প্রেত বোলতে হ্যায়’ প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে। পরবর্তী সময়ে উপন্যাসের নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় ‘খুলা আকাশ’। ১৯৬৯ সালে এই উপন্যাসকেই চলচ্চিত্রে রূপায়িত করেন বাসু চ্যাটার্জি ‘খুলে আসমান’। ‘উখড়ে হুয়ে লোগ’, ‘কুলটা’, ‘শহ্ অওর মাত’, ‘অনদেখে অনজান পুল’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য অন্যান্য কয়েকটি উপন্যাসের নাম।প্রেমচন্দ প্রতিষ্ঠিত ‘হংস'(১৯৩০-৫৩) নামের সাহিত্য পত্রিকাটিকে নতুন করে প্রেমচন্দেরই জন্মদিন ৩১ জুলাই ১৯৮৬ সাল থেকে পুনঃপ্রকাশ ও সম্পাদনার দায়িত্ব নেন রাজেন্দ্র যাদব। হিন্দি গদ্যসাহিত্যে নিরলস পরীক্ষা নিরীক্ষা ও তাকে লালন-প্রশ্রয়ে তাঁর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবরে নিউ দিল্লিতে রাজেন্দ্র যাদবের জীবনাবসান হয়।