বড় দিঘির ধারে
দেবাংশু সরকার
গরমের ছুটি পড়েছে কলেজে। কয়েকজন বন্ধু ভাবছে, কয়েক দিনের জন্য কোথাও ঘুরে এলে ভালো হয়। অবশ্য কোথাও বেশিদিন থাকা যাবে না। কারন কলেজ খুললেই পরীক্ষা। তবে দুতিন দিনের জন্য কোথাও যেতে অসুবিধে নেই। কিন্তু কোথায় যাবে? কাছে পিঠে সেরকম ভালো যায়গা কোথায় আছে?
অমিত বললো, “চল, আমার মামার বাড়ির কাছে একটা বড় রাজবাড়ি আছে। পিকনিকের জন্য ভাড়া দেয়। নাইট স্টের ব্যবস্থা আছে। অনেকে দুতিন দিন থাকে। বিরাট বড় বাড়ি। পাশে বিরাট বাগান। কিছুটা দুরে একটা বড় দিঘিও আছে। শীত কালে ফাঁকা পাওয়া যায় না। তিন মাস আগে থেকেই বুক হয়ে যায়। তবে এখন গরমের সময় ফাঁকা পাওয়া যেতে পারে। যদি তোরা রাজি থাকিস তাহলে আমার মামাতো ভাইকে বলবো দুদিনের জন্য বুক করতে।”
কালক্ষেপ না করে সবাই রাজি হয়ে গেল। অমিত ফোন করলো তার মামাতো ভাইকে। পরের দিন অমিতের মামাতো ভাই অশোক রাজবাড়ির কেয়ার টেকারের সঙ্গে কথা বলে বাড়ি বুক করে অমিতকে জানালো। সেই সঙ্গে জানালো তার তিন বন্ধু এই পিকনিকে যোগ দিতে চায়। অর্থাৎ অশোকরা চারজন যোগ দেবে অমিতদের দুদিনের পিকনিকে।
অমিত, শ্যাম, সুমন, করন সিং, শ্রেয়া ও রনীতা মোট ছজন সহপাঠী বেশ সকালে বেরিয়ে পড়েছে রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে। দশটার মধ্যে তারা পৌছে গেল গন্তব্যস্থলে। অশোক তার আগেই তার বন্ধুদের নিয়ে এসে গেছে।
পুরানো দিনের বিশাল বড় অট্টালিকা দেখে চোখ কপালে উঠলো অমিতের বন্ধুদের। তিনশো, সাড়ে তিনশো বছরের বেশি হবে বাড়িটার বয়স। অবশ্য নিয়মিত সংস্কার করা হয় বলে কোনো জীর্ণতা চোখে পড়ে না। অশোক বা তার বন্ধুরা রাজবাড়ী দেখে চমকিত না হলেও, তাদের আনন্দের কারন আগামী দুদিন ধরে হৈচৈ, মজা করা।
মধ্যবয়স্ক কেয়ার টেকার রাজবাড়ির কাছাকাছি থাকে। সকালে চলে আসে। বাড়ির, বাগানের দেখাশোনা করে। পিকনিক করতে আসা গেস্টদের সাহায্য এবং সেবা প্রদান করে। বিকালের পর বাড়ি ফিরে যায়। তার সঙ্গে শম্ভু থাকে। সে প্রধানত গেস্টদের ফাই ফরমায়েস খাটে। গেস্টদের রান্না করে দেওয়ার প্রয়োজন হলে রত্না মাসীও আসে।
অমিতরা পৌছে দেখলো কেয়ার টেকার দোতলার পাঁচটা ঘর খুলে পরিস্কার করে রেখেছে। প্রতিটা ঘরে দুটো করে সিঙ্গেল বেড পাতা। প্রতিটা ঘরের ছাদ থেকে পুরানো দিনের লম্বা শিলিং ফ্যান ঝুলছে। পুরানো আমলের কাঠের লম্বা জানালা দিয়ে যথেষ্ট পরিমাণ আলো এবং বাতাস প্রবেশ করছে ঘরগুলোতে। অমিতরা আসার আগেই অশোকের নির্দেশে রত্না মাসী প্রাতরাশের ব্যবস্থা করে রেখেছে। প্রাতরাশের পর কেয়ার টেকার অমিতদের রাজবাড়িটা ঘুরিয়ে দেখালো। দোতলায় অনেকগুলো ঘর। প্রতিটা ঘরে পুরানো দিনের কিছু না কিছু নিদর্শন রয়েছে। কোনো ঘরের দেওয়ালে জোড়া তলোয়ার। কোথাও জোড়া বর্শা। কোথাও আবার দেওয়াল জুড়ে বাঘ ছাল। একতলায় গুদাম ঘর, রান্না ঘর। একদম শেষ প্রান্তের ঘরের ছাদ জুড়ে ঝুলে আছে রাজবাড়ির ঐতিহ্য এবং কুকীর্তির অন্যতম সাক্ষী বিরাট বড় ঝাড়বাতি। বুঝিয়ে দিচ্ছে এটা এক সময়ে ছিল নাচ ঘর। তার নিচে অর্থাৎ মাটির মধ্যে আছে প্রাচীন রাজনীতির নিদর্শন অর্থাৎ গুমঘর। কত হতভাগ্যের ভবলীলা যে এখানে সাঙ্গ হয়েছে তার কোনো হিসেব নেই!
আসার পর থেকেই শ্রেয়ার কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। কেবল বিরাট বড় রাজবাড়িটা নয়, গোটা পরিবেশটা তার ভীষণ চেনা মনে হচ্ছে! প্রাসাদোপম রাজবাড়ি, লাগোয়া বাগান, এমনকি বাড়ির পেছনের বড় দিঘিটাও শ্রেয়ার ভীষণ চেনা মনে হচ্ছে! রাজবাড়ির প্রতিটা ইট, কাঠ, পাথর যেন তার চেনা মনে হচ্ছে! তার মনে হচ্ছে এই বাড়িতে সে বহু দিন ছিল। একতলা, দোতলা, সদর ঘর, নাচ ঘর এমনকি গুম ঘরটাও তার চেনা! কিন্তু সে তার উনিশ বছরের জীবনে কোনো দিন এদিকে আসেনি! অথচ পুরো পরিবেশটা তার চেনা! এমনকি বাগানের ঠিক মাঝখানের বুড়ো বট গাছটাও সে আগে দেখেছে! বট গাছটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে আম, জাম, নিম, কাঁঠালের দল।
সারাদিন হৈচৈ করে, গল্পে, গানে, ঢিল ছুঁড়ে গাছ থেকে আম পেড়ে কাটলো দিনটা। রাতের রান্না করে, পরিবেশন করে, বাসন ধুয়ে বাড়ি চলে গেছে রত্না মাসী। কেয়ার টেকার কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি চলে গেছে। যাওয়ার আগে বলে গেছে, “রাতে বড় দিঘির দিকে না যাওয়াই ভালো। সাপ খোপ থাকতে পারে।”
মাঝ রাত। সবাই যে যার ঘরে, যে যার বিছানায় অঘোরে ঘুমোচ্ছে। হঠাৎ খোলা জানালা দিয়ে আসা একটা সুরেলা শব্দে ঘুম ভেঙে যায় শ্রেয়ার। মনে হচ্ছে শব্দটা বড় দিঘির দিক থেকে আসছে। কেউ যেন বড় দিঘির ধারে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে। বিছানা থেকে নেমে সে জানালার সামনে আসে। আরো স্পষ্ট, আরো জোরে শোনা যায় সেই সুর। খুব চেনা লাগে সুরটা। কোথাও যেন শুনেছে! ঘরের আলো জ্বালে শ্রেয়া। দেখে রনীতা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। আবার জানালার সামনে এসে দাঁড়ায় সে। শুনতে থাকে সেই সম্মোহনী সুর। এক অদ্ভুত মাদকতা আছে সেই সুরে! সুরটা যেন ক্রমশ অবশ করে দিচ্ছে শ্রেয়ার শরীরকে, মনকে, আত্মাকে! সেই সুরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কোনো এক অমোঘ আকর্ষণ যেন শ্রেয়াকে আকর্ষিত করছে। সেই অমোঘ আকর্ষণকে অস্বীকার করার ক্ষমতা শ্রেয়ার নেই!
দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে শ্রেয়া। পায়ে পায়ে নিচে নেমে আসে। সদর দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে। চাঁদনি রাতের আলো আঁধারিতে সে চলে আসে বড় দিঘির ধারে।
- “মণি, তুমি এসেছো! কত দিন তোমার অপেক্ষায় আছি! আজ আমার অপেক্ষার অবসান হলো।” দিঘির জলের মধ্যে থেকে ভেসে আসে কথাগুলো।
- “মণি? কে মণি? আমিতো শ্রেয়া।” অবাক হয়ে উত্তর দেয় শ্রেয়া।
- “ঠিকইতো। তুমি শ্রেয়া। আবার তুমি মণি। আমার মণি। তুমিই তলোয়ার ধনী, দাপুটে রাজকন্যা। আবার তুমি অহিংসার পূজারী, অকারণ প্রাণী হত্যার ঘোরতর বিরোধী নরম মনের মনিমালা। আমি তোমার সেই কেলে ছোঁড়া, কানাই। আমি বেইমান নই মণি। অস্পৃশ্য, নিচু জাতের হলেও ভালোবাসার মানে আমি জানি। কিন্তু ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের সঙ্গে লড়তে পারে নি আমার তলোয়ার। বিশ্বাস ঘাতকদের চক্রান্তের সঙ্গে পেরে ওঠেনি আমার তির ধনুক।”
দুই
রাজত্ব সামলাতে সামলাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন রাজা মশাই। ঠিক করলেন কয়েক দিনের জন্য মৃগয়ায় যাবেন। জঙ্গল জীবনে আমোদ প্রমোদ হবে, কিছুটা বিশ্রাম হবে। রাজা মশাইয়ের হুকুম শুনে হৈচৈ পড়ে গেল চারিদিকে। পাগড়ি বেঁধে, লাঠি উঁচিয়ে তৈরি হলো লেঠেল বাহিনী। সারি দিয়ে চলেছে সবাই। রাজা মশাই চলেছেন ঘোড়ায় চেপে। তারপর কয়েকটা দোলা চলেছে। দোলায় চেপে চলেছেন রাণীমা, রাজকন্যা মণিমালা। এই কদিন রাজ্যপাট সামলাবেন অমাত্য মশাই। রাজা মশাইকে বিদায় জানাতে তিনিও হাজির হয়েছেন, সঙ্গে এক কৃষ্ণ বর্ণ যুবক।
রাজা মশাইকে নমস্কার করে অমাত্য বললেন, “রাজা মশাই, একে সঙ্গে নিয়ে যান। এর নাম কানাই। এই ছেলেটা খুব ভালো তিরন্দাজ। তির ছুঁড়ে উড়ন্ত পাখি মারতে এর জুড়ি নেই। এ হচ্ছে একেবারে কলি যুগের একলব্য।”
- “চল ছোকরা। দেখা যাক তোর বিদ্যের দৌড়। এক তিরে তুই কটা পাখি মারতে পারিস, বনে প্রমান হবে।” কথা শেষ করেই হা হা করে হেসে উঠলেন রাজা মশাই। এগিয়ে চললো লেঠেল বাহিনী। তির ধনুক কাঁধে তাদের সঙ্গে যোগ দিল কানাই।
বনের মধ্যে কিছুটা ফাঁকা জায়গা দেখে শিবির পড়লো। মাঝখানের সব থেকে বড় শিবিরটা রাজা মশাই, রাণীমার। পাশে সম উচ্চতার আর একটা শিবির। সেটা রাজ কন্যার। দুটো শিবিরকে ঘিরে রেখেছে আরো বেশ কয়েকটা শিবির।
আজ সবাই বিশ্রাম নেবে। কাল সকালে হল্লা বাহিনী নামবে। বিকালে রাজা মশাই শিবিরের বাইরে এসে ডেকে পাঠালেন কানাইকে। ধনুক হাতে কানাই এসে রাজা মশাইকে প্রনাম করলো। রাজা মশাই বললেন, “দেখা তোর তিরের নিশানা।”
আদেশ পেয়ে ধনুকের ছিলায় টান দিল কানাই। বিকালের আকাশে উড়তে থাকা কয়েকটা পাখিকে মাটিতে নামালো। প্রশংসা করলেন রাজা মশাই। কিন্তু পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন। দেখতে চাইলেন শব্দভেদী বাণ চালানোয় সে সিদ্ধহস্ত কিনা। বাঁধা হল কানাইয়ের চোখ। গাছের ডালে ঝোলানো হল মাটির হাঁড়ি। শব্দ করা হল হাঁড়িতে। শব্দ শুনে তির ছুঁড়লো কানাই। নিখুঁত নিশানায় আঘাত করে হাঁড়িটাকে চুরমার করে দিল কানাইয়ের তির। জোরে হাততালি দিয়ে উঠলেন রাজা মশাই। কিছু উপঢৌকন পেল কানাই। সবাইকে তফাতে যেতে বলে রাজা মশাই কানাইকে বললেন, “তোকে একটা অন্য দায়িত্ব দিচ্ছি। শিকারের দলের সঙ্গে তোকে যেতে হবে না। যতদিন আমরা বনে থাকবো, ততদিন তুই রাজকন্যাকে পাহারা দিবি। তবে রাজকন্যার সামনে যাবি না। দুর থেকে, আড়ালে থেকে নজর রাখবি। রাজকন্যা ভীষণ মেজাজী, উটকো দেহাতি লোকজন একেবারে পছন্দ করে না। হৈ হট্টগোলও একদম পছন্দ করে না। খুব সন্তর্পণে নিজের কাজ করবি। হল্লা বাহিনী যখন কোলাহল করবে, তখন রাজকন্যা অনেক দুরে চলে যাবে। হয়তো গভীর বনে চলে যাবে। সেই সময়ে তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমি তোকে দিলাম।”
পরের দিন সকালে তৈরি হল হল্লা বাহিনী। বনের ভেতরে ঢুকে বিকট শব্দে বাজাতে লাগলো ঢাক ঢোল কাড়া নাকাড়া। ভয়ে বন্য প্রাণীরা ছুটোছুটি করতে লাগলো। রাজকন্যা শিবির থেকে বেরিয়ে এদিকে ওদিকে ঘুরছে। বনের রঙ বেরঙের ফুল তুলছে। কোনোটা সাজিতে রাখছে। কোনোটা নিজের খোঁপায় গুঁজছে। নিজের মনে গুনগুন করে গান গাইছে। হঠাৎ কানে এলো ঝরা পাতার মর্মর ধ্বনি। সতর্ক হল রাজকন্যা। চিৎকার করে বললো, “কে রে তুই কেলে ছোঁড়া? তোর সাহস কি করে হল আমার সামনে আসার? রাজা মশাইকে বলে আজ তোর গর্দান নেব।”
ঘাবড়ে গিয়ে কানাই তোতলাতে থাকে, “ক্ষমা করবেন রাণীমা, ইয়ে মানে রাজকন্যা। আমি একজন গরিব ব্যাধ। পাখি মেরে খাই। খুব ভুল হয়ে গেছে। এবারের মত ক্ষমা করে দিন, আর আসবো না।” - “যা, দুর হ এখান থেকে। আবার দেখতে পেলে গর্দান নেব।”
নিমেষের মধ্যে বনে গা ঢাকা দেয় কানাই। ভাবে, খুব ভুল হয়ে গেছে! আরো সতর্ক থাকতে হবে পায়ের শব্দের ব্যাপারে। বনের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে সে রাজকন্যাকে পাহারা দিতে থাকে। অন্যদিকে হল্লা বাহিনীর কোলাহল ক্রমশ কমতে থাকে। বন থেকে শিবিরে ফিরে যায় রাজকন্যা।
পরের দিন সকাল হতেই আবার শুরু হয়ে যায় হল্লা বাহিনীর হট্টগোল। বন জুড়ে বিকট শব্দ। বনের পশুরা ভয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে দৌড়াতে থাকে। পাখিরা গাছের ডাল ছেড়ে ভিড় করে আকাশে। বিকট শব্দে ঝালাপালা হয়ে যায় রাজকন্যার কান। শিবির থেকে বেরিয়ে বেশ কিছুটা দুরে চলে যায় সে। কানাই অবশ্য তার কাজে অবহেলা করেনি। অতি সন্তর্পণে সে পিছু নেয় রাজকন্যার। হাঁটতে হাঁটতে রাজকন্যা দাঁড়িয়ে পড়ে একটা ফুল গাছের সামনে। রঙ বাহারি বুনো ফুল দেখতে থাকে সে। কয়েকটা তুলেও নেয়।
আকাশ ভর্তি পাখির মেলা দেখে হাত নিশপিশ করতে থাকে কানাইয়ের। তুনীর থেকে তির বের করে ধনুকে সন্ধান করে। আচমকাই হাড়হিম করা বাঘের গর্জন। শব্দ শুনে তির ছুঁড়ে দেয় সে। নিঁখুত নিশানায় আঘাত করে তির। বাঘের গলা এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। সেখানেই পড়ে ছটফট করতে করতে মারা যায় বাঘটা। কানাই দৌড়ে যায় তার শিকারের দিকে। দেখে বিরাট এক মৃত বাঘ পড়ে আছে। কিছু দুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে রাজকন্যা। সে বুঝতে পারে বাঘটা রাজকন্যাকে আক্রমণ করতে উদ্ধত হয়েছিল।
অচৈতন্য রাজকন্যাকে কোলে তুলে নেয় কানাই। ফিরে আসে শিবিরে। সামান্য শুশ্রূষাতে জ্ঞান ফেরে রাজকন্যার। অস্ফুটে সে বলে, “কেলে ছোঁড়া তুমি আমাকে বাঘের হাত থেকে বাঁচিয়েছো?” আগের দিনের ‘কেলে ছোঁড়া’ উচ্চারণে ছিল তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা। আর এদিনের ‘কেলে ছোঁড়া’ উচ্চারণে ঝরে পড়ছে কৃতজ্ঞতা। মাথা নিচু করে, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে কানাই।- “কি হলো কেলে ছোঁড়া তুমি কথা বলছো না কেন?”
- “আজ্ঞে, রাজা মশাইয়ের আদেশ ছিল যে বনের মধ্যে রাজকন্যাকে পাহারা দিতে হবে।”
- “কাল তুমি আমাকে সে কথা বলোনি কেন?”
- “আজ্ঞে, খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যে!”
হালকা হাসি খেলে যায় রাজকন্যার মুখে। সে বলে, “আর ভয় পেতে হবে না। এবার থেকে তুমি সব সময়ে আমার কাছে থাকবে। আমাকে রক্ষা করবে। পারবেতো কেলে ছোঁড়া?” - “পারবো রাজকন্যা। আমি থাকতে কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।”
সেদিনই রাজকন্যা রাজা মশাইয়ের কাছে আব্দার করলো, কানাইকে তার দেহরক্ষী হিসেবে নিযুক্ত করতে। রাজা মশাই সেটাই চাইছিলেন। কিন্তু তার মেয়ের দাম্ভিকতার জন্য ব্যাপারটা গোপন রেখেছিলেন। তবে তার মেয়ের পরিবর্তন দেখে একটু অবাক হলেন। দেহরক্ষী রাখার কারন জানতে চাইলেন। তখন রাজকন্যা সব খুলে বললো। রাজকন্যার আদেশে সবাই মুখ বন্ধ রেখেছিলো। রাজা মশাইয়ের হুকুমে বনে পড়ে থাকা বাঘটাকে তৎক্ষনাৎ তুলে আনা হল। রাজকন্যা তার ঘরের দেওয়ালে বাঘছালটাকে টাঙিয়ে রাখবে বলে চেয়ে নিলো। কারন যত বার সে বাঘছালটাকে দেখবে ততবার তার প্রাণরক্ষাকারীর কথা মনে পড়বে।
মৃগয়া পর্ব শেষ হলো। সবাই ঘরে ফিরলো। রাজা মশাই প্রচুর পরিমাণে উপঢৌকন দিলেন কানাইকে। সেই সঙ্গে লেঠেলদের প্রধান সর্দার নিযুক্ত করলেন তাকে। অনেকের ভ্রু কোঁচকালো। হিংসায় শরীর জ্বললো। তবে রাজা মশাইয়ের সামনে সবাই চুপ করে রইলো। কিন্তু রাজকন্যা কিছুতেই ছাড়তে চায় না কানাইকে। তখন রাজা মশাই ঠিক করলেন, কানাই দুটো পদেই থাকবে। সে লেঠেল বাহিনীর তদারকি করবে। আবার রাজকন্যা যখন বাড়ির বাইরে কোথাও যাবে, তখন সে রাজকন্যার সঙ্গে থাকবে। তখন কানাইয়ের দায়িত্ব অন্য লেঠেল সর্দাররা সামলাবে।
রাজকন্যা মণিমালা তার প্রাণদাতাকে ছাড়তে চায় না। দিনে দুবার করে বড় দিঘির ধারে যাওয়ার সময়ে ডেকে পাঠায় কানাইকে। বদমেজাজি, দাম্ভিক, সাধারন প্রজাদের থেকে দুরে থাকা রাজকন্যা মন খুলে কথা বলে কানাইয়ের সঙ্গে। - “কেলে ছোঁড়া, তুমি তির ছোড়া ছাড়া আর কি জানো?”
- “আমি তলোয়ার চালাতে জানি।”
- “ওফ! আবার সেই যুদ্ধের কথা! এই জন্য আমি মানুষকে ঘৃণা করি। সামান্য জমি জায়গার জন্য মানুষ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে! এইসব তির তলোয়ার মানুষের রক্তে স্নান করে।” কানাইয়ের হাত দুটো ধরে মণিমালা নিজের বুকের কাছে টেনে এনে বলে, “তুমি আমাকে কথা দাও আর কোনো দিন অকারণে প্রাণী হত্যা করবে না। অকারণে পাখি মারবে না। তুমি যদি ব্যাধ হতে, পাখি মেরে খেতে তাহলে না হয় অন্য কথা ছিল। কিন্তু তুমিতো তাও নও। তাহলে কেন অকারণে পাখি মারো? পাখিগুলো তোমার কি ক্ষতি করেছে? উড়ন্ত পাখিগুলোরওতো চোখে স্বপ্ন থাকে। গান গাওয়ার ইচ্ছা থাকে। সুন্দর পৃথিবীটাকে দেখার আকাঙ্ক্ষা থাকে। সেই স্বপ্নকে কেন তুমি অকালে শেষ করে দাও? সেই গানকে কেন তুমি অসময়ে থামিয়ে দাও?”
- “আমি আর কোনো দিন অকারণে প্রাণী হত্যা করবো না। তবে তলোয়ার চালানোকে আপনি যুদ্ধ হিসাবে না দেখে ক্রীড়া হিসেবে দেখুন। কি সুন্দর একটা ক্রীড়া! চোখ আর হাতের চাতুরী। তার সঙ্গে শিল্পের ছোঁয়া!”
- “শুনেছি কোনো কোনো মেয়েও তলোয়ার ধনী হয়। তুমি আমাকে তলোয়ার চালাতে শেখাবে?”
রাজা মশাইয়ের থেকে অনুমতি নিয়ে কানাই রাজকন্যাকে তলোয়ার চালানো শেখাতে থাকে। প্রতিদিন সকালে বড় দিঘির ধার ঝনঝনিয়ে ওঠে তলোয়ারের শব্দে। কয়েক দিনের মধ্যে রাজকন্যা তলোয়ার চালানোর ব্যাপারে নিপুণ হয়ে উঠেছে। তলোয়ার চালাতে চালাতে রাজকন্যা বাঁ হাত দিয়ে চেপে ধরে কানাইয়ের তলোয়ার ধরা ডান হাতটা। রাজকন্যার হাতের চাপে কানাইয়ের তলোয়ার ক্রমশ নেমে আসতে থাকে কানাইয়ের গলার কাছে। মৃদু হেসে রাজকন্যা বলে, “সকালে কেবল তলোয়ার ঘোরাতে আসো। বিকালে আসো না কেন? আমি যে তোমাকে সব সময়ে দেখতে চাই। সব সময়ে কাছে পেতে চাই। তোমাকে ছাড়া আর কাউকে আমার ভালো লাগে না। আমি যে তোমাকে ভালোবাসি।”
হতচকিত কানাই দুপা পিছিয়ে যায়। একটু যেন টলে যায়। বিস্ফারিত চোখে সে বলে, “রাজকন্যা, আমি যে অতি সাধারণ, অতি তুচ্ছ। আর আপনি…।” - “কে বলেছে তুমি সাধারন, তুমি তুচ্ছ? যেদিন বাঘের মুখে পড়লাম সেদিন কোন রাজপুরুষ আমাকে বাঁচাতে এসেছিল? তুমি আমার প্রাণদাতা, তোমাকে আমি আরো কাছে পেতে চাই। আমার সবটুকু তোমাকে দিতে চাই। তুমি প্রধান লেঠেল সর্দার। মানে প্রধান সেনাপতি। অমাত্য, মন্ত্রীদের মত রাজ পুরুষদের থেকে তুমি কোনো অংশে কম নও।”
তলোয়ার শিক্ষা প্রায় শেষের দিকে। ক্রমশ তলোয়ার ধনী হয়ে উঠছে রাজকন্যা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাপিয়ে গেছে কানাইকেও। কিন্তু কানাইয়ের সঙ্গে দেখা করার, সময় কাটানোর কোনো বাহানা চাই। সে প্রশ্ন করে, “কেলে ছোঁড়া তুমি আর কি জানো?” - “কি আর জানবো রাজকন্যা! যা জানি তাও বন্ধ! আপনার কথা রাখতে আর বনে গিয়ে পাখি শিকার করি না। সময় কাটাতে মাঝে মাঝে বনের ধারে গিয়ে বাঁশি বাজাই।”
- “তুমি বাঁশি বাজাতে পারো!”
- “পারি।”
- “আমিও এক সময়ে নাচ শিখেছিলাম। কিন্তু আমার যে তোমাকে ছাড়া কোনো দিন কাউকে ভালো লাগে নি! কোনো কিছু ভালো লাগেনা! তাই বেশি দিন শেখা হয়নি। আমার কথা ছাড়ো। তোমার বাঁশি শোনাবে আমাকে?”
বেজে ওঠে কানাইয়ের বাঁশি। মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতে থাকে রাজকন্যা মণিমালা। শুনতে শুনতে কখনো নিজের অজান্তে গান গেয়ে ওঠে। কখনো নেচে ওঠে। মন দেওয়া নেওয়াতো আগেই হয়ে গেছে। কানাইয়ের মনে যেটুকু ইতস্তত ভাব ছিল সেটাও কেটে গেছে। এখন সে আর রাজকন্যা বলে ডাকে না, ডাকে ‘মণি’ বলে। নাচে, গানে, বাঁশির সুরে, সকাল বিকাল বড় দিঘির ধারে সময় কাটে মণিমালা আর কানাইয়ের।
হঠাৎ একদিন কালী সর্দারের নজরে পড়ে দুজনের ঘনিষ্ঠ মুহুর্ত। কপাল কোঁচকায়, ভ্রু কোঁচকায় কালী সর্দারের। সেও একজন লেঠেল সর্দার। অনেক দিনের লেঠেল সর্দার হয়েও দুদিনের ছোকরা কানাইয়ের আদেশ পালন করতে হচ্ছে! রাতে ধানক্ষেত পাহারা দিতে হচ্ছে, যাতে কেউ ধান লুঠ করতে না পারে। আগে এত পরিশ্রম করতে হত না। আগে ধান লুঠ হলে লেঠেল সর্দাররা হেলতে দুলতে আসতো তদন্ত করতে। এত খাটুনি এই বয়সে পোষায়? বয়স্ক সর্দাররা রাত জেগে জমি পাহারা দেবে, আর এ ছোকরা রাজকন্যার সঙ্গে লীলা খেলা করে আয়েসে দিন কাটাবে! চাপা রাগটা কালী সর্দারের শরীর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে ভাবে তখনই একটা হেস্তনেস্ত করবে। আবার বদমেজাজি রাজকন্যার ভয়ে পিছিয়ে আসে। কিন্তু অনান্য সর্দারদের ডেকে সত্যি মিথ্যে রঙ চড়িয়ে কানাই আর রাজকন্যার ঘনিষ্ঠতার কথা বলে, চক্রান্তের জাল বুনতে থাকে। ভীম সর্দার, সনাতন সর্দার সবাই অসন্তুষ্ট কানাইয়ের প্রতি। সবাই ক্ষতি চায় কানাইয়ের। কিন্তু কিছু করতে পারে না রাজা মশাইয়ের ভয়ে। কানাই যে রাজা মশাইয়ের অত্যন্ত প্রিয় পাত্র। তাছাড়া আরো একটা ভয়ের কারন আছে। লাঠি বা তলোয়ার হাতে কানাই একশো লোকের মহড়া নিতে পারে। অস্ত্র হাতে কানাইয়ের সামনে অনান্য লেঠেল সর্দাররা দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু এই সুযোগটা কেউ হাতছাড়া করতে চায় না।
লেঠেল সর্দাররা দল বেঁধে যায় রাজা মশাইয়ের কাছে। রং চড়িয়ে বলে অনেক কিছু। প্রথমে রাজা মশাই বিশ্বাস না করলেও, পরে ভাবেন একসঙ্গে এতজন যখন বলছে তখন খোঁজ খবর নেওয়া দরকার। গুপ্তচর নিয়োগ করলেন। গুপ্তচরের মুখে সব শুনে রাজা মশাই খুব বিরক্ত হলেন, খুব অসন্তুষ্ট হলেন, ভীষণ রেগে গেলেন কানাইয়ের ওপর। কিন্তু রাজকন্যার জন্য সোজা পথে কিছু করতে পারছেন না। বাঁকা পথ ধরলেন। অনেক ভেবে চিন্তে পরিকল্পনা করলেন, যাতে সাপ মরে, লাঠিও না ভাঙে। অর্থাৎ এমন ভাবে কানাইকে সরাতে চান, যাতে রাজকন্যা কিছু জানতে না পারে। গোপনে ডেকে পাঠালেন লেঠেল সর্দারদের। বুঝিয়ে দিলেন কি করতে হবে। আদেশানুসারে কাজ করতে লাগলেন লেঠেল সর্দাররা। তবে গোপনে।
চারিদিকে কথাটা রটতে থাকে, প্রধান সর্দার কানাইয়ের সঙ্গে তাদের মহল্লার মেয়ে মুলিয়ার আশনাই হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই বিয়ে হবে। রাজকন্যার পরিচারিকাদের কানেও কথাটা এসেছে। কিন্তু তারা ভয়ে রাজকন্যাকে কিছু বলতে পারছে না।
বেশ কিছুদিন কানাইয়ের দেখা নেই। রাজকন্যা মনে মনে অস্থির হয়ে উঠছে। একদিন পরিচারিকাদের ডেকে কানাইয়ের কথা জিজ্ঞাসা করলো, ইতস্তত করতে করতে তারা রাজকন্যাকে বললো, “কানাইতো কয়েক দিন আগে মুলিয়াকে নিয়ে এই দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। কোথাও তাদের দেখা যাচ্ছে না। মুলিয়ার বাবা মা হন্নে হয়ে মুলিয়াকে খুঁজছে আর কান্নাকাটি করছে।”
গম্ভীর হয়ে যায় রাজকন্যা। অস্ফুটে বলে ওঠে, “বেইমান!”তিন
— “আমার মৃত্যুর জন্য আমার কোনো দুঃখ নেই মণি। কিন্তু এই জঘন্য চক্রান্তের জন্য একটা নিষ্পাপ মেয়ের প্রাণ চলে গেল! এই দুঃখটা আমার মনে এখনো রয়ে গেছে। তোমাদের গুমঘরে খুঁজলে হয়তো এখনো মুলিয়ার কঙ্কালটা পাওয়া যাবে! আমাকে কালী সর্দার, সনাতন সর্দাররা মাদক দ্রব্য খাইয়ে অচৈতন্য করে এই দিঘির জলে ডুবিয়ে মেরেছিলো। তখন থেকে আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য, যদি কোনো দিন এই দিঘির ধারে আসো সব কথা তোমাকে বলবো, তারপর এই স্থান ত্যাগ করবো। এবার আমি চলে যাব দুরে, অনেক দুরে। বিদায় রাজকন্যা, বিদায় মণি।”
- “আজ্ঞে, খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যে!”
- “তুমি কি করে জানলে রাজা মশাইও এই চক্রান্তে সামিল?”
- “আমাকে জলে ছুঁড়ে ফেলার সময়ে ওরা চিৎকার করে সব কথা বলছিল। আমি আধা অচেতন অবস্থায় ছিলাম। ওদের কথা আমার কানে আসছিলো।”
- “তুমি যখন জানো রাজা মশাইও এই চক্রান্তে সামিল। তাহলে তার মেয়েকে সামনে পেয়েও তার ক্ষতি করছো না কেন?”
- “তোমার ক্ষতি করবো! আমি! কি করে করবো? ভালোবাসি যে!”
চুপ করে যায় শ্রেয়া। তরঙ্গায়িত অতল জলের অন্তরাল থেকে ভেসে আসা কথাও থেমে যায়। ধির পায়ে ফিরে আসে শ্রেয়া। ঘরে ঢুকে দেখলো রনীতা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। চুপচাপ নিজের বিছানায় শুয়ে পড়লো সে। ঘুমিয়ে পড়লো কিছুক্ষণের মধ্যে।
- “এই শ্রেয়া ওঠ। যাবি না আম পাড়তে?” রনীতার ডাকে ঘুম ভাঙে শ্রেয়ার। চোখ রগড়াতে রগড়াতে সে ভাবতে থাকে, গত রাতে কি কিছু ঘটেছিল? নাকি সে কোনো স্বপ্ন দেখছিল?